Ameen Qudir

Published:
2017-05-08 17:04:33 BdST

সুপারি গাছের ঢোংগোল -বিয়ারিং গাড়ী এবং স্কাইলাইন লিউজ (Luge)


 
ডা. নুরুল হাসান বাবু
__________________________

 

প্রেক্ষিত-১-

আমরা যারা ৮০ বা তার পূর্ববর্তী দশকের বাংলাদেশী শিশু- কিশোর তাদের অতিপ্রিয় দুই স্বপ্নযান ছিল-এক সুপারি গাছের খসে পড়া পাতা সহ বৃন্ত - সহজ দেশী নাম "ঢোংগোল "- তাতে মাদুরের মত চওড়া অংশে একজন বসত আর অন্যজন সামনের পাতার অংশ ধরে টেনে নিয়ে চলত ।

মাঝে মধ্যে সামনের মূল চালক পাতা জোরে টেনে দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ ছেড়ে দিলে পিছনে বসে থাকা বাবু গতি জড়তায় হুড়মুড়িয়ে পড়ে হাত-পায়ে ধুলো মাখা , শরীরের ছাল যাওয়া , জামা-প্যান্ট ছেড়া থেকে শুরু করে সামনের দাঁত ভাংগা পর্যন্ত বিভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন ও পরে বাসায় ফিরে আরেক দফা নির্ঘাত পিটুনি পুরস্কার পেত। তবুও অতিপ্রিয় ছিল সাধের সেই ঢোংগোল । উঁচু সুপারি গাছের পানে চেয়ে একা-একা আল্লাহর কাছে কত প্রার্থনা -আল্লাহ ঢোংগোলটা এক্ষুনি গাছ থেকে খসিয়ে দিয়ে আমাকে এই মহামূল্যবান ঢোংগোল গাড়ির মালিক বানিয়ে দাও।

 

মাঝরাতেও এই ঢোংগোল গাছ থেকে টিনের চালে পড়লে সেই রাতেই তাকে উদ্ধার করে গোপন যায়গায় না লুকানো পর্যন্ত ঘুম তো দুরের কথা দুচোখের পাতা বন্ধ করতনা সে যুগের ঢোংগোল শিকারীরা ।

ঢোংগোল গাড়ী প্রকৃতি প্রদত্ত Full natural হলেও দ্বিতীয়টি অবশ্য ছিল মেকানিকাল -দারুন ইন্জিনিয়ারিং বুদ্ধিমত্তার আবিস্কার -'তিনচাকার বিয়ারিং গাড়ি' । গাড়ীর কাঠামোতে ছিল মোটরযানের বা রিক্সার নষ্ট হয়ে যাওয়া তিনটা বিয়ারিং যা একটা সামনে আর দুইটা পিছনে মূলত গোল করে কাটা শক্ত গাছের ডালের ভিতর ঢুকিয়ে ত্রিকোন এক গাড়ি তৈরী হত । যাতে একজন বা দুজন চড়ে সামনের দন্ডাকার হ্যান্ডেল পা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হত । তেল-মবিলে নয় চলত পিছনে ঠেলাগাড়ি ঠেলার মত একজনের ঠেলার কঠিন সহযোগীতায় । পালাক্রমে একজন বসত অন্যজন ঠেলত- তবে খাড়া ঢালু এলাকায় ছেড়ে দিলে মধ্যাকর্ষনে সেই গাড়ি আপনা-আপনি অতি দ্রুত দৌড়াত-এরুপ অবস্থায় দক্ষ রাইডার না হলে প্রায়শই চিৎপটাং.... । .সেই সময়ে এরুপ একটা বিয়ারিং গাড়ির মালিক একজন শাহেনশাহ এর সমান গৌরবান্নিত . ....যত বড় বিয়ারিং তত ষ্ট্রং গাড়ি ...মহামূল্যবান দূর্লভ ছিল এই বিয়ারিং ...কিনতে পয়সা লাগত বা মহাখাতির থাকতে হতো রিক্সাওয়ালা ,বাস - ট্রাক ড্রাইভার বা তাদের মেকানিকদের সাথে ।

 

আমার নিজের এই গাড়ী ছিল না কারন ঐ গাড়ির মূল উপাদান বিয়ারিং সংগ্রহের জন্য খাতিরের রিক্সাওয়ালা বা ড্রাইভার অথবা কেনার জন্য বাবার কাছে টাকা চাওয়ার সাহস কোনটাই ছিলনা আমার। আমার গুনধর দুই মামাত ভাই সামছুল আর জামাল খানের ঢাউস এক গাড়ীতে আর আমার বাল্যবন্ধু প্রদীপের গাড়ীতে পিছনে অতিরিক্ত সময় ঠেলার চুক্তিতে সেই গাড়ীতে চড়ার সুযোগ পেতাম। সামছুল-জামাল ভাই আমার বয়সে অনেক বড় তাই তাদের কৃপা পেলেও বন্ধুবর প্রদীপ গাড়ীতে চড়ে সামনে যতক্ষণ না বসতে দিত তার চেয়ে অনেক বেশী সময় পেছনে ঠেলতে লাগিয়ে দিত আমায় । প্রদীপের পিছনে দৌড়ে রেলষ্টেশনের কুলির চেয়ে বেশী শ্রম দিতে হত ,তাতে কি- সে এক মহা আনন্দ ..trilling -huge adrenaline rush activity of our dreamy days ..এখনকার Super thrilled Roller coaster এ চড়া প্রজন্ম সে আনন্দ বুঝবে না...what a nonsense thing & thinking বলে নাক সিটকাতেও পারে .....

 

প্রেক্ষিত-২-
"Once is never enough" প্রমোর শ্লোগানটা দেখে হাসছিলাম আর মনে মনে বলছিলাম -বিজ্ঞাপনে ব্যবসায়ীরা কত কিনা বলে but it's a good dialogue for attracting people. -বলছিলাম এশিয়ার সবচেয়ে রোমাঞ্চকর Play activities এর স্বর্গ সিংগাপুরের সেনটোসা আইল্যান্ড এর unique হুইন্ড গ্রাভিটি গেম লিউজ (Luge) এর কথা । লিউজ (Luge) মধ্যাকর্ষন শক্তির অনুকুলে চলা জ্বালানি বিহিন একটি তিচক্রযান যার আবিস্কার নিউজিল্যান্ডে আর দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় সিংগাপুরেই এর একমাত্র দেখা মিলে ,Skyline নামের বিখ্যাত amusement জায়েন্ট এর পরিচালনার দায়িত্বে । তবে আমি নিশ্চিত আমাদের সেই তিন বিয়ারিং গাড়ীর মডেলকেই বুদ্ধি খাটিয়ে আধুনিক রূপায়নে তৈরী হয়েছে এই আধুনিক Luge ; আমরা কবে রাবিস বলে নাক সিটকে ছুড়ে ফেলেছি সেইদিনের বিয়ারিং গাড়ী আর পশ্চিমীরা এখন সেই একই প্রকৃতির নতুন এই যানে নতুন আকার, গতির উৎস , স্বেচ্ছায় চলনক্ষমতা, এন্টি গ্রাভিটি ষ্ট্রং ব্রেক সিস্টেম ইত্যাদি বুদ্ধি সংযোজিত করে দুই হাতে লুটিয়ে নিচ্ছে লক্ষ-হাজার ডলার। দিন-রাত সকল বয়সের হাজারো মানুষ পকেট খালি করেও দীর্ঘ লাইনে দাড়িঁয়ে এই Luge গাড়ীতে চড়ে আনন্দ নেবার জন্য পাগল হয়ে ছুটছে।

এবার সিংগাপুর ভ্রমনে আমার আর Taposh Bose দাদার পরিবার মিলে মোট সদস্য সাত জন। সবার মত আমরাও ছুটলাম । এক্সপ্রেস টিকেট থাকায় লম্বা লাইনে দাড়াতে হল না বেশীক্ষণ। যুদ্ধ যাবার প্রস্তুতির মত সবাইকে হেলমেট পড়তে হল । হেলমেট পড়াতে সিনিয়র দুই মহিলা সদস্য শম্পা আর বৌদি তাতে না চড়ার জন্য একটু না নতর শুরু করলেও অন্যদের উৎসাহ আর আগ্রহে আর পিছনের অপেক্ষমাণ জনতার চাপে তারা স্বস্ব গাড়ীতে চেপে বসতে বাধ্য হলো । প্রস্তুতি আয়োজন ও পরিচালনাকারী সদস্যদের Safety instructions শুনে আমার বুকটাও একটু আধটু ধুকপুক করলেও যা করে আল্লায় বলে আমার বিশাল দেহটা চাপিয়ে দিলাম এই তিন চাকার ছোট খেলনা যানে । Luge এ চড়ে সামনের হ্যান্ডেল পেছনে টানতেই দৌড়াতে শুরু করল সেই আনন্দযান । প্রায় ১.৪ কিলোমিটারের সুন্দর গ্রাভিটি ট্রাক ..হ্যান্ডেল যত পিছনে টানি গাড়ীর গতি মধ্যাকর্ষন এর দিকে অত দ্রুত হয় । কিছুক্ষণ চলার পর আসল মজা পেয়ে ভয় কেটে গেলে শুরু হয়ে গেল একে অন্যকে টপকানোর বাংগালির race. রেসের পাল্লায় পড়ে অতি দ্রুতই পৌঁছে গেলাম ট্রাকের শেষ প্রান্তরে । হ্যান্ডেল সামনের দিকে ছেড়ে দিলে তিনচাকার সাধের গাড়ি ব্রেক কষে থেমে গেল । নামতে নামতে মনটা সেই ৩০/৩৫ বছর আগের শৈশব কৈশোরের মত আবার এই মজা নিতে চাইল....সত্যিই শুধুই বিজ্ঞাপন নয়- Once is never enough - একবার নয় বারবারে চড়েও সাধ মিটবে না এই সাধের তিনচাকার গাড়ী Luge এ.....যেমন মিটতো না সেই সময়ের ঢোংগোল বা বিয়ারিং গাড়ীতে....
_______________________

ডা. নুরুল হাসান বাবু। সুলেখক।কথা সাহিত্যিক।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়