Ameen Qudir
Published:2017-12-21 18:54:08 BdST
এইডস প্রতিরোধ :শঙ্কা ও সম্ভাবনা
সুমিত বণিক,
জনস্বাস্থ্যকর্মী
_______________________
এইডস একটি ভয়ানক ব্যাধি।১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি (সেন্টার অব ডিজিস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশান)এই রোগ প্রথম সনাক্ত করে। অবশেষে ১৯৮৪ সালে ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা এই মহামারী রোগের ভাইরাস শনাক্ত করেন। ফ্রেঞ্চ বৈজ্ঞানিকরা এর নাম দেয় লিম্ফাডেনোপ্যাথি এ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাস (ল্যাভ)আর যুক্তরাষ্ট্র এর নাম দেয় হিউম্যান টি-সেল লিমফোট্রোফিক ভাইরাস, স্ট্রেইন-থ্রি (এইচটিএলভি থ্রি)।১৯৮৬ সালে এই ভাইরাসের পুনঃ নামকরণ হয় হিউম্যান ইমিউনো ডিফেসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি)।
এইচআইভি ভাইরাস মানুষের শরীরের টি-হেলপার সেল কে আক্রান্ত করে যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে পুরো দূর্বল করে দেয়। এইডস এখন বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়েছে। ২০০৭ সালে শুমারি অনুযায়ী বিশ্বব্যাপি আনুমানিক ৩৩.২ মিলিয়ন মানুষ এইডস এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে যার মধ্যে ৩৩০,০০০ জন ছিলো শিশু।এর ত্রি-চতুর্থাংশ মৃত্যুই ঘটেছে আফ্রিকার সাব-সাহারান অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধি অঞ্চলে।
বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম এইডস রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়। এইচআইভি-র কারণে সৃষ্ট এই রোগের ফলে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে একজন এইডস রোগী খুব সহজেই যে-কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন, যা শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু ঘটাতে পারে। বেশীর ভাগ এইচআইভি রোগীই কোন লক্ষন ছাড়া এই রোগ বহন করে। তবে কখনো কখনো এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবার ৬ থেকে ৬ সপ্তাহ পরে কিছু অনির্দিষ্ট লক্ষন দেখা দিতে পারে যেমন জ্বর, গলা ব্যাথা, মাথা ব্যথা,লসিকাগ্রন্থি বড় হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এইসব লক্ষন কোন রকম চিকিৎসা ছাড়াই সেরে যায়, যার কারণে রোগী এ ভাইরাস সম্পর্কে অবগত হয়না।
এইচআইভি কোনরকম লক্ষন ছাড়াই সর্বোচ্চ ১০ বছর মানুষের শরীরে নিরবে বাস করতে পারে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের কোথাও কোথাও এইচআইভি ভাইরাস বা এইডস রোগে আক্রান্তদের এখনও একঘরে করে রাখা হচ্ছে। চিকিৎসা নিতে গিয়ে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তাঁরা। প্রচলিত ধারণা ও কুসংস্কারের কারণে এ রোগের জন্য আজও দায়ী করা হচ্ছে, হেয় করা হচ্ছে তাঁদের।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে এইডস রোগীর সংখ্যা নিয়ে শঙ্কিত কক্সবাজারের স্বাস্থ্য বিভাগ। তথ্যানুযায়ী ইতোমধ্যে ১৯ জন এইডস রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন মারা গেছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ধারণা, রোহিঙ্গাদের মধ্যে আরও অনেক এইডস রোগী থাকতে পারে। এইডস নিয়ে ঝুঁকির তালিকায় থাকা দেশগুলোর মধ্যে মিয়ানমারের অবস্থান অনেক ওপরে। দেশটিতে ২ লাখ ৫০ হাজারের বেশি এইডস রোগী রয়েছে।
তাঁদের মতে, এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিদের দ্রুত চিহ্নিত করা না গেলে বাংলাদেশে এই রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। গত বছর জাতীয় এসটিডি/এইডস কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর রক্তের নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে (সেরোলজিক্যাল সার্ভেল্যান্স) প্রাপ্ত এক জরিপ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে এইচআইভি আক্রান্ত ১২০০০ জন, সুই-সিরিঞ্জের মাধ্যমে শিরায় মাদক গ্রহণকারীর সংখ্যা ৩৩০৬৬ জন। এখনো সেবার বাইরে আছে ৭২ শতাংশ মানুষ বা ২৩৮০৮ জন। যা একটি দেশের সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য কখনোই মঙ্গলজনক তথ্য নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা'র মতে, একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ৫ শতাংশের মধ্যে এইচআইভির সংক্রমণ দেখা দিলে পরিস্থিতিকে ‘কনসেনট্রেটেড এপিডেমিক’ বা ‘ঘনীভূত মহামারি’ বলে। তাদের মতে, এ পরিস্থিতিতে সংক্রমণ অতি দ্রুত ওই জনগোষ্ঠীর অন্য সদস্যের পাশাপাশি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীতেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সংঙ্কট নিয়ে জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের অভিমত, রোহিঙ্গারা একেবারেই স্বাস্থ্যসচেতন নয়। তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ানো দরকার। নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে রেখেই তাদের পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। আর তখন উদ্ভুত ঐ পরিস্থিতি টেকনাফ ও উখিয়াসহ পুরো কক্সবাজারের মানুষের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করবে।
একটা সময় ছিল যখন এইডস রোগের নাম শুনলেই মানুষ ভয় পেত৷ এখন সেই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে৷ বাংলাদেশে এইডস প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলো কাজ করছে। আশার কথা হচ্ছে, সরকার ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে এইচআইভিমুক্ত দেশে পরিণত করতে পরিকল্পনা নিয়েছে৷ এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এইচআইভি টেস্টিং অ্যান্ড কাউন্সিলিং, আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য পজেটিভ লিভিং কাউন্সিলিং, পুষ্টি, চিকিৎসা এবং কাউন্সিলিং-এর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে৷ স্থাপন করা হয়েছে ন্যাশানাল এইডস কন্ট্রোল সেন্টার। সেই সাথে আশার আলো সোসাইটি, মুক্ত আকাশ বাংলাদেশ কনফিডেনশিয়াল অ্যাপ্রোচ টু এইডস প্রিভেনশন (ক্যাপ) নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান এইডস আক্রান্তদের ‘অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল’ বা এআরভি ওষুধ সহ অন্যান্য সেবা দিচ্ছে৷ সরকার ও এই তিন সংস্থা ‘দ্য গ্লোবাল ফান্ড’-এর কাছ থেকে ওষুধ কেনার অর্থ পাচ্ছে ৷
সর্বোপরি এ সমস্যা মহামারি আকারে দেখা দেওয়ার আগেই এ বিষয়ে অভিজ্ঞ সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এই প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই সাথে মাদক ও এইডস এর ভয়াবহতা এবং কুফল সম্পর্কে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীদের (যৌনকর্মী, হিজড়া, সমকামী, কয়েদি)মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে নিতে হবে ব্যাপক কর্মসূচি। সরকার ও সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের উপর এ হুমকী ও সংঙ্কটাবস্থার উত্তরণ ঘটানো সম্ভব বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, কারণ বাংলাদেশ সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রয়াসের মাধ্যমে ইতোমধ্যে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এ ধরণের হুমকী মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অর্জন করেছে। শুধু প্রয়োজন সঠিক সময়ে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ এবং এর কার্যকর বাস্তবায়ন।কারণ এইচআইভির সংক্রমণরোধ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়!
__________________________________________________
সুমিত বণিক,
জনস্বাস্থ্যকর্মী, ঢাকা।
[email protected]
আপনার মতামত দিন: