Ameen Qudir

Published:
2017-05-28 00:52:29 BdST

শিক্ষা সভ্যতা মানবতার প্রশ্নে শ্রেষ্ঠত্ব দেখালেন ডাক্তার সমাজ


 

 

 

ডাঃ তরফদার জুয়েল
______________________________

আমাদের সমাজ কতটা শিক্ষিত?
কতটা সভ্য?
আমাদের মানবতা কেমন?

সেগুলো বুঝার জন্য কিছু উপাদান দিলাম, যাচাই করুন -

#ঘটনা_১
=======

প্রথম দুইটি ভিডিও বাংলাদেশের একটি সরকারি হাসপাতালের ইমার্জেন্সির। একজন এমবিবিএস ডিগ্রিধারী, বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার কর্মকর্তা একজন রোগি দেখছেন, সাথে ৭ জন রোগির এটেন্ডেন্ট। এরই মাঝে আরেকজন রোগির আগমন ( এলাকার পাতি নেতা ও মাস্তান), সাথে ৬ জন এটেন্ডেন্ট। পরের রোগি খুব গুরুতর অসুস্থ না হওয়ায় চিকিৎসক আগে যে রোগি দেখছিলেন, তাকে ভালভাবে দেখে পরের রোগি দেখতে যান। কিন্তু পরের রোগিকে সাথে সাথে কেন দেখা হল না? তাই তিনি রেগে গেলেন, চিকিৎসকের বুকে লাথি দিলেন।

চিকিৎসক কি চিকিৎসা দেয়া বন্ধ করে দিলেন?

না।

চিকিৎসক কি দল বেধে রোগিকে ধরে মারলেন?

না।

চিকিৎসক কী করলেন?

রোগির গায়ে হাত বুলিয়ে, ভালভাবে বুঝিয়ে চিকিৎসা দিলেন। আর বুক ভরা কষ্ট নিয়ে ভাবলেন- আমি চিকিৎসক, আমি জনগণের টাকায় চিকিৎসক হয়েছি, আমার জান, মান সবকিছুই তো এখন জনগণের সম্পত্তি। দেশের আর কেউ জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নয়। আর কেউ জনগণের টাকায় পড়ে না। দেশের ২৭ টা বিসিএস ক্যাডারের মাঝে শুধু আমরাই জনগণের টাকায় লেখাপড়া করি। আমাদের মার খাওয়া জায়েজ।

যাক কি আর করার? পরের রোগি দেখার প্রস্তুতি নিই।

#ঘটনা_২
=======

পরের ৩ টা ভিডিও ঢাকার "সেন্ট্রাল হাসপাতাল" নামের বেসরকারি হাসপাতালের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে সেখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। চিকিৎসা চলাকালে মারা যান। চিকিৎসা দিয়েছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ, যার লেখা বই পড়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৪১ টা দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা চিকিৎসক হন।

রোগি মারা যাওয়ার পর ভুল চিকিৎসার অভিযোগ ওঠে। যদিও ভুল চিকিৎসা হয়েছে কি হয় নি, তা বিচার করা হয় নি, নিশ্চিত করা হয় নি। প্রথমে হাসপাতালে ভাংচুর চালান দেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নামধারি কিছু মানুষ। ভাংচুরেই তারাই ক্ষান্ত হয় নি। এরপর তারা দলবেঁধে কর্তব্যরত চিকিৎসককে মারতে থাকে, রক্তে রঞ্জিত হয় সেন্ট্রাল হাসপাতাল।

★ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৩০ হাজারেরও বেশি। আমি মনে করি ১০০ জন মানুষ কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করে না। এদের কারনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুন্ন হতে পারে না।

আবার এদেশে এখন নিবন্ধিত এমবিবিএস ও বিডিএস চিকিৎসক সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। সেখানে কোন চিকিৎসক যদি অন্যায় করেন, তা দিয়ে ৭০ হাজার চিকিৎসককে বিচার করা যায় না, একই কাতারে রাখা যায় না।

কিন্তু অবাক হই এটা দেখে যে, অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষগুলো এই ধরনের ভাংচুর, হামলা, চিকিৎসককে মারধরের পক্ষে কথা বলছেন।

কিন্তু কেন?

আগে মানুষ শিক্ষিত ছিল না, তাই সভ্য ছিল না, কোন আইন ছিল না, বিচার ছিল না। এক গোত্রের কেউ আঘাত প্রাপ্ত হলে পুরা গোত্র মিলে যুদ্ধে নেমে পড়ত, ভাল মন্দ, সত্য মিথ্যা বিচার করত না।

তারপর মানুষ শিক্ষিত হল, সভ্য হল, দেশে দেশে আইন তৈরি হল, সবাই আইন মানল, বিশ্বে শান্তি আসল।

"কেউ যদি বলে আয়রে, ছুটে চলে যাইরে"
এই নীতি যদি শিক্ষিত, সভ্য মানুষগুলোও মেনে চলেন, তবে শিক্ষার কি দরকার? সভ্যতার ঢাকঢোল পিটানোর কি দরকার?

★ জুনিয়র চিকিৎসক থেকে শুরু করে প্রথিতযশা চিকিৎসকও আজ চিকিৎসায় অবহেলা, ভুল চিকিৎসার অভিযোগে অভিযুক্ত, হামলা, মামলা, আঘাতের শিকার।

প্রথিতযশা চিকিৎসক, অধ্যাপককেও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আদালতে গিয়ে জামিন নিয়ে আসতে হয়, কিন্তু চিকিৎসক ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী হামলাকারির কিছুই হয় না।

★ এদেশে সাংবাদিক নামধারি কিছু মানুষ আছেন, সংবাদ ব্যবসাই যাদের কাজ। যে সংবাদ ছাপালে, প্রচার করলে জনগণ খাবে বেশি, তারা তাই প্রচার করেন, সাথে মশলা যোগ করেন। ভুল চিকিৎসার ভুয়া তথ্য প্রচার করে তারাই চিকিৎসক সমাজকে রোগির শত্রু বানিয়েছে, জনগণকে করেছে মারমুখি, রোগিদেরকে চিকিৎসকের প্রতি করে ফেলেছে আস্থাহীন।

ঝামেলা হয় রোগি ও চিকিৎসকের মাঝে, কিন্তু সেখানে সাংবাদিক কেন রেফারি হয়ে গোলদাতা হন? বড়ই ভাবনার বিষয়।

তারা অধ্যাপক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে স্যার বলতে লজ্জা পান, তাদের আত্মসম্মানে বাধে, যদিও এদেশে "স্যার" শব্দটা সম্মানের। আমার জানা নাই, সাংবাদিকতা পড়ানোর সময় কি তাদেরকে এটাই শেখানো হয়েছে যে, "কাউকে সম্মান দেখানো যাবে না, কাউকে সম্মান দেখালে নিজের সম্মান কমে যায় "?

★ একজন চিকিৎসক ( যিনি কারো অধীনে চাকুরি করেন না) রাতের বেলা রোগিকে চিকিৎসা দিলে কয়েকটা টাকা পাবেন। এই কয়েকটা টাকার চিন্তা বাদ দিয়ে যদি সব চিকিৎসক রাতের বেলা ঘুমিয়ে থাকেন, রোগি না দেখেন, তাতে কি তার খুব ক্ষতি হবে?

নিশ্চয়ই চিকিৎসকের কোন ক্ষতি হবে না, রোগিরই ক্ষতি হবে। তাহলে চিকিৎসক যখন তার সুখ শান্তি বাদ দিয়ে রোগিকে চিকিৎসা দেন, তখন তিনি একজন লোভি।

তার কাজের মূল্য কি শুধু টাকাতেই পরিশোধ হয়ে যায়?

★ একজন চিকিৎসক মরণাপন্ন রোগিকে চিকিৎসা দিলে কয়েক টাকা ভিজিট পাবেন, কিন্তু রোগি মারা গেলে কপালে জুটবে মার, জেলের ভাত।

সকল চিকিৎসক যদি মরণাপন্ন রোগি দেখা বাদ দেন, তাতে কি তার খুব ক্ষতি হবে?

নিশ্চয়ই না।

তাহলে মরণাপন্ন রোগিকে চিকিৎসা দেয়ার মূল্য কি শুধু টাকাতেই সীমাবদ্ধ?

★ একজন চিকিৎসকের সেবায় লক্ষ মানুষ সুস্থ হয়েছে, কিন্তু জীবনের এক পর্যায়ে একজন রোগি তার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলে তাকে যদি সাধারণ অপরাধির মত একই কাঠগড়ায় রেখে বিচার করা হয়, তবে আগের এত মানুষকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করার কি কোন দাম নাই ? সবকিছু কি শুধু টাকাতেই সীমাবদ্ধ?

★ প্রতিদিন চিকিৎসকরা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ছে, মরণাপন্ন রোগির সেবা করতে গিয়ে মার খাচ্ছে, তার পরেও এদেশে বছর বছর মেডিকেল কলেজ সংখ্যা বাড়ছে, চিকিৎসক সংখ্যা বাড়ছে। এত খারাপ অবস্থা দেখেও সবাই চিকিৎসক হতে চান, এটা কি শুধু টাকা উপার্জনের কথা ভেবে না কি অন্য কোন কারনে?

★ যারা চিকিৎসক সমাজকে খারাপ বলে মুখে ফেনা তোলেন, আমিও তাদের দলে। আমি খারাপের বিরুদ্ধে। আসুন আমরা ভাল চিকিৎসকের, ভাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা করি, খারাপ চিকিৎসকের তালিকা করি। দেখি ৭০ হাজার চিকিৎসকের মধ্যে কতজন খারাপ?

★ আজ চিকিৎসকরা চিকিৎসা দেয়ার সময় মানবতার ধারক, বাহক, কিন্তু বিনা কারনে মার খাওয়ার সময় নূন্যতম একটা জীব হিসাবেও গণ্য হয় না। নারী চিকিৎসককে একদল পশু চুলের মুঠি ধরে দেয়ালে বাড়ি দিয়ে রক্তাক্ত করে আর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়,

"আজ ডাক্তার মেরে আসলাম"।

শিক্ষা ও সভ্যতা আজ সুশীলতার বুলিতে বন্দি,
মানবতার বাণী শুধু চিকিৎসকদের জন্য বরাদ্দ।

 

___________________
ডাঃ তরফদার জুয়েল
সাবেক শিক্ষার্থী - রাজশাহী মেডিকেল কলেজ।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়