Ameen Qudir

Published:
2016-11-26 19:57:16 BdST

ডাক্তার প্রতিদিন এক্সক্লুসিভ "আমার পা নেই ; আমি হাতে হাতেই চলি " বাংলাদেশী কর্মকর্তার অবিশ্বাস্য জীবন ( ভিডিওসহ)


 

 

 

 

লিখেছেন স্বয়ং সাজেদ আলী সরদার
______________________________

সাতক্ষীরা জেলার ঘোনা নামের গ্রামে আমার জন্ম।
একেবারেই সীমান্তের এক নিঝুম গ্রাম। পাখি ডাকে। প্রচুর সবুজ।
সেখানেই আমি বড় হয়ে উঠি।
কিন্তু কে আমি ! কেমন করে এতগুলো বছর পার করলাম জীবনের। কে তার নিয়েছে খোঁজ।
খোঁজ নেবার কারই কিবা দরকার।

আমার বাবা মোকসেদ আলী সিকদার ছিলেন ভূমিহীন কৃষক। প্রকৃতই ল্যান্ডলেস। শৈশব কৈশোর আমার কেটেছে দারিদ্রর সঙ্গে লড়াই করে।
আমার মা আনিসা খাতুন ছিলেন গরীব হাউস ওয়াইফ।
সাত ভাইবোনের মধ্যে আমি সবার বড়।
ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত আমি মায়ের কোলে চড়েই স্কুলে গেছি।

মা আমার মা। মায়ের তুলনা হয় না। মা না থাকলে দুনিয়া অন্ধকার।
মা আমাকে কোলে করেই নিয়ে যেতেন স্কুলে। তিনি মোটেই ঘাবড়াতেন না। তার ছেলেকে মানুষ করতে হবে যে।
আমি মায়ের কোলে করে স্কুলে যেতাম ফাইভ পর্যন্ত । কেন !! সে প্রশ্ন তো উঠবেই। ক্লাস ফাইভের কোন ছেলে মায়ের কোলে চড়ে কি।

আমি চড়তাম। না চড়ে উপায় ছিল না।
বিখ্যাত খুলনা জিলা স্কুলে আমি পড়তাম।
সেখা্ন থেকেই মানবিক বিভাগে এস এস সি পাশ করি।

 

আমার পক্ষে আর উচ্চ শিক্ষা নেয়া সম্ভব ছিল না। কারণ আমার শারিরীক বিকলাঙ্গতা। আর কঠিন দারিদ্রের কষাঘাত। অক্ষরজ্ঞান হীন দিন মজুর পরিবারে আমি সন্তান।
তারপরও লেখা পড়া ও জীবনযুদ্ধের সংগ্রাম আমি ছাড়ি নি।

জন্ম
আমার পরিপূর্ণ সুস্থ শিশু হিসেবেই হয়েছিল। কিন্ত শৈশবেই আমি পোলিও আক্রান্ত হয়ে হাঁটার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। আমার পা শুকিয়ে যায়। আমি চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়ি।

কিছু চিকিৎসা হয়েছিল। অমন হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানের কি ই বা চিকিৎসা হতে পারে।
তাও আমার অদম্য বাবা মা চেষ্টা করেছিলেন। কোন লাভ হয় নি।
কিন্তু অদম্য মায়ের সন্তান হিসেবে আমিও ছিলাম অদম্য। আমি দমে যেতে শিখি নি। শিখেছি, কেমন করে সামনে যাব। আগুনের পরশ মনির ছোয়া পাব । আলোকিত পৃথিবী দেখব।
শিক্ষা ছিল আমার আরাধ্য।

আপনারা আমার ভিডিও দেখলে দেখতে পাবেন, আমি হুইল চেয়ার ব্যবহার করলেও সম্পূর্ন স্বাধীনভাবে হাতের ওপর ভর করে দিব্যি চলতে পারি। আমি হাতে হাঁটি । অফিস করি।


আমাকে চলতে হবেই। হোক না তা হাতের ওপর ভর করেই। কোন কিছু পরোয়া করি নি। আমি সবসময় নির্ভিকভাবে হাতের ওপর দিয়েই চলেছি। সিড়ি ভেঙেছি। টেবিলে বসেছি। পড়াশোনা করেছি।

মা আমাকে আর কতকাল কোলে পিঠে করে রাখবেন। কতটাই বা পারবেন। আমার কি বিবেক নেই! মায়ের কষ্ট কি আমার কষ্ট নয়।

কি ভাবছেন, দারিদ্রর কষাঘাত, হাতে ভর করে বিচিত্রভাবে চলা-- এসবের কারণে আমি জীবনযুদ্ধে আমি হার স্বীকার করেছি । না । একদম নয়।
আমি হারি নি।

আমার শরীর ঈশ্বরেরই অবদান। আমি তা স্বীকার করে নিয়েছি। বছরের পর বছর পাঁচ কিলোমিটার পথ হাতের উপর ভর করে চলে স্কুলে গেছি। স্কুল কামাই করি নি। আমাকে মানুষ হতে হবে যে।
কী বৃষ্টি। কী তীব্র রোদ। কোন কিছুই আমার মনোবলকে নষ্ট করতে পারে নি।

আমি সবসময় ভেবেছি; আর সংকল্প করেছি ; আমার পা নেই। তাতে কি। অামাকে হাতের ওপর ভর করেই জীবনযুদ্ধ করতে হবে। জীবনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে।
আমাকে স্কুল কলেজে যেতে হবে। পড়াশোনা করতে হবে। পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের জন্য সম্মানজনক আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই স্বপ্ন সংকল্প নিয়েই আমি জীবনের ফুল ও কাঁটা বিছানো পথ পাড়ি দিয়েছি।

আমার শরীরে অন্য কোন রোগ ব্যাধি কখনও বাসা বাধেনি। কখনও অসুস্থ হই নি। নেশা করি নি। চাকুরি করছি। কম্পিউটার চালাই। সব কাজই পারি।

আমি সর্বদা কঠিন পরিশ্রম করেছি। শরীরের সীমাবদ্ধতা আমার চলার পথে, কাজের ক্ষেত্রে কখনও বাধা হয় নি। শহীদ মিনারে হাতে ভর করে গিয়ে ফুল দিয়েছি। কোন গুণীজন মহাপ্রয়ানে গেলে তার কবরে , বা কফিনে গিয়ে অন্য সবার মত ফুল দিয়ে এসেছি। কেউ আমার সংকল্প রুদ্ধ করতে পারে নি।

আমি সদা আত্মবিশ্বাসী। কর্মচঞ্চল। পরিশ্রমী। ইতিবাচক চিন্তা চেতনা আমার সম্পদ। আমি বিশ্বাস করি, পরিশ্রমই সৌভাগ্যের প্রসূতি।

ভারত সরকারের আমন্ত্রণে আমি ভারতে গেছি।
গত শতাব্দীর শেষ লগ্নে ৯৯ সালে আমি জাপানের নাগোয়াতে গেছি। সেখানে সেখানে হাতের ম্যারাথনে আমি অংশ নিয়েছিলাম।
আমাকে অবশ্য একটি হুইল চেয়ার দেয়া হয়েছিল সুবিধাজনকভাবে চলাফেরা করার জন্য। সেটা অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। তাতে কি। হুইল চেয়ার তো জীবন নয়। জীবন্ত হলাম আমি। জীবন আমার সঙ্গী। কখনো সে আমাকে ছেড়ে যায় নি।
আমি হাতে হাতেই চলি। চেয়ারটাও সারিয়ে নিয়েছি । তাতেই চলে যায়।
সকালে হামাগুড়ি দিয়েই জীবন শুরু। সেই শৈশবের মত আজও চলি।
সিড়ি ভাঙি। অফিসের জন্য প্রস্তুতি নেই। কামাই করি না। তারপর বাসা থেকে বেরিয়ে হুইল চেয়ারে করে পথটুকু পাড়ি দিয়ে আমার অফিস পল্লী উন্নয়ন বোর্ডে পৌছাই। সেখানে সিড়ি ভাঙতে হয়। চেয়ার তো সিড়িতে চলে না। আমি হামাগুড়ি দিয়ে নিজের ডেস্কে গিয়ে পৌছাই। স্বাক্ষর করি। কাজ করি। কম্পিউটার টেবিলে কাজ করি।
এই তো জীবন। এই তো দুর্দান্ত বেঁচে আশি আমি।
_______________________________

 

 


লেখক : সাজেদ আলী সরদার। স্বয়ং এই লেখা ও ভিডিও পাঠিয়েছেন ডাক্তার প্রতিদিন সম্পাদক ডা. সুলতানা আলগিনের কাছে।

__________________________________________

 

 

 

এবার ভিডিও দেখুন। এক বাঙালীর অবিশ্বাস্য আত্মবিশ্বাসী জীবনচিত্র।

 

 

 

 

 

 

 

 

এবার কিছু স্থির চিত্র।
__________________________

 

ঘুম থেকে উঠে অফিসে যেতে প্রস্তুত হচ্ছি।

____________________________________

রেডি হয়ে হুইল চেয়ারে অফিসের পথে।

________________________________

 

 

রাস্তায় চলছি । যাচ্ছি অফিসে।

__________________________

 

আমার অফিস।

_____________________________

 

অফিসে হাজির।

__________________________________

 

 

অফিসে কাজ করছি নিজের টেবিলে।

_____________________________________

কম্পি্উটারে কাজ করছি।

_______________________________________

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়