আমার সমাজের মেয়েরা আক্রান্ত হলেও ভাঙ্গে না আমার ঘুম

ডা. রাজীব দে সরকার
_____________________________

ইমারজেন্সী বিভাগের টানা ডিউটি শেষ করে বাসায় এসে ঘুমাচ্ছিলো অরিন্দম।

অরিন্দমের ঘুম ভাঙ্গলো একা একাই।
ঘেমে গেছে অরিন্দম। চোখ খুলে নিজের ঘরটাকেও চিনতে পারছে না।

মোবাইলটা বাজছে,
সম্ভবতঃ এ কারনেই ঘুম ভেঙ্গেছে

- হ্যালো, কে?
- আমি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রী দেবেন্দ্রনাথের ছেলে আমি। তুমি এক সময় আমার কবিতা পড়েছো

- ও, কি চাই? কেন ফোন দিয়েছেন, কেউ অসুস্থ?
- হ্যাঁ অসুস্থ, তোমার সমাজের একদল পুরুষ খুব অসুস্থ।

- আচ্ছা কাল হসপিটালে পাঠিয়ে দেবেন, দেখে দেবো
- পারবে তো দেখে দিতে? আচ্ছা তোমরা কবিতা পড়া ছেড়ে দিলে কেন?

- কবিতা পড়া ছাড়িনি তো...
- মিথ্যা কথা, তোমরা এখন কবিতা পড়ো না, আগের পড়া কবিতাগুলো কোটেশন লিখে ফেইসবুকে পোস্ট করো, ব্লগে লেখো, কিন্তু কবিতা আর পড়ো না।

- ও, তাহলে বোধহয় ভালো লাগে না, আপনি লেখেন এখনো?
- না লেখার প্রয়োজন পড়ে না, কবিতা-গল্প কিছুই লিখি না

- কেন?
- তোমাদের সমাজে নিরুপমা, কেটি, বিনোদিনী, গোড়া কিংবা হৈমন্তী এরা আজো কেউ ভালো নেই... অপু সেদিনও ওরা বাবার করা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে নি, আজও পহেলা বৈশাখে হৈমন্তীদের সাথে নোংরামী করলো যারা তার প্রতিবাদও অপুরা করতে ভুলে গেছে

- নাহ প্রতিবাদ তো করেছে!
- দৌড়ে গিয়ে ফেইসবুকে বসে টিপাটিপি শুরু করলে তাকে কি প্রতিবাদ বলে? গান্ধী - মুজিবরা এই শিখিয়েছিলো তোমাদের?

- না, আমরা বীরের জাতি, আমরা অন্যায় সহ্য করি না।
- হয়তো এজন্যই আমি গল্প-কবিতা ছেড়েছি

- মানে?
- নিজেকে বীরের জাতি ভেবেই লেখালেখি করতাম, কিন্তু তোমাদের নির্বুদ্ধিতায় আমারই লেখা নারী চরিত্ররা আমাকে অপমান করে, আমারই লেখা ধর্মান্ধ চরিত্র গুলো আমাকে দেখে হাসে।

- পহেলা বৈশাখের কথা বলছেন?
- বাঙ্গালী হলে কি তোমাদের জাত চলে যায়? শাড়ি-টিপ পড়লে কি তোমাদের জাত চলে যায়? এতোই ঢিলেঢালা কেন তোমাদের জাত?

- আপনি রাজনৈতিক কথা বলছেন।
- মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম
আজি নব প্রভাতের শিখর চুড়ায়;
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম,
ফিরিবার পথ নাহি

- থামেন, মাঝরাতে কবিতা ভালো লাগছে না
- থামলাম, কিন্তু মানুষের চিকিতসার পাশাপাশি সমাজের চিকিতসা শুরু করো ডাক্তার

- সে দায় কি আমার একার নাকি?
- দায় আমাদের সবার, হৈমন্তীর গা থেকে কাপড় খুলে নেওয়া হলে ওর আগে তোমার সমাজ ল্যাংটা হবে, তুমি ল্যাংটা হবে - সাদা পাঞ্জাবী পড়ে শরীরের কালো লুকানো যায়, মনে কালি না
তাই সমাজের চিকিতসা করার দায় ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-বণিক-শিক্ষক-ছাত্র-সাহিত্যিক-ব্লগার সবার

- কি করবো?
- তোমার যতোটুকু করার আছে

- যদি আমার ক্ষতি হয়?
- তোমার ঘরের সামনে তোমারই প্রেয়সীর কাপড় ধরে টানা হলো, এর থেকে আর কি ক্ষতিই বা হতে পারে। এটা তো ১৯৭১ না, নাকি তোমরা মনে করো মরে যাওয়া পাকিস্তানি হানাদার গুলো তোমাদের শরীরে আবার জন্ম নিয়েছে?

- ছিঃ ছিঃ এসব কি বলেন?
- আমার লেখা গানটাকে এবার ছেড়ে দাও, ওটা নিয়েও তোমাদের জাতের রশি ঢিলে হয়ে যাচ্ছে, তাছাড়া এক মালাউন কবির গান দিয়ে কেন তোমরা দেশের সব শুভ কাজ শুরু করবে?

- আমার ঘুম পাচ্ছে, কাল সকালে হসপিটালে যাবো
- বেশ, বাঙ্গালী, জাতি হিসেবে তুমি ঘুমিয়ে যাও, ঘুমিয়ে থাকো, ঠিক যেমন করে আমার নোবেলটি চুরি গেলো, তোমার-তোমাদের প্রতিবাদ করার শক্তিটুকুও নিঃশব্দে চুরি গেছে তা তোমরা জানো না

- আচ্ছা আপনি আমাকে এসব বলছেন কেন, হ্যালো... ... শুনছেন...
- টু... টু... ... টুট...টু

অরিন্দম আবার ঘুমিয়ে গেলো, অনেক গভীর সে ঘুম...

অরিন্দমের সামনে ওর সমাজের মেয়েরা আক্রান্ত হলেও ভাঙ্গে না সেই ঘুম....

__________________________________

ডা. রাজীব দে সরকার
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মহাখালী, ঢাকা।