Ameen Qudir

Published:
2017-10-05 21:43:26 BdST

ডাক্তারদের গালাগালি বন্ধ করেই দেখুন,তাতে আপনাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি হবেনা





ডা. মিথিলা ফেরদৌস

______________________________________

ইন্টার্নির সময় একজন হুজুর মুরব্বির পায়ের বিশাল ড্রেসিং করতাম।যদিও আমার প্লেসমেন্ট ছিলো ফিমেলে।তবুও অনুরোধে ঢেকি গেলার মত পুরুষ ওয়ার্ডের কয়েকটা ড্রেসিং আমাকেই করতে হতো।এরমধ্যে মুরুব্বি একজন।চাচা আমার জন্যে ড্রেসিংএর জিনিস সাজায় নিয়ে বসে থাকতেন।আমি গেলে খুব খুশি হতেন।

 

ড্রেসিং এর নিয়ম একটু রাফ ভাবে পরিষ্কার করা।ছেলেরা সেই নিয়মেই করতো কিন্তু আমি বেশি রাফ করতে খারাপ লাগতো,তখন বয়স কম ছিল।মনে হতো আহা বেচারাকে কষ্ট দেয়ার দরকার কি?প্রতি ড্রেসিংয়েই চাচা আমাকে হাত তুলে দোয়া করতেন।আমার সি এ, আই এম ও ভাইয়ারা বলতেন,'চাচা হুজুর মানুষ, মিথিলাকে বেহেস্তে হুরদের সর্দার বানায় দিবে।'খুব রেগে যেতাম আমি এই কথা বললে। চাচার যেদিন ছুটি নিয়ে চলে যায়,সেদিন সন্ধানীর কাজে আমি ঢাকায়।উনি নাকি আমাকে অনেক খোজাখুজি করেছিলেন। সার্জারি ইন্টার্নি শেষে আমার যখন মেডিসিনে প্লেসমেন্ট হয়,তখন ওই ওয়ার্ডে সবাই বলতো,'মিথিলা একজীবনে অনেকের দোয়া নিয়ে গেলো এই ওয়ার্ড থেকে।'

 

ট্রেনিং পিরিয়ডে আমার ইউরোলোজিতে প্লেসমেন্ট দুই মাসের জন্যে,রংপুর মেডিকেলে তখন নতুন ইউরোলজি ডিপার্টমেন্ট খুলেছে।ওখানকার স্যারেরা আমার রুমে একটা আলমারি দিয়ে বললেন,পুউর ফান্ড বানাও,ইন্টার্নির সময়েও আমি পুউর ফান্ড চালায় আসছি।সেইভাবেই ওটিতে বেছে যাওয়া জিনিস নিয়ে শুরু করলাম নতুন করে ফান্ডের কাজ।গরীব রুগীরা কিনতে পারেনা তাদেরকে ওখান থেকে সেট,স্যালাইন ইত্যাদি দেয়া হতো।
একদিন এক বৃদ্ধ ভর্তি হলো,সংগে তার বউ,সেও অনেক বয়স্ক আর কেউ নাই সাথে।মুত্রথলিতে ক্যান্সার।

প্রচুর রক্তক্ষরনে লোকটা পুরাই রক্তশুন্য।জিজ্ঞেস করলাম,
--কি করেন চাচা?
--ভিক্ষা করোং মাও।
--ছেলে মেয়ে নাই?
--আছে,কায়ও খোজ নেয় না।
মনের মধ্যে কেমন জানি কষ্ট হতে লাগলো।সুগম ভাইয়া(স্যার বলা উচিৎ এখন এসোসিয়েট প্রফেসর),তখন এসিসটেন্ট প্রফেসার ছিলেন।খুব মায়া করতেন রুগীদের।আমাকে বললেন,
--এই রুগী সেটেল করার দায়িত্ব তোমার।তার এনিমিয়া,নিউট্রিশন কারেকশন, তার ঔষধ ম্যানেজ সব তোমাকেই করতে হবে।ভাইয়া সেই ইন্টার্ন থেকেই আমাকে চিনতেন তাই হয়তো ভরসা করতেন।বকাও দিতেন ফাঁকিবাজি করলে।
আমি দায়িত্ব নিলাম।রক্ত দরকার,সন্ধানীতে প্রায় রক্ত দিতাম।সৌভাগ্যক্রমে বৃদ্ধ চাচার সাথে আমার গ্রুপ মিলে যাওয়ায় নিজেই রক্ত দিলাম,আরেকটা রক্ত ওদের থেকে অপারেশনের সময়ের জন্যে আমার সন্ধানী কার্ড দিয়েই নিলাম।


সিস্টারদের চাচার জন্যে ডায়েট ঠিকমতো এনশিউওর করলাম আর দুই তিনটা কম্পানীর কাছ থেকে ওটির ঔষধ কিনে নিলাম।চাচার অপারেসানের আগেই আমার ইউরোলোজি প্লেসমেন্ট শেষ হয়ে,আমি নিউরোসার্জারিতে চলে যাই।

প্রায় ছয় মাস পর আবার যখন আমার নিজের ওয়ার্ডে মানে,জেনারেল সার্জারিতে কাজ করছিলাম তখন একদিন,সেই চাচা চাচীকে হটাৎ দেখি আমার ওয়ার্ডেই ভর্তি।আমি চিনতে পারিনি।এত রুগীর মধ্যে চেনার কথা না।আমাকে দেখে চাচী দৌড়ে এসে হাত ধরে বললেন,

---মাও তোমাক হামরা কত খুজোছোং,মাও তোমারা কোনা হামার ছাওয়ালের মত।হামার বুড়াকোনাক একনা দেখো কেনে।
চাচা বেড পায়নি ফ্লোরে।ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ।অপারেসান,কেমো পেয়ে এতদিন ভাল ছিল।এখন আবার খারাপ অবস্থা।ওখান থেকে ছুটি হবার পর আবার ভিক্ষা করে খেতে হইছে।বেচারা শরীরে কুলাইতে পারেনি কাছে গেলাম।চাচা ফ্লোরে একটা বিছানায় শুয়ে।আমি কাছে যেতেই পায়ে হাত দিতেই,আমি বসে পরে হাত সরিয়ে দিয়ে,মাথায় হাত দিয়ে বললাম,'কি কষ্ট হয় চাচা?'উনি কোন কথা বলতে পারে না চোখের পানিতে অনেক আকুতি।মনটা হটাৎ খারাপ হয়ে যায়।কেন এই সমাজে এত অসংগতি? কেন ছেলে মেয়েরা এমন বৃদ্ধ বাবা মা রেখে চলে যায়?পকেটে যা ছিলো,চাচীর হাতে দিয়ে বললাম,'চিন্তা করেন না আমি আছি মা'।


এরপর মাঝে মাঝে খোজ নিতাম,একদিন দেখি কে জানি ছুটি দিয়ে দিয়েছে।আসলে করার কিছু ছিলো না।তাই হয়তো ছুটি দেয়া হয়েছে।কিন্তু বেচারারা এখানে থাকলে ভালমন্দ কিছু খেতে তো পারতো।কিন্তু নিয়ম তো নিয়ম।করার কিছুই নাই।

দুইটাই উদাহরণ দিলাম।এমন অসংখ্য উদাহরণ আমার জীবনে আছে,শুধু আমার না সব ডাক্তাদের জীবনে কম বেশি আছে।বেশি উদাহরণ দিলে নিন্দুকেরা বলবে,নিজের গুন গাইতেছে।আসলে নিজের গুন গাওয়াটা এখানে আমার উদ্দেশ্য ছিলোনা।আমি এখন আর সেই মিথিলাও নাই।কারণ বলি।কাল এক পেজে এক ডাক্তার সাহেবের লেখাকে উদ্দেশ্য করে,দেখলাম অসংখ্য কমেন্ট,ডাক্তারদের গালাগালি করে।আমি এমন দেখতে দেখতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি।প্রতিনিয়ত গালি খেতেও অভ্যস্ত।আস্তে আস্তেই আমার পরিবর্তন হচ্ছে।হবে এইটাই কিন্তু স্বাভাবিক।আমাদের মিডিয়া গুলো প্রতিনিয়ত আমাদের ডাক্তাদের ব্যাপারে বিষিয়ে তুলছে জনসাধারণকে যার ফল হচ্ছে,ডাক্তারা মানবিক হতে চাইলেও পারেনা।কারণ একটু চিন্তা করে দেখুন আমরাও কিন্তু মানুষ। প্রতিনিয়ত গালি খেতে খেতে আমাদের মধ্যেও পরিবর্তন চলে আসতেই পারে।আর আমি এইটাও বিশ্বাস করি,সন্মান দিলে,একজন খারাপ ডাক্তারও ভাল হতে বাধ্য।কারণ ওই একটাই।সেইটাও মানুষ বলেই।ডাক্তারদের গালাগালি বন্ধ করেই দেখুন,তাতে আপনাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি হবেনা কথা দিলাম।


_____________________________

ডা. মিথিলা ফেরদৌস, ঢাকা ।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়