Ameen Qudir

Published:
2018-02-24 15:39:28 BdST

সেরাদের সেরা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল :গল্পের ক্ষুদ্র এক অংশ বলি


 


ডা রাজীব দে সরকার

_________________________________

সার্জারী আউটডোর_ওটিতে এক বয়স্ক চাচা এলেন। সাধারণতঃ বুধবার আমি থাকি এই ছোট্ট অপারেশন থিয়েটারটায়। ছোট খাটো সার্জারী যেগুলো লোকাল অ্যানেসথেশিয়া দিয়েই সেরে ফেলা যায়, সেগুলো এখানে করি আমরা।

ফজলু মিয়া (ছদ্মনাম), বয়স ৫৭ - এসেছেন তাদের ছোট একটা সেবাসিয়াস সিস্ট অপারেশন করাতে। আমি সার্জারীটা করছিলাম, আমার সাথে ওটির স্টাফ আর ইন্টার্নী চিকিৎসক আছেন। চাচার সাথে কথা হচ্ছে কাজের ফাঁকে।

"সামনের মাসে মাইয়াটার বিয়া, ম্যালা খরচ"

চাচা জানালেন সামনের মাসে তার মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে টাকা পয়সা প্রায় সবই দিয়ে দিচ্ছেন, ঐ আয়োজনে। হাতে শুধু খাই খরচের টাকাটা আছে। এর মধ্যে হাতে এই টিউমার!

কিন্তু আরো এক জটিল রোগে ধরেছে তার। ... হার্নিয়া। ব্যাথায় কষ্ট পান মাঝে মাঝে। ভারী কাজ করতে অসুবিধা হয়।

"তয় চাচা, আপনেগো কথা মতো অপারেশনডা করায়ে ফ্যালামু। আউটডোরে বড় ডাক্তারে দেখছে। কইছে পেট না কাইটা ফুটা কইরা কইরা দিবো (ল্যাপারোস্কপি বুঝিয়েছেন)। বেশীদিন ভর্তি থাকা লাগবো না। সামাইন্য খরছ অইবো। খালি কয়ডা টেশ করাইয়া ভর্তি হইয়া যাইতে কইছে। মাইয়াডারে পার কইরাই আমু। আমার লগের একজন করাইসে, ভালা আছে হ্যায়। আমু আমি"

রোগীর এই তৃপ্তির ভাষ্য অমূলক না।

কয়েকদিন আগে টারশিয়ারী স্বাস্থ্য সেবা ক্যাটাগোরীতে #প্রথম হয়েছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সার্জারী বিভাগের তথ্য উপাত্ত রোগী ও তার স্বজনদের সেই আস্থাকে প্রতিফলিত করে চলেছে প্রতিনিয়ত।

মাত্র কয়েক বছর আগেও শেরে বাংলা নগরের একটি নিভৃত প্রতিষ্ঠান আজ রোগীদের নির্ভরতার আপনালয় হয়েছে। অসুস্থ মানুষ এখানে আসেন, সেবা নেন এবং তৃপ্তির অনুভূতি নিয়ে ফিরে যান।

তাদের গল্পের সুতোয় অনুপ্রাণিত হয়ে আসেন তারই কোন স্বজন কিংবা বন্ধু। এভাবেই রোগীরাই ভার নিয়েছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অব্যর্থ ব্র্যান্ডিং এর।

পরিসংখ্যান এর কাগজ বলছে,
শুধুমাত্র "জরুরী বিভাগে" গত বছরে সেবা নিয়েছেন
৮০ হাজার ৮৩৭ জন মানুষ।
সাথে জেনারেল সার্জারী আউটডোরে রোগী ছিলো ৭৮ হাজার ৪৩৬ জন,
অর্থোসার্জারী আউটডোরে রোগী ছিলো ৪৯ হাজার ৬২৫ জন,
প্লাস্টিক সার্জারীর আউটডোরে রোগী ছিলো ২ হাজার ৮৫৫ জন আর
অর্থোপেডিক্সের রোগী ছিলো ৪৯ হাজার ৬২৫ জন।

টারশিয়ারী হাসপাতালের হিসেবে সংখ্যাটাকে কতোটুকু গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে তা হয়তো ডাটা অ্যানালিস্টের এক্সেল শীটের ব্যাপার। কিন্তু আমাদের কাছে এই পরিসংখ্যানগুলো এক একটি অধ্যায়, এক একটি সুযোগ, এক একটি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একক।

৮০ হাজার এর বেশী মানুষ তাদের অসুস্থতার জরুরী প্রয়োজনে ভরসা করেছেন আমাদেরকে। বেছে নিয়েছেন আমাদের চিকিৎসা সেবাকে, আমাদের প্রতিষ্ঠানকে। মানুষের এই আস্থা, এই নির্ভরতা, আমাদের কাছে নিছক পরিসংখ্যান থেকে অনেক অনেক বড়। অনেক আনন্দের। অনেকখানি অনুপ্রেরণার।

 

গত বছর সার্জারী বিভাগের শিক্ষকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় চালু করা হলো কতোগুলো স্পেশাল ওয়ান স্টপ পেশেন্ট ডায়াগনোস্টিক অ্যান্ড কেয়ার সার্ভিস। আমরা বলি মিনি ক্লিনিক। যেমনঃ কলোরেকটাল ক্লিনিক, হার্নিয়া ক্লিনিক, ব্রেস্ট ক্লিনিক, ড্রেসিং ক্লিনিক। গত বছরের তথ্য উপাত্ত আমাদের জানিয়ে দিয়েছে মানুষের আস্থার পরিণতি।

কলোরেকটাল ক্লিনিকে আমরা রোগী পেয়েছি ৩ হাজার ৪৩৮ জন।
ব্রেস্ট অ্যান্ড এন্ডোক্রাইন ক্লিনিকে পেয়েছি ৪৭৯ জন।
ড্রেসিং ক্লিনিকে আমাদের সেবা নিয়েছেন ১৮ হাজার ৩৭৭ জন।
আর যে হার্নিয়ার কথা বলছিলাম সেই হার্নিয়া ক্লিনিকে গত বছর আমাদের সেবা নিয়ে গেছেন ১৮ন হাজার ৩৭৭ জন মানুষ।

এই তথ্যগুলো একাধারে যেমন আমাদের হাসপাতেলের বিজয় মুকুটের পালক, অন্যদিকে আমাদের জন্য আরো দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবার মহামন্ত্র। মানুষের রেজপন্স, মানুষের সেবার প্রতি আস্থা আমাদেরকে জানিয়ে দেয়, আমরা সঠিক পথেই আছি। যেতে হবে আরো বহুদূর, আরো সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে হবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে। সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবার ধারাকে সমুন্নত রেখে চলেছি আমরা প্রতি মুহুর্তে।

সার্জারী বিভাগে সরাসরি অধ্যাপক ও সিনিয়র বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে গত বছর মেজর অপারেশন হয়েছে ৩ হাজার ৫৬৫ টি। বলা বাহুল্য ৩৬৫ দিনই সার্জারী বিভাগে মেজর অপারেশন গুলো করা যায় নি। চিকিৎসক ও আনুষাঙ্গিক জনবলের অপ্রতুলতা নিয়ে এবং অন্যান্য বিভাগের সাথে রোস্টার মেইনটেইন করেই অপারেশনগুলো করতে হয়। তদুপরি সার্জারী বিভাগে আমাদের হাতে নিজেদের চিকিৎসার মহান দায়িত্বটি নিশ্চিন্তে তুলে দিয়েছেন ২২ হাজার ৫৯৬ জন, সাথে আছে প্লাস্টিক সার্জারীর ১ হাজার ২৮১ জন, ইউরোলজির ১ হাজার ৬৮৯ জন, নিউরো সার্জারীর ২ হাজার ২৪৩ জন আর অর্থোপেডিক্সের ৪ হাজার ১৯৬ জন।

এগুলো আমাদের কাছে নিছকই সংখ্যা নয়, বরং এক একটি সফলতার গল্প, একটি একটি বিজয়ের উপন্যাস কিংবা দিন বদলের সনদের একটি একটি অক্ষর।

এই মুহুর্তে এক বুড়ি কাকীমার কথা মনে পড়ছে। দেশের বাইরে গিয়েছিলেন চিকিৎসা করাতে। সেখানে সর্বশান্ত হয়েছেন। "পাকস্থলীতে ক্যান্সার"। হয়তো জীবনের শেষ কিছু দিন দেশে কাটাতে চান বলেই তার স্বামীকে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের কাছে।

আমরা দায়িত্ব নিলাম। ৮ নম্বর ওয়ার্ডে রেখে তাকে ডায়াগনোসিস করে অপারেশনের জন্য তুললাম। ভয় হচ্ছিলো। যদি অপারেশন এর পরেও উনি ভালো না হন, বা যদি অপারেশনের সময় দেখি যে ক্যান্সার ছড়িয়ে গেছে আমাদের সাধ্যের সীমানার বাইরে... নাহ... এমন কিছু হয় নি। কাকী মা এখন সুস্থ আছেন। এখন গেলেই হাসি দেন। কাকাও খুব খুশি। "হাসপাতালে থেকে কয়টা করে ডিম পেয়েছেন আজ?" প্রশ্নটা করলেই ফিক করে হেসে দেন।

কোন তথ্য উপাত্তের জন্য না। এই ফিক করে হেসে দেওয়াটুকু দেখতেই কাজ করে যাচ্ছি, আমরা সবাই। এক সুতোয় বাঁধা এক অপার সম্ভাবনার মহাকর্মযজ্ঞ আমাদের এই লাল ইটের হাসপাতাল।

মানুষের ন্যায্য সেবাটুকু মানুষের কাছে পৌছে দিতে চাই।
তার জন্য মানুষের আস্থার, মানুষের সম্মানের, মানুষের ভালোবাসার "পদক" পাচ্ছি প্রতিদিন, রোগীদের হাসিতে।

এই জীবনে আর কী চাই...

=================

Image may contain: 1 person, sitting, eyeglasses and closeup

ডা রাজীব দে সরকার
রেজিস্ট্রার, সার্জারী বিভাগ
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
প্রচার ও জনসংযোগ সম্পাদক, বিএমএ, রাজবাড়ী
আহবায়ক, সুহৃদ সমাবেশ, গোয়ালন্দ।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়