Ameen Qudir

Published:
2017-05-29 17:13:23 BdST

আমি যেদিন মার খেয়েছিলাম



ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
___________________________________

অতীতে অনেকবার লেখাটি লিখতে গিয়েও আমি থেমে গেছি। থেমে গেছি কয়েকটি কারণে।

এই লেখাটি একান্ত ব্যক্তিগত না হলেও লেখাটির ভেতর প্রবল 'আমিত্ব' থাকার একটা সম্ভাবনা আছে। তাই লিখতে গিয়ে বিব্রত লাগতো।

দ্বিতীয় কারণটি হলো এটা হয়ত চলমান ডাক্তার-রোগীর মধ্যকার সহিংসতাকে উস্কে দিতে পারে।

তৃতীয় কারণটি হলো ফেসবুকে যারা আমার পাঠক আমার ধারণা তারা আমাকে খুব নরম সরম একজন সংবেদনশীল মানুষ, রোগী বান্ধব ডাক্তার, তার উপর আবার গায়ক হিসেবে জানে। এই লোক রোগীর আত্মীয়দের পিটিয়েছে শুনলে আমার পাঠকবন্ধুরা প্রচন্ড ধাক্কাও খেতে পারে।

ঘটনাটা বলি।
২০১০ সালে আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলা হেলথ কম্পলেক্সে পোস্টিং নিয়ে আসি।

এক শুক্রবার রাতের ইমারজেন্সি ডিউটি। রাত পৌনে দশটায় ইমারজেন্সি থেকে উঠে পাশেই কোয়ার্টারে গেলাম। রাতের খাবার খেতে।

ইমার্জেন্সিতে রেখে যাই একজন মেডিকেল এসিস্ট্যন্ট (SACMO), একজন পাহারাদার, একজন ওয়ার্ডবয়। উপরে ওয়ার্ডে একজন নার্স ছিলেন। ডাকলে যখন তখন চলে আসেন। আর আমার কোয়ার্টার হলো ইমারজেন্সির ঠিক পাশেই।দু মিনিটের পথ।

এরকম সময়ে নাইট গার্ড খবর দেয় স্যার একটা বিষ খাওয়া রোগী আসছে। খুব খারাপ,রোগীর লোক চিল্লাফাল্লা করতাছে। আমি খাওয়া অসম্পূর্ণ রেখে দৌড়ে চলে আসি।

এসে দেখি রোগীর অবস্থা ভাল নয়। ধীর গতিতে অনিয়মিত শ্বাস ফেলছে। ৪৫ মিনিট আগে বিশ খেয়েছে। ব্লাড প্রেসার নেই। তারচেয়ে বড় সমস্যা হলো রোগীর সাথে যারা এসেছে, গোটা দশেক অল্প বয়সী ছেলে পেলে, এরা এসেই একধরণের ত্রাস সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যে ঢুকেই স্যাকমো হাসনাত সাহেবের চেয়ারে লাথি মেরেছে। হাসনাত সাহেবের বয়স প্রায় ষাট। আমি নিজেই তাকে সম্মান করি। এই ছেলেরা এই বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটাকে ঘাড়ে ঠুয়া দিয়েছে। উনার অপরাধ উনি ওদের দেখা মাত্র চেয়ার ছেড়ে ওঠেননি এবং রোগীকে রেফার করতে চেয়েছেন জেলা সদরে।

আমি ঢোকা মাত্র ছেলেগুলি চিৎকার করে বলছিল নল লাগান, নল লাগান, পেট ওয়াশ করেন।

বললাম প্রায় একঘন্টা আগে বিষ খেয়েছে। এখন শ্বাস ঠিকভাবে নিতে পারছেনা। এ অবস্থায় ওয়াশ দেওয়া যাবেনা। দিয়ে ফায়দাও নেই। ছেলেগুলি নাছোড় বান্দা। ওয়াশই দিতে হবে।

আবার বুঝালাম। আমাদের এখানে খুব ভাল কিছু করা সম্ভবনা। লাইফ সাপোর্ট লাগবে। ঢাকায় নিয়ে যেতে পারেন।

ওরা যাবেনা।
নিজেরাই নানারকম ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে।

আমি বললাম এটা ঠিক রোগীটা জেলা সদরে নিতে নিতেই মারা যাবে। আমি যেটুকু চেষ্টা করার করছি। নিজের পরিবারের সদস্য হলে যা করতে পারতাম তাই করব, কিন্তু তোমরা দয়া করে শান্ত হও। এর মধ্যেই একটা ছেলে পাশের রুমের জানালায় একটা লাঠি দিয়ে বাড়ি দিল। জানালার কাঁচ ভেংগে গেল।

আমি রোগীকে একটা হাইড্রোকর্টিসন ইঞ্জেকশন দিলাম,অক্সিজেন লাগালাম। আর কি করব?
পেছন থেকে একজন বলল, কুত্তার বাচ্চা পেট ওয়াশ করছ না ক্যান?
আমি বললাম বিষ এতক্ষণে রক্তে মিশে গেছে। লাভ হবেনা।

লোকটা আমাকে কুৎসিত গালি দিল একটা।
এর দুই মিনিট পরই মনে হলো রোগীটি নেই।
আমি ডেথ ডিক্লার করলাম।

যে লোকটা গালি দিচ্ছিল, সে এসে আমার বুকে একটা ঘুষি লাগালো।
আমি এতক্ষণ এদের মাইন্ড রিডিং করছিলাম। সম্ভাব্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলাম। ঘুষি খেয়ে একটু থতমত খেলাম।

কিন্তু এরচে ভয়ংকর ঘটনা ঘটলো। আমার মার খাওয়া দেখে একলাফে আমার নাইট গার্ড গেল পালিয়ে। ওয়ার্ড বয়ও। হাসনাত সাহেব বোকার মত দাঁড়িয়ে। এরকম সময় এক ছেলে দৌড়ে গেল সিস্টার রুমের দিকে। সিস্টার দৌড়ে রুমে ঢুকে রুমে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল।

আমি প্রাথমিক হতভম্বতা কাটিয়ে একটা উন্মত্ত চিৎকার দিলাম। সাথে অনবরত কয়েকটা গালি। বলে রাখা ভাল আমি ঐ এলাকারই স্থানীয় ছেলে। মেইন কলাপ্সিবল গেইট লাগিয়ে দিলাম।যে বদ্মাশটা আমাকে মেরেছিল সে হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল আমার রূদ্র মূর্তি দেখে। এক লাফে সে বেরিয়ে গেল আমি গেইট পুরো ক্লোজ করার আগেই।

কলাপ্সিবল গেইটে তালা লাগিয়ে দৌড় দিলাম ওর পিছে পিছে। অন্ধকার রাত। ক্যম্পাসের পুকুর পাড় পর্যন্ত দৌড়েও ওকে ধরতে পারলাম না। তবে দ্বিতীয় শয়তানটাকে ধরলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি পেছন দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছে নাইট গার্ড, ওয়ার্ড বয় দুজনই। ওদের এবার সাহস বেড়েছে। অন্যান্য রোগীর স্বজনেরা আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলা শুরু করল। ওরা নিজেরাই ধরে ফেলল নার্স কে ধাওয়া করা ছেলেটাকে। সব কটাকে ধরে ইমার্জেন্সি রুমে ঢুকালাম। তৎকালীন আরএমও ডা: শাহ আলম ভাইকে ফোনে জানালাম। উনি ওসিকে ফোন দিলেন।

এর মধ্যে আরেক কান্ড। স্থানীয় কয়েকজন যুবক আমি আক্রান্ত হয়েছি শুনে ছুটে এলো। এরা আমাকে ভালবাসে। প্রায় বিকেলেই এদের সাথে আমার দেখা হয়,কুশল বিনিময় হয়।

এরা এসেই ইমারজেন্সি রুমের লাইট নিভিয়ে ছেলেগুলিকে বেদম পেটাতে শুরু করলো। আমি তখন সামনের করিডোরে ফোনে কথা বলছিলাম। মাইরের শব্দ শুনে ছুটে এসে প্রানপনে থামালাম ওদের। আবার কি না কি কেলেংকারি হয়।

পুলিশকে খবর দেওয়া হলো। সরকার বাদী মামলা হলো। সরকারি কাজে বাধাদান, সরকারি সম্পদ বিনষ্ট, কর্মকর্তা কর্মচারিকে শারীরিক লাঞ্চনা। শক্ত অভিযোগ।

খবর পেয়ে ছুটে এলো জাতীয় পত্রিকার আখাউড়া প্রতিনিধি সাংবাদিক Sameer Chakraborty, Bishwajit Paul Babu, Dulal Ghose। তারা সঠিক নিউজটিই করল। নৈতিক সাহস ও সমর্থন দিল। যুগান্তরের মনির ভাই সদর থেকেই নিউজ করলো, নিজে না এলেও। এদের সেই সহযোগিতা, সেই বন্ধুত্বের ঋণ আমি ভুলবনা।

২০১০ সালের ঘটনা। মামলাটি আজো চলছে। আমি এখনো মাসে দুইদিন আখাউড়ায় যাই রোগী দেখতে। আসামীরা মাঝে মাঝে আসে। আমার পায়ে ধরে ক্ষমা চায়। আমি ক্ষমা করে দেই। কিন্তু মামলা তুলতে পারিনা। আমি এর বাদী নই। বাদী সরকার।

প্রতিমাসে ওদের জেলা জজ কোর্টে হাজিরা দিতে হয়। পালিয়ে যাওয়া ছেলেটি অনেকদিন পলাতক থেকে তারপর জামিন নেয়। এখন সেও হাজিরা দেয়। তবে ঐ ঘটনার পর তার নিজ এলাকায় তার মান মর্যাদা বেড়েছে। সে ক্ষমতাসীন দলের ইউনিয়ন কমিটিতে স্থান পেয়েছে। তার নাম মানিক। তবে এই নামে কেউ না চিনলে বলে - ঐ যে ডাক্তাররে যে মুড়াইছিল।

গল্প শেষ।
যে কারণে গল্পটা বলা, সেটা আইনজীবি Kazi Wasimul Haque ভাইয়ের একটি পোস্ট।

ডাক্তারদের মত নিরীহ লোকদের পেটানোর সুযোগ কেউ ছাড়বেনা। কারণ মারলে বিচার নাই, উপরন্তু লাভ। লোকের সমর্থন মেলে, আর্থিক লাভও হয়।

সবসময় হয়ত এরকম পালটা মার দেওয়া যাবেনা। কখনো কখনো হয়ত এরকম হবে যে, ডাক্তার পেটানো লোকটা সমাজে প্রতিবাদী নায়ক মান্না হয়ে উঠবে। কিন্তু মামলা একটা হতেই পারে। আর হলে কিন্তু খবর আছে। হাজিরা দিতে দিতে পশ্চাদ্দেশ রক্তাক্ত হয়ে যাবে। ডাক্তারদের তো দেওয়ালে পিঠ ঠেকেই গেছে। এখন আর আপস করে ভাল থাকার দিন নেই।

কাল আরেকজন আসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নয়ত ঢাকা কলেজ থেকে। নয়ত অন্য কোথাও থেকে। কয়জনকে ক্ষতিপূরণ দেবেন প্রিয় স্যারেরা?
______________________________

লেখক ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল । রেসিডেন্ট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা। প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী। 

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়