Ameen Qudir

Published:
2017-08-22 21:05:04 BdST

খারাপ রুগী ক্লিনিক বা চেম্বারে না নিয়ে সরাসরি সরকারী হাসপাতালে নিন


 


ডা. মিথিলা ফেরদৌস

____________________________

প্রথম কেস:
বাসার পাশের ক্লিনিক থেকে একদিন সন্ধ্যায় ফোন,'ম্যাডাম খুব খারাপ রুগী যদি একটু দেখে দিতেন ভাল হতো'।সন্ধ্যায় সাধারণত কোথাও যাই না।কিন্তু খারাপ রুগী শুনে গেলাম।গিয়ে দেখি,রুগীর সাথে ৩/৪ জন আসছে।বরিশাল এর কোন গ্রাম থেকে আসছে।রুগী ওটিতে।রুগীর ডান পা,পলিথিন দিয়ে বাধা।পলিথিনের ফাক দিয়ে নাটা পোকা বের হয়ে আসতেছে।এই পোকা আমার ভীষন ঘৃনা লাগে।কিন্তু করার কিছু নাই,ওয়ার্ড বয় পলিথিন খুলে দিলো।পুরা পা দগদগা ঘা।ক্লিনিকের লোকদের বললাম,'এই কেস কেন নিলেন?কেন মেডিকেলে পাঠালেন না'?কিছু বলেনা।আরেক টা এমন কেস পেয়েছিলাম,তাই তার্পিন তেলের কথাটা মাথায় ছিলো,তেল আনতে পাঠালাম।আমি ওয়াস নিয়ে, এক সিস্টার নিয়ে কাজ শুরু করলাম।


নরমাল স্যালাইন দিয়ে ধুয়ে দিতে পুরা পায়ের অবস্থা দেখলাম,ফুটা ফুটা হয়ে পচে গেছে।ফুটাগুলো দিয়ে পোকা বের হচ্ছে আর দুর্গন্ধ।ফাসা গুলা কাটা দরকার।কিন্তু লোকটা বয়স্ক,আর রক্ত স্বল্পতা আছে।বললাম রক্ত দিতে।এতগুলা লোক কেউ রক্ত দিবে না।কি করা ফুটা গুলা ফালা ফালা করে কাটতেই হলো।তেল দিলাম।কিছুক্ষন অপেক্ষা করে,হাইড্রোজেন পারোক্সাইড,পোভিসেপ আর ইউজল দিয়ে অনেক ধৈর্য ধরে পরিষ্কার করে,ব্যান্ডেজ করে দিলাম।লোকগুলো অবস্থা দেখে বেশ গরীব মনে হলো,ক্লিনিকে বললাম,আমার কোন বিল না রাখতে।কিন্তু অবশ্যই রুগী হাসপাতালে পাঠানোর ব্যাবস্থা করা হয় যেনো।

আমি জানি ক্লিনিক তার বিল ছাড়বেনা।হয়তো চেষ্টা করবে আরও কিছুদিন ধরে রাখতে। কি হবে ভাবতে ভাল লাগতেছিল না।
একটা লোকের পায়ে পোকা আসার স্টেজ একদিনে হয়নাই।এতদিন গ্রামে কোয়াক, কবিরাজ,পারিবারিক অবহেলা, অযত্ন,অপরিচ্ছন্নতা এর কারণ। শেষে ক্লিনিকেও আসছেও দালালের মাধ্যমে।

 

দ্বিতীয় কেস:
ট্রেনিং পিরিয়ডে থাকতে এক রুগী আসলো বেড শোর বা ডিকিউবিটাস আলসার নিয়ে।দেখে অবস্থাপন্নই মনে হয়।পুরা পিঠ পচায় আনছে।উঠলো পেইং বেডে।সংগে দেখাশুনার জন্যে পেইড একজন,তার তেমন দায় নাই।সে দিব্যি ঘুরে বেড়াতো।ছেলে মেয়েরা কেউ কেউ বিকেলে দেখতে আসতো নাকে হাত দিয়ে।প্রথম প্রথম আমাদের এইসব ড্রেসিং করতে হতো।প্রতিদিন তার পিঠের পচা অংশ একটু একটু করে কেটে আসতে হতো।লোকটা খুব কষ্ট পেত।বার বার সংগের লোকটাকে তার পজিশান চেঞ্জ করতে বলে আসতাম। কোন লাভ হতোনা।টাকা দিয়ে রাখা একটা লোকের কতটা দায় থাকতে পারে?যেখানে আপনজনদের কোন দায় ছিলোনা।

অনেক দিন বলেছি রক্ত লাগবে সেই ব্যাবস্থাও কেউ করেনি।একবার শুনেছিলাম,লোকটা ঘুষের চাকরি করতো।অনেক টাকা কামাইছে, জীবনে ছেলে মেয়েদের জন্যে।পাপের প্রায়িশ্চত্ত কি এমন হয়! আমার জানা নাই।১৫/২০ দিন কষ্টে ভুগে লোকটা মারা গিয়েছিল।তার ছেলে মেয়ে হাফ ছেড়ে বেচেছে।

তৃতীয় কেস:
৩৪/৩৫ বছরের এক ছেলে হাতে টাইট ব্যান্ডেজ বেধে এসেছে।টাইট ব্যান্ডেজ দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছে।খোলার পর দেখি হাত টা কালো হয়ে গেছে।আংগুল গুলো,পোড়া কাঠির মত হয়েছে।বুঝলাম সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে।এই বয়সে যদি হাত টা কেটে ফেলতে হয়,কি করবে বাকি জীবন সে?ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুগীকে ভর্তির জন্যে পাঠালাম।

উপরোক্ত সব ঘটনা গুলো বিশ্লেষণ করলে কিছু জিনিস স্পষ্ট, তাহলো প্রথম কেসে অজ্ঞতা অশিক্ষা,অযত্ন,অবহেলার কারনে তারা তাদের বৃদ্ধ বাবাকে প্রথমে কোয়াকের কাছে নিয়ে গেছে,একগাদা এন্টিবায়োটিক খেয়ে রেজিস্টেন্ট করে কবিরাজের কাছে গেছে অপরিচ্ছন্নতার কারনে পায়ে বারো বাজায় তারপর দালালের মাধ্যমে গিয়ে ক্লিনিক যেটা আরও এক ভুল ছিলো,এইসব ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতাল সবচেয়ে ভাল জায়গা চিকিৎসার জন্যে।রক্ত দানে ভয় আরেকটা কারণ অশিক্ষা।কেনা রক্তের চেয়ে আপন জনের রক্ত দান বেশি দরকার ছিল।


দ্বিতীয় কেস,বৃদ্ধ পিতার প্রতি অতি শিক্ষিত ছেলে মেয়ের অযত্ন।স্ট্রোকের রুগী যত্ন বেশি দরকার,তাকে কিছুক্ষন পর পর পজিশন চেঞ্জ,নিট্রিশনের ঘাটতি পুরন,রক্তের ঘাটতি
পুরন,রক্তের ঘাটতি পুরন,সর্বোপরি ঘায়ের যত্ন কোন পেইড লোকের চেয়ে নিজে করা বেশি জরুরী।এরা শিক্ষিত নামের কলংক।
তৃতীয় কেস,কবিরাজি করে টাইট বাধনে রুগীর হাতে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় হাত পচে গেছিলো।

আসুন এইসব ব্যাপারে সচেতন হই,খুব খারাপ রুগী ক্লিনিক বা চেম্বারে না নিয়ে সরাসরি সরকারী হাসপাতালে নিন।বিশ্বাস রাখুন সরকারী হাসপাতালের প্রতি যেখানে প্রতিদিন অসংখ্য খারাপ
রুগী স্বল্প খরচে ভাল হয়ে বাড়ি ফিরছে।দয়া করে কোয়াক বা কবিরাজের কাছে যাবেন না,তাতে আপনাদের আমাদের সবার জন্যেই জটিলতার সৃষ্টি করবে।

___________________________

ডা. মিথিলা ফেরদৌস। লোকসেবী চিকিৎসক। সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়