Ameen Qudir

Published:
2017-12-23 18:13:03 BdST

মুক্তিযোদ্ধারা মহানায়ক, খলনায়ক নন


 

 

 

 

 

 

ডা. এনামুল হক চৌধুরী
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ
মেমন মাতৃসদন হাসপাতাল
চট্টগ্রাম।
___________________________


""'হিন্দুর রক্ত সবুজ আর মুসলমানের রক্ত লাল। আওয়ামীলীগ ভারতের দালাল এবং হিন্দুদের দল, মুসলমানের নয়। একজন নেতা সম্পর্কে বলা হত
তিনি ব্রাহ্মণের ছেলে। মুসলমানের ঈমান - আকিদা রক্ষার জন্য তাকে হত্যা করা ফরজ ছিল। আর আমাদের গ্রামের মুদিদোকানী নজু মিয়া প্রকৃত মুসলিম নয়। কারণ সে মসজিদে নামাজ পড়ে না। আর তাই, সে আওয়ামীলীগের পক্ষে এবং শেখ মুজিব হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলে।""'' - এই ছিলো আমাদের প্রজন্মের (১৯৭৫ পরবর্তী প্রজন্ম) ছোট বেলার ইতিহাসের পাঠ।

 

বাড়ির পাশে বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের সামনে বিশাল মাঠ আর পিঁছনে খাল। বিকেলে মাঠে খেলা-ধুলা আর খালে লাফালাফি আমাদের প্রতিদিনের রুটিন কাজ। বিদ্যালয়ের ডান পাশ ঘেঁষে চলে গেছে মেটো পথ। তার ডান পাশে ফসলি জমি। জমি পার হলে বিশাল পুকুর। পুকুরের পাড়ে ঘন গাছ-পালা, দেশী ফল-ফুলের। জমি এবং পুকুরকে সমান দু'ভাগে বিভক্ত করে চলে গেছে ছোট্ট একটি রাস্তা। শেষ হয়েছে উঠোনে। উঠোন পার হলে পাশাপাশি তিন/চারটি মাটির ঘর। প্রত্যেক ঘরে হিন্দুরা বসবাস করেন। এই বাড়ির ছেলে তপন মালাকার। কলেজে পড়েন। একদিন তপন দা খালপাড়ে দুই/তিন জন লোক নিয়ে হাজির। তাঁদের গাছ থেকে ডাব নামাবেন। বুঝতে পেরে আমরা ক'জন দাদার পিঁছু নেই। ছোটদের আবদার রাখতে গিয়ে দাদা দা নিয়ে নিজেই ডাব কাটছেন। এবং বিপত্তিটা তখনই ঘটলো। দাদার হাত কেটে গেছে! তাঁর আঙ্গুল থেকে রক্ত ঝরছে। মুশকিল হচ্ছে, এই রক্ত লাল! কিন্তু হিন্দুর রক্ত তো সবুজ হওয়ার কথা...!

 

 

বিদ্যালয় থেকে আমাদের বাড়ি দেড়-দুই মিনিটের পথ। বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মেটো পথটি আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। সেই পথ ধরে মিনিট দুই-তিন হাঁটলেই রেলরাস্তা। রেলরাস্তার এপাড়ে একটি চা'র দোকান, ওপাড়ে ক্ষ্যাপাটে নজু মিয়ার মুদি দোকান। তাঁকে ক্ষ্যাপানোর সব চেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, শেখ মুজিব কিংবা আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে কিছু বলা। তখন খুব রেগে যান এবং অশ্রাব্য-অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন, লাঠি হাতে তেড়ে আসেন। যদিও এমনিতে তিনি খুবই শান্ত প্রকৃতির মানুষ। ঘরের প্রয়োজনে তাঁর দোকানে রোজ দুই-একবার যেতে হয়। আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগা প্রশ্নগুলো তাঁর কাছে রাখি। তিনি ধীরে ধীরে আমার ছোট্ট মাথায় লেগে যাওয়া জট গুলো খুলে দেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার...।

মুক্তিযোদ্ধা হাফেজ বজল আহমেদ। আমার চাচা। জীবীকার প্রয়োজনে বেশীর ভাগ সময় গ্রামের বাইরে থাকেন। তাঁর নাগাল পাওয়া যায় না। বাকী থাকলো আব্দুল মোনাফ ভাই। জীর্ণ কাপড়, শীর্ণ শরীর, মলিন মুখ...! বরশি আর বদনা নিত্য সঙ্গী। মাছ ধরেন। হেঁটে হেঁটে এ বাড়ি ও বাড়ি বিক্রি করেন। বিদ্যালয়ের পিঁছনের খালেও প্রায় আসেন। কোনো কোনো দিন খালে লাফালাফির এক ফাঁকে দলছুট হই। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চাই। তাঁর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। জীবন যুদ্ধে কিংবা বলা যায় সামাজিক-রাষ্ট্রীয় যুদ্ধে পরাজিত মানুষটার ভিতর থেকে মুহুর্তেই একটি হৃষ্ট-পুষ্ট বাঘ হুংকার দিয়ে বের হয়ে আসে যেন বা...। কথা আসে রাজাকার হারুন মিয়ার। বাঙ্গালির বিজয়ের পর গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান। ১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অবশ্য বীরদর্পে ফিরে এসেছেন! এখন বুক ফুলিয়ে হাঁটেন! মৎস্যজীবী মোনাফ ভাই এবং বাংলাদেশের তাবৎ মুক্তিযোদ্ধা আমার কাছে নায়ক থেকে মহানায়কে পরিণত হন। আর হারুন মিয়া ও সকল স্বাধীনতাবিরোধীর জন্য তৈরি হয় এক রাশ ঘৃণা।

 

তার পর এই দেশে অনেক কিছু হয়ে গেল। প্রকৃতির নিয়মে ১৯৭১ এবং ১৯৭৫ এর খুনিদের বিচার হলো। বাঙ্গালি জাতি অভিশাপ মুক্ত হলো। ইতিহাসের দেনার দায় মেটালো বাংলাদেশ। কিন্তু, বন্ধ হলো না মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় অপমান- অবমাননা! সামরিক সরকার এবং তাদের গঠন করা দলের সরকার গুলো কর্তৃক রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মাধ্যমে! আর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে অতি মূল্যায়ন করা বা বাড়াবাড়ি রকমের তথাকথিত সম্মান জানানোর নামে!

এখন বাংলাদেশে সব চেয়ে লাভজনক পদ-পদবি হলো 'মুক্তিযোদ্ধা'। আর তাই, ষাটোর্ধ্ব অনেক প্রবীন এখনো ঘুরছেন একটি মুক্তিযোদ্ধার সনদের আশায়। এটা পেলেই অনেক কিছু পাওয়া হবে। মাসিক ভাতার বন্দোবস্ত আছে। আছে আরও নানান পার্থিব সুযোগ-সুবিধা। সন্তান ও নাতি-পুতিরাও বঞ্চিত হবে না। পরিণামে আজ অনেক রাজাকারও বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধার সনদ যোগাড় করে ফেলেছেন! ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার ছড়াছড়ি! আর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই- বাছাই কমিটির বিতর্কিত সব কার্য্যক্রম তো খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায়। এই মুহুর্তে আমার সামনে থাকা একটি মাত্র জাতীয় দৈনিক 'প্রথম আলো' তে প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদ শিরোনাম উল্লেখ করতে চাই। ১. মুক্তিযুদ্ধের ৯ বছর পর জন্ম নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা! (২২ নভেম্বর ২০১৭)।

 

২. অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর চেষ্টা (০৭ নভেম্বর ২০১৭)। ৩. মুক্তিযোদ্ধা যাচাই- বাছাই নিয়ে জগাখিচুড়ি। শতাধিক কমিটির সদস্যদের নিয়ে অভিযোগ (৩০ জানুয়ারি ২০১৭)। ৪. বাছাই কমিটির সদস্য মৃত ব্যক্তি! মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তকরণ (২২ জানুয়ারি ২০১৭)। ৫. দালাল আইনের আসামির মুক্তিযোদ্ধা সনদ! মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি চাকরি পেয়েছেন দুই সন্তান (২৬ অক্টোবর ২০১৬)।

 

আমাদের মৎস্যজীবী মোনাফ ভাই মুক্তিযুদ্ধে গেছেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে, কোনো বড় অফিসের বড় কোনো কর্মকর্তা হওয়ার জন্য নয়। কোনো বিদ্যালয়ের দপ্তরী মুক্তিযুদ্ধ করেছেন সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হওয়ার লোভে পড়ে নয়, তাঁর ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য। সব চেয়ে বড় কথা, দেশ হলো মায়ের মতো। শৃঙ্খলিত মাকে মুক্ত করার দায়িত্ব তো সন্তানের। মাকে মুক্ত করার বিনিময়ে সন্তানকে কেন ভাতা দিতে হবে, পদক দিতে হবে? তাঁর সন্তান-সন্ততি, নাতি-পুতিদের ইবা কেন এতো এতো কোটাভুক্ত করতে হবে! সংখ্যা গরিষ্ঠ সাধারণ জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে তাঁদের! বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে এই সবের সুযোগ নেওয়ার মতো রাজনৈতিক দলের অভাব পড়েছে বুঝি?

 

মুক্তিযুদ্ধের পরের দুই-আড়াই দশক দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের এবং শহীদ পরিবার গুলোর খানিকটা সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তখন কেউ এগিয়ে আসেননি; না ব্যক্তি, না সমাজ, না সরকার, না রাষ্ট্র! উল্টো তাঁরা অসহ্য মানসিক যন্ত্রনার শিকার হয়েছেন। কারণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চিহ্নিত রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ সহ ১৯৭১ এবং ১৯৭৫ এর খুনিদের পুনর্বাসিত করা হয়েছে! রাষ্ট্র-সরকারের শীর্ষ পদে পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বসানো হয়েছে!

 

কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা এবং শহীদ পরিবারের সন্তানেরা নিজ প্রচেষ্টায় এখন দাঁড়িয়ে গেছেন। নতুন করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করে সনদ প্রদানের মাধ্যমে কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে অহেতুক বিতর্ক তৈরি করার কোনো প্রয়োজন ছিল কি না, তা সময় বলবে। কিন্তু চলতি পথে, সরকারের এই কার্য্যক্রমের সমালোচনা করতে গিয়ে বেশির ভাগ মানুষ যখন আমার মহানায়কদের খলনায়কের স্তরে নামিয়ে ফেলেন এবং প্রতিবাদ করার মতো কোনো যুৎসই যুক্তি খুঁজে পাই না, তখন ব্যথায় মনটা ভরে উঠে।

কারো প্রতি অনুরাগ- বিরাগ না দেখিয়ে সমতার ভিত্তিতে দেশের সকল মানুষের উন্নয়ন করা ইতো মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। অহেতুক বিতর্ক তৈরি না করে এই প্রকল্পের টাকাটা বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নেও তো ব্যবহার করা যায়। বেহিসেবী- কান্ডজ্ঞানহীন পুরুষের মনোরন্জনের ফল হলো পথশিশু। এই শিশুদের জন্য আশ্রম তৈরি করা জরুরি। এর মাধ্যমে দক্ষ কর্মীর হাত বানিয়ে এই পথশিশুদের সমাজের মূল স্রোতে ঢুকানো সম্ভব। জন্ম নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ আবার পিঁছিয়ে পড়ছে। সেখানেও তো অনেক টাকা প্রয়োজন।

 

হাতে গোনা ক'জন কুলাঙ্গার ছাড়া বাংলাদেশের সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন। আর তাই, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করার চেয়ে বেশি জরুরি স্বাধীনতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা করা। এবং এখনই তার শ্রেষ্ঠ সময়।

পুনশ্চঃ উপরোল্লিখিত প্রত্যেকটি চরিত্র কাল্পনিক। কারও সঙ্গে মিলে গেলে তা কাকতাল মাত্র।

 

______________________


ডা. এনামুল হক চৌধুরী

[email protected]

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়