Ameen Qudir

Published:
2017-07-30 01:32:48 BdST

হুমায়ূন আহমেদ :যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলেছে


 

ডা. মিথিলা ফেরদৌস


_________________________________


আমার দুইটা নেশা ছিলো,বই পড়া (পড়ার বই বাদে),গান শোনা।গানের ক্যাসেট কি কিনলাম তা নিয়ে আমার বাপের কোন মাথা ব্যাথা ছিলোনা,কিন্তু বই কেনার ব্যাপারে খবর্দারি করতো খুব আব্বা।যখন হুমায়ূনের বই পড়া শুরু করি,তখন নিজে কেনার মত সামর্থ্য আমার ছিল না।বাপের কাছেই হাত পাততে হতো।হুমায়ূনের বই কেনার ব্যাপারে তার প্রবল আপত্তি ছিলো,পড়ার ব্যাপারে না।তার কথা এইসব বই কালেকশনের জন্যে না।তখন কিন্তু সবাই এমনই ভাবতো শুধু আমার বাবার দোষ দিয়ে লাভ নাই।

মজার ব্যাপার হলো হুমায়ূন আহমেদের বই যখন আমি কারও কাছ থেকে ধার করে আনতাম তখন অন্য বই এর আগে আমার বাবা মা ওই বই নিয়েই কাড়াকাড়ি শুরু করে দিতো।এতে অবশ্যই জয়ী হতো আমার মা।তার সঞে আমরা দুইজন পেরে উঠতাম না।হুমায়ূনের বই এক নিশ্বাসে শেষ না করা পর্যন্ত স্বস্তি হতো না।মনে আছে খেতে খেতেও পড়তাম।অনেক রাত পর্যন্ত সেই বই নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হতো।আমার বাবা মুল সমালোচক হলেও তার বই থেকে কিছু কোট সে নিজেই করতো।

হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে বলার কিছুই নাই।এতই বর্ণনাতীত। শুধু এইটুকু বলবো বাংগালীকে বাংলাদেশি বই পড়া শিখিয়েছেন উনি।এত সহজ সাবলীল ভাষায়,এত কঠিন কথা থাকতো,এত বাস্তব কথা এত সুন্দরভাবে উনিই কেবলমাত্র উপস্থাপন করতে পারতেন।আমি উনার বই পড়ে একা একাই হাসতাম,আবার নিজের অজান্তে চোখে পানিও চলে আসতো।যদিও এইটা আমার কাছে খুব লজ্জা লাগতো,চোখের পানি লুকায় বলতাম না কই,কিছু হয়নিতো,কিন্তু আজ স্বীকার করতে বাধ্য হলাম আমি কেবল মাত্র উনার বই পড়েই চোখে পানি ফেলেছি,এত টাচ করে যেত উনার লেখা।

এখনও আমি অনেকের লেখায় দেখি, এমন কি আমার নিজের লেখায়ও আমি না চাইলেও কিছু জিনিস চলে আসে।আমরা উনার দ্বারা প্রভাবান্বিত।যে কখনই বই পড়েনিও সেও উনার বই পড়েছে,পড়তে বাধ্য হইছে।

বাংগালী যখন,সঞ্জীব, শীর্ষেন্দু,সমরেশ,সুনীলে মত্ত,তখন হুমায়ূনের বই,একুশে বই মেলা শুধু না কলকাতার বই মেলাও বেস্ট সেলার ছিলো,উনার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
উনি যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলেছে,নাটক এমনকি বাংগালী যখন সিনেমা হলে যাওয়াই বন্ধ করেছিলো তখন উনার সিনেমা দেখতে মানুষ হলে ভীড় জমাতো।এক বিরল প্রতিভা ছিলেন।হাজার বছরেও এমন প্রতিভা আর বাংলার বুকে আসবে কিনা সন্দেহ।

সমালোচকের দৃষ্টিতে উনার বই নাকি হালকা টাইপ,শিক্ষণীয় কিছু নাই।কেবল মাত্র ভারি ভারি কথা বললেই কি বই ভারি হয়ে যায়?আর আমিতো দেখি উনার বইয়েই শিক্ষনীয় কথাগুলো অনেক সহজ ভাবে উপস্থাপন করা।উনি একজন রসায়নবিদ হলেও সাহিত্যে উনার অগাধ জ্ঞান অস্বীকার করার কোন উপায় নাই। দেশ,বিদেশের সব লেখকের সম্পর্কে জানতেন,অনেক ভাষার অনেক বিখ্যাত বইয়ের নাম আমি উনার বই থেকে জেনেছি,অসাধারণ সব গান শুনতেন।এত সময় পেতেন কিভাবে আমি অবাক হতাম। চাকরী ছেড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখার জন্যে।দেশের জন্যে তার ভালবাসা সত্যি অবাক করার মত।সব লেখককে নিয়ে বিতর্ক থাকলেও উনি একমাত্র ব্যাক্তি যাকে নিয়ে কোন বিতর্ক ছিলোনা,মানে বলতে চাই উনার লেখা কোন এক পেশে লেখানা।

হুমায়ূন অনেকবার একটা কথা বলতেন,উনি বর্তমানকে উপভোগ করতে পছন্দ করেন,তাই উনি কোন ইচ্ছা কখনও অপুর্ন রাখতেন না।তাই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা উনি করে ছিলেন।কেউ হয়তো সবদিকে পুর্নাংগ হয়ে উঠতে পারেনা,তাই সবচেয়ে শুব্ধ মানুষটিও জীবনে একটা ভুল করে ফেলে,উনিও করেছিলেন।অন্তত আমার দৃষ্টিতে তা ভুল ছিলো।রহিম করিম বহু বিবাহ করলে তা স্বাভাবিক লাগতে পারে।কিন্তু প্রিয় লেখক কোন অপ্রিয় কাজ করলে কষ্ট হতেই পারে।এবং আমি অবাক হয়েই লক্ষ্য করলাম ওই ঘটনার পর উনার লেখার মান আমার নিজের কাছেও কিছুটা কমে গিয়েছিল।হতে পারে উনি তখন অনেক কিছুতে ইনভলবড ছিলেন,হতে পারে আমি মানসিকভাবে ব্যাপারটা মেনে নিতে পারিনি।
যেকোন কারনেই হোক শেষের দিকে উনার লেখা তেমন পড়া হতো না।

 উনার মৃত্যু দিবসে একটা কথা খুব মনে পরছে,যেদিন উনি মারা গেলেন সেদিন আমার বাবা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন।বাবার কাছেই খবরটা প্রথম শুনেছিলাম।আব্বা খুব মন খারাপ করে বলেছিলেন,'বাংলা সাহিত্যের এক নক্ষত্রের পতন হলো আজ'।তিন দিন টিভির লাইভ টেলিকাস্ট হুমায়ূনকে নিয়ে আমার বাবা বসে বসে দেখেছেন,যিনি ছিলেন তার সমালোচক
সবচেয়ে কস্টের কথা হুমায়ূন আহমেদ কিন্তু ভুল চিৎসায় মারা গিয়েছিলেন বিদেশের মাটিতে,সবচেয়ে নামকরা হাসপাতালে।ভুল তো মানুষেরই হয়।আমাদের এত প্রিয় একজনের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যকে মেনে নিয়েছি।কিন্তু দেশীয় চিকিৎসকের পান থেকে চুন খসা আমরা সহ্য করতে পারিনা।জাতি হিসেবে কি বিচিত্র আমরা।

জাফর ইকবালের এক লেখায় পড়েছিলাম,এক বৃদ্ধ একবার উনার সাথে দেখা করতে এসে বলেছিলেন,'বাবা আপনার হাতটা একটু ধরি?'হাত ধরে অবাক হয়ে বলেছিলেন,'আপনি সত্যি হুমায়ূন আহমেদের ভাই!!'

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়