Ameen Qudir

Published:
2017-08-08 05:00:17 BdST

আঠারোয় যে বান্ধবীটি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল , তার খোঁজ দিতে পারে না কেউ


 


ডা. মোশাররাত জাহান কণা

____________________________________


মাত্র আঠারো বছর বয়সেই আমার যে বান্ধবীটি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল , তার খোঁজ এখন আর কেউ দিতে পারে না! অথবা দিতে চায় না । আমাকে দেখলে প্রথম কিছুক্ষণ খুব উচ্ছ্বল হাসি খুশী থাকতো ও । ওর চোখ চকচক করে উঠতো - "আম্মু দেখছো? কণা আসছে? বলছিলাম না ও ঠিক ই আসবে? তুমি তো বিশ্বাস করো নাই! "

কিছুক্ষণ পরে ই Derailment হত । আবোল তাবোল বকতে শুরু করতো ।
খুব অসুস্থ অবস্থায় ও কিভাবে যেন কয়েকবার আমাদের বাসা খুঁজে চলে এসেছিল । আমি তখন ঢাকায় । আমার সাথে দেখা হয় নি । এক রাতে ওর বাবার মোবাইল থেকে আমাকে কল করেছিল । পরের দিন ছিল আমার প্রফ । ফিসফিস করে কি যেন বলছিল , আমার আর বোঝা হয় নি ও কি বলতে চেয়েছিল ।
ওর সেই প্রাক্তনের বিয়ের ছবি দেখলাম । ভাল আছে সে । ভাল থাকুক ।

আহা! কত মানুষকে দেখেছি পোশাকের মত সম্পর্ক বদলাতে অথচ মেয়েটা একটা সম্পর্ক হারিয়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিল ।

ক্লাস এইটে পড়ুয়া আমি তখন স্যারদের ব্যাচে খুব জনপ্রিয় । তেমন কারো সাথে মেশা হত না আমার । বছরের মাঝামাঝি সময়ে এক অসামান্য রূপসীর আবির্ভাব । ও খুব নিজ থেকে আমার সাথে মিশতো । একদিন কোচিংয়ে না দেখলে বাসায় ছুটে আসতো । এত আগ্রহের কারন কি ? কিছুতেই বুঝতাম না ।
শুধু মাত্র ওর ই ঐকান্তিক চেষ্টায় খুব ভাল বন্ধু হয়ে গেলাম আমরা । পাশাপাশি বসা , কত গল্প আর হাসাহাসি! ফাইনাল পরীক্ষা শেষ । ক্লাস নাইনের শুরুতে বিভাগ আলাদা হয়ে গেল । ও আর্টস নিল আমি সাইন্স । এর ই মধ্যে দিন সাতেকের জন্য ঢাকা যেতে হল আমাকে। ফিরে এসে দেখলাম হুট করে ওর বসার জায়গাটা বদলে গেছে । ওর গ্রুপের সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী এখন ওর বেস্ট ফ্রেন্ড । বুঝে নিলাম ওর একজন ভাল ছাত্রীর সাহচর্যের খুব প্রয়োজন ছিল ।

ওই প্রথম বুঝিয়ে গিয়েছিল " সম্পর্ক গুলো নিড স্পেসিফিক হয় , পার্সোন স্পেসিফিক না । "
এর জন্য ওর কাছে আমি সত্যি ই আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো ।
আফসোস ওর ভাল ছাত্রী বন্ধুগুলো ওর কোন খোঁজ রাখেনি । ওর প্রিয় বান্ধবীকে জিগেস করলাম - " ওর খোঁজ জানো? "
আরে নাহ! ও তো কবে ই ঢাকা চলে গেল!

"ফোন নাম্বার দিয়ে যায় নি তোমাকে? "

" উমম ... দিয়েছিল । হারিয়ে গেছে! "

তারপর ও ওকে খুঁজে গেছি বহুবছর! পাইনি ।

যে নাম্বার একটা মানুষ বহুকাল খুঁজে গেছে , কারো হাত থেকে সেই নাম্বারটাই কত অবহেলায় হারিয়ে গেল...

২০১০ সালের মাঝামাঝি দিকে ফেসবুকে এই একাউন্ট টা খোলা । এরপর থেকে দিন রাত শুধু একজন কেই খুঁজে গেছি । যাকে হারিয়েছিলাম সেই ২০০০ সালে । ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন । স্কুলের খাতায় ওর নামের বানান মনে করার কি আপ্রাণ চেষ্টা! কখনো ফার্স্ট নেইম কখনো লাস্ট নেইম বাদ দিয়ে শুধু খুঁজেই চলা । অবশেষে শৈশবে হারিয়ে যাওয়া সেই মানুষটার সাথে এক তরুণীর চেহারার বেশ খানিক টা মিল খুঁজে পেলাম । সাহস করে একটা টেক্সট দিয়ে ফেললাম । কিছুক্ষণ পর পর ফেসবুক চেক করি । কোন মেসেজ কি আসলো? দিন যায় সপ্তাহ যায় । আমি দিন গুনি । পাক্কা এক মাস পর উত্তর আসলো । সেই অনুভূতি প্রকাশ করার মত শব্দ আমার ভান্ডারে নেই । অবশেষে দেখা হল । একবার না, বেশ কয়েকবার । পাশে বসে থাকা প্রচন্ড Self Centered , Egoistic মানুষটার সাথে তখন আমার যোজন যোজন দূরত্ব ...
দেখা তার চেয়ে অদেখা সেই বরং ভাল ছিল । অপেক্ষা ছিল , তবুও আশাভঙ্গের কষ্ট ছিল না ।
সত্যি ই জীবন টা অদ্ভূত । খুব কাছে থেকে ও কেউ হয়তো অনেক দূরের কেউ । আবার হারিয়ে গিয়েও কত মানুষ , মনের বিরাট অংশ জুড়ে রয়ে যায় ।

পুরোনো একটা গান মাথার ভিতর বাজছে ।

"তুই হয়ত ভাল ই আছিস
আর আমি ও মন্দ নেই
তবু অসময়ে এসে স্মৃতি গুলো বুকে আঁকি বুকি কাঁটবেই ।
তুই কত দূরে চলে গেলি
তোকে হারিয়ে ফেলেছি আমি
এই দুঃখ টা হয়ে থাক
এই দুঃখটা বড় দামি ।

কেন বাড়লে বয়স ছোট্ট বেলার বন্ধু হারিয়ে যায়?
কেন হারাচ্ছে সব ?
বাড়াচ্ছে ভীড় হারানোর তালিকায়? "

লাইন গুলো হারানোর ভীড়ে চলে যাওয়া কিংবা লাইনে থাকা সব বন্ধুকে উৎসর্গ করলাম ।
_________________________________________

লেখক ডা. মোশাররাত জাহান কণা । সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়