Ameen Qudir
Published:2018-01-29 19:45:01 BdST
হে নারী ডাক্তার, অামার এই গল্পটি একবার পড়ে দেখো প্লিজ !
ডা. শিরীন সাবিহা তন্বী
_____________________________
#মাতৃত্ব
ওর স্বভাব ই অমন ছিল।
তিন বছর চার মাস দুই দিনের বিবাহিত জীবনে সে কম করে হলেও একশ বার বিভিন্ন ভাবে সারপ্রাইজ দিয়েছে আমাকে!এতটা মিষ্টভাষী আর এতটা প্রানোচ্ছল কোন মানুষের সাথে আমার বিবাহ পূর্বের জীবনে দেখা হয়নি!
যেহেতু আমাদের এরেঞ্জড ম্যারেজ ছিল।প্রথম দিকে আমি একটু দোটানায় ছিলাম যা ওর এই ফূর্তিবাজ স্বভাবের কারনে মাসখানেকের মধ্যেই কেটে যায়!
ঐ দিন আমার জন্মদিনের আগের সন্ধ্যা ছিল।বিয়ের পরের দুইটা জন্মদিনেই সে আমাকে ব্যাপক সারপ্রাইজড করেছে।সেদিন সন্ধ্যেবেলা ফোন বন্ধ পেয়ে আমি তাই অবাক হইনি।কিন্তু টেনশন টা বাড়তে লাগল রাত বারোটার পর।যেহেতু ঐদিন বাবার বাসায় ছিলাম,ভাই বোন মাহিন আর মিতি আমার জন্য বার্থ ডে কেক কাটার জন্য অস্থির হয়ে ছিল।ওর ফোন না ধরাতে পুরো বাসায় দুশ্চিন্তার ছায়া পরে।
বাবার বাসার কাছেই একটা ফ্লাটে আমরা থাকতাম!ওর ঢাকার বাইরে অফিসিয়াল ট্যুরের কারনে আমি ঐ সময়ে বাবার বাসায় এসে ছিলাম!যেহেতু ওর ট্যুর মানিকগঞ্জে ছিল,কাছাকাছি!আমি অবচেতন মনে ভীষন ভাবে ওকে উইশ করেছি।
আর ও একটা ব্যাপার ছিল।ঐদিন নিজের জন্মদিনে আমি ও তাকে সারপ্রাইজড করতে চেয়েছিলাম।
প্রতিটা মুহূর্ত বছরের মত লাগছিল।অস্থিরতা সব সীমা অতিক্রম করেছে তখন!
রাত তিনটের পরে কাঁদতে শুরু করেছি।কখন তন্দ্রা এসেছিল জানি না।ঘুম ভাঙল আম্মার চিৎকারে।আমার দেবর এসেছে আমাকে নিতে।সাব্বিরের এক্সিডেন্ট হয়েছে।
না।হাসপাতালে না।সাব্বির ছিল মর্গে লাশ হয়ে।এটা ছিল আমার জন্মদিনের প্রথম সারপ্রাইজ!
দ্বিতীয় সারপ্রাইজ ছিল আমাকে চিরতরে বরবাদ করে দেয়ার।হাই ওয়েতে লংড্রাইভে গিয়ে এই এক্সিডেন্ট।একই গাড়ীতে আরো একটি লাশ।সাব্বিরের অফিস কলিগ অরুনিমা।আমি চিনতাম তাকে!খুব ই সুশ্রী অবিবাহিত হিন্দু মেয়ে।ওর সাথে সাব্বিরের এমন সম্পর্ক আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি কখনও!
এক জন্মদিনে আর সারপ্রাইজ রাখবার জায়গা ছিল না।তবু হলাম।পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট বলেছে অরুনিমা প্রেগন্যান্ট!ওদের দুজনের শরীরেই এলকোহল পাওয়া গেছে!
তার মানে সারমর্ম দাঁড়াল,আমার স্বামী সাব্বির আমাকে প্রতারনা করে অন্য একটি মেয়ের সাথে বিবাহ বহির্ভূত দাম্পত্য সম্পর্ক চালিয়েছে।সেই সম্পর্কে সে বাবা হতে যাচ্ছিল।আর এদিকে আমি তাকে আমার সন্তানের বাবা হবার সুসংবাদটি দিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি।ভাবা যায়!
ওর প্রতারনার বিষয়টি আমি এমন সময়ে জানলাম যখন ও পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে।আমার শরীরের মাঝেই রেখে গেছে ওর ই দূষিত রক্তের সন্তান!
আমি চিৎকার করে কাঁদি।তাকে হারাবার দুঃখে নয়!তার প্রতারনার অপমানে!
আমি আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিকার চাই।বিচার চাই।মৃত মানুষের বিচার হয় না।ওর সন্ততানকে গর্ভেই মারতে চেয়েছি আমি!পারিনি!জন্ম থেকে আমি ঐ প্রতারকের সন্তানের মুখের দিকেও তাকাইনি!
আর এখন আমি ওর এই দুই মাসের শিশুটিকে চিরতরে অরফ্যানেজে দিয়ে দিব,যাতে ঐ প্রতারকের জন্মের বাচ্চাটি চরম শাস্তি পায়!!
শেষের দিকের কথাগুলি বলে হাঁপাচ্ছিলেন তিতলী আপা!আর রাগে দাঁত কিড়মিড় করছিলেন!
মাত্র তিন ঘন্টার ব্যবধান!
তিতলী আপা এখন তার বার্বি ডলের মতো মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ফিড দিচ্ছ!হাউমাউ করে কাঁদছে!
আমি অরিন!
সাইকোলজির ছাত্রী।অনার্স ফাইনাল দিয়ে বাড়ীতেই ছিলাম।এক সকালে হলের জুনিয়র কাঁদতে কাঁদতে বাসায় হাজির।মিতি এই গলির মাঝে আমার ভাড়া বাসা কিভাবে খুঁজে পেল জানি না।
মিতি আমাকে জানাল ওর বিধবা বড় আপু তার পিতৃহীন সন্তানটিকে অফিসিয়াল ডেকোরামে এক ওরফানেজে দিয়ে দিচ্ছে।ফার্ষ্ট ইয়ার থেকেই আমি যেহেতু হলে টুকটাক সকলকে সাইকোথেরাপী দিয়ে থাকি।ও তাই আমার কাছে ওর আদরের ভাগ্নিটাকে এই বিপদ থেকে বাঁচাতে এসেছে!
আমি মুহূর্তকাল সময় নষ্ট না করেই চলে এসেছি।
আপা তার মেয়ের জন্মের পর থেকে তার মুখের দিকেই তাকায়নি।আজ ওকে নিজের থেকে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছিল ওর প্রতারক বাবার প্রতি প্রতিশোধ নিতে!এর থেকে অমানবিক কি হতে পারে!
আমি টুপটুপ কে জোড় করে তার কোলে দিলাম।টুপটুপ ঠা ঠা করে চিৎকার শুরু করল!
আপার পায়ে গড়িয়ে পড়ল।হাত বাড়িয়ে ধরল আপা।কোলে নিয়ে চাপর দিতেই টুপটুপ থেমে গেল।সন্তানের মুখের দিকে তাকাতেই আপার দুচোখে অশ্রু বন্যা বইতে লাগল!
আমি খুব আস্তে করে বলতে লাগলাম,অন্যায় করেছেন সাব্বির সাহেব।টুপটুপের শরীরে সাব্বির সাহেবের কেবল কিছু কোষ আছে।সে আপনার শরীরে আপনার রক্ত প্রবাহে বেড়ে উঠেছে।এই শিশুটি স্বর্গ থেকে এসেছে।নিষ্পাপ!
তার মৃত বাবার পাপের শাস্তি সে কেন ভোগ করবে?বরং সে আপনার শিক্ষা আদর্শে একজন সৎ দায়িত্ববান মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে।
টুপটুপের কান্না হাসি স্পর্শে আপা যেন প্রথম বার সন্তান জন্মের দু মাস পর মা হিসেবে জন্ম নিলেন!
সন্ধ্যালগ্নে আমি বাড়ী ফিরছিলাম।
বড় আপুর আত্মহত্যার দিনটি বড্ড বেশী করে মনে পড়ল!চোখ জ্বালা করছে।বাবার পছন্দে গার্মেন্টস মালিকের ছেলের সাথের বিয়েটা আট মাসের মাথায় ভেঙেছিল বড় আপুর।
এরপর বিয়ে হলো এক সরকারী কেরানীর সাথে।চার বছরে এত বকা এত মার আপু ঐ পাষন্ডের হাতে খেয়েছে যে ওকে আমার আর মানুষ বলে মনে হতো না।
এইটুকু সময়ে আবার দুটো বাচ্চা।একটা ছেলে একটা মেয়ে!
এত মেরেও স্বামী ঘর থেকে তাড়াতে পারল না ওরা আপুকে।শেষদিকে আপু অনেক কাঁদবার পর ও বাবা আনতে গেলেন না।
তখন আমি ক্লাস টেন এ পড়ি।দুলাভাই একদিন তার এক মামাতো বোনকে বিয়ে করে নিয়ে এলেন।ঐ রাতেই নিজের ঘর নতুন বউকে ছেড়ে দিয়ে খাবার ঘরে ফ্যানের সাথে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করল বড় আপু।
আমরা কেউ ঐ হতভাগীকে বাঁচাতে পারলাম না!
অনেক কেঁদেছি!অনেক!বোবা কান্নায় ছটফট করতে করতে আমি সেদিন ঐ কিশোরী বয়সেই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম,ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিষ্ট হবো।
নিজের বোনকে আত্মঘাতী হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারলাম না।বোনের দুটো এতিম বাচ্চা আমাদের অভাবের সংসারে ভাড়া বাসার বারান্দায় তোতা পাখির মতো বেড়ে উঠছে!ওদের শৈশবে শখ নাই,রং নাই,আনন্দ,খুশি নাই!স্নেহ,আদর দেবার ও কেউ নাই!
কেবল খানিকটা ডাল ভাত খেয়ে পথশিশুর মত বড় হচ্ছে।
আপারে!
কোথায় হারিয়ে গেলি?ঐ পাষন্ডের জন্য নিজের সন্তানদের মাতৃহারা করলি?স্নেহবঞ্চিত করলি?
ওদের বাবা তো দিব্যি সুখের সংসার করছে!অনিক রিনি উদাস দৃষ্টিতে আজ ও তাদের মাকে খুঁজে বেড়ায়!
আত্মহত্যা,সঙ্গীর দোষে সন্তানের উপর অত্যাচার কোন মায়ের জন্য সঠিক পথ নয়।মাতৃত্ব কোন ছেলেখেলা না!একটা দায়িত্ববোধের নাম।আর এটাকে অস্বীকার বা অবহেলার কোন সুযোগ কোন মায়ের নাই!
_______________________________
ডা. শিরীন সাবিহা তন্বী
মেডিকেল অফিসার,
শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল।
আপনার মতামত দিন: