Ameen Qudir

Published:
2017-05-07 02:21:48 BdST

চিকিৎসক আমদানী নিয়ে কিছু সোজা সাপটা কথা


 

ডা. এনামুল হক চৌধুরী
__________________________________

বিগত বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের শিল্পী সমাজ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিদেশী কোনো নাটক- সিরিয়াল প্রচার না করার জন্য আন্দোলন- সংগ্রাম করে আসছেন। চিকিৎসা পেশার সঙ্গে তুলনা করলে, দেশে উৎপাদিত হয় এমন ঔষধ আমদানী করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, কোনো টিভি চ্যানেলে বিদেশী সিরিয়াল- নাটক প্রচার করা। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে যা হচ্ছে তা ভিন দেশী পরিচালক, শিল্পী, কলাকুশলী এনে নাটক- সিরিয়াল বানানোর মতোই। কল্পনা করতে কষ্ট হয় না, এমন ঘটনা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ঘটলে শিল্পী সমাজ দেশে কুরুক্ষেত্র বানিয়ে ফেলতেন। এবং এটাই স্বাভাবিক। এরই নাম পেশার প্রতি মমতা- ভালোবাসা, সর্বোপরি দেশপ্রেম। আর আমাদের চিকিৎসকেরা...!

বাংলাদেশে আজকাল একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠা করা যত কঠিন, তার চেয়ে লক্ষ- হাজার গুণ সহজ মেডিকেল / ডেন্টাল কলেজ খোলা! মুদি দোকান চালু করার চেয়ে ডায়াগনস্টিক ল্যাব / ক্লিনিক করা ঢেড় সহজ! এখন দরকার প্রচার। প্রচারের জনপ্রিয় উপায় হচ্ছে- 'ফ্রি চিকিৎসা' নামক এক প্রকার ভন্ডামী। কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান স্বার্থচিন্তা বাদ দিয়ে আম জনতার প্রতি দরদের কারণে 'ফ্রি চিকিৎসা' দিবেন, তা কী বিশ্বাসযোগ্য কোনো কথা?

যত্রতত্র মেডিকেল / ডেন্টাল কলেজ / ডায়াগনস্টিক ল্যাব / ক্লিনিক চালু করা থেকে 'ফ্রি চিকিৎসা' দেওয়া পর্যন্ত কারও কোনো প্রকারের আপত্তি থাকার কথা নয়। কারণ মুক্ত বাজার অর্থনীতির দেশে বাণিজ্য করার অধিকার যেমন এক পক্ষের আছে ঠিক তেমনি বাণিজ্যের শিকার তথা উপাদান হওয়ার অধিকারও অপর পক্ষের আছে। সব চেয়ে বড় কথা, এই সব বিষয় বিশেষ করে জনস্বাস্থ্য- জনস্বার্থ দেখভালের জন্য রাষ্ট্র- সরকার আছে। তাঁদের আপত্তি না থাকলে আমার আপনার বাদ- প্রতিবাদ তো ধোঁপে টিকে না। কিন্তু আপত্তিটা অন্য জায়গায়...।

বৎসরের বিশেষ ক'টি দিনে বাংলাদেশের মানুষ যারপরনাই দেশপ্রেমিক। বাকী দিনগুলোতে বিদেশপ্রেমিক হতে চক্ষু লজ্জা পর্যন্ত ত্যাগ করতে সময় নেন না! বিদেশী সব কিছুই তার চাই। দেশীটা যত ভালো কিংবা যত কম দামই হোক না কেন! আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ/ হাসপাতাল / ডায়াগনস্টিক ল্যাব। আম- জনতার সহজ দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তারা এখন বিদেশী ডাক্তার দিয়ে 'ফ্রি চিকিৎসা' ক্যাম্পের আয়োজন করছে! আরও আশংকার বিষয়, ইদানিং বেশ ক'টি বেসরকারি হাসপাতালে বিদেশী ডাক্তার নিয়োগ দিতে দেখা যাচ্ছে! তাও আবার যে সব বিষয়ে আমাদের দেশে পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন সেই সব বিষয়ে!

স্বাস্থ্য বিভাগে এত যে নৈরাজ্য, তাতে কারো কোনো মাথাব্যথা আছে বলে তো মনে হয় না! না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, না বিএমডিসি (বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল), না বিএমএ (বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন), না স্বাচিপ (স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ)- ড্যাব (ডক্টর এসোসিয়েশন অব্ বাংলাদেশ), না সরাসরি ক্ষতির (আর্থিক, মানসিক, সামাজিক...) স্বীকার চিকিৎসক সমাজ বিশেষ করে পরামর্শক (কনসাল্টেন্ট) থেকে অধ্যাপক পর্যায়ের চিকিৎসক!

 

 

বাংলাদেশ থেকে মালদ্বীপে চিকিৎসক রপ্তানির বিজ্ঞাপন সারা বৎসর ধরে প্রচার হতে থাকে। মালদ্বীপের বাংলাদেশী এজেন্টরা কী কাকুতিমিনতিই না করেন চিকিৎসকদের মোবাইলে! আর মালদ্বীপে পৌঁছে ঠিকই এক জন চিকিৎসককে সেই দেশে চাকুরির লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়, পাশও করতে হয়। আমাদের বিএমডিসি কখনও কোনো বিদেশী চিকিৎসকদের কোনো রকমের পরীক্ষার ব্যাবস্থা করেছে? সেই চিকিৎসকদের সনদপত্র ঠিক- ঠাক আছে কি না যাচাই- বাছাই করেছে? খোদ রাজধানীর অভিজাত একটি হাসপাতালে যদি বাংলাদেশের এক জন নাগরিক মিথ্যা পরিচয়ে কনসাল্টেন্টের চাকুরি পেয়ে যায় (ঐ লোকের ন্যূনতম এমবিবিএস ডিগ্রী পর্যন্ত ছিল না!), অতি সম্প্রতি ঢাকার নামকরা একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চট্টগাম শাখাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের এক জন সাবেক ওয়ার্ড-বয় যদি সহকারী অধ্যাপক পরিচয়ে রোগীর চিকিৎসা দিতে পারে, তাহলে বিদেশীদের যোগ্যতা কে বিচার করবে?

 

 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী -সচিবেরা কেউ চিকিৎসক নন। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিংবা বিএমডিসি তো চিকিৎসকদের নেতৃত্বে গঠিত। চিকিৎসা পেশার প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতার কথা বাদই দিলাম, সাধারণ জনগণের স্বার্থ রক্ষা তো তাঁদের চাকুরির অংশ, না কী! বিএমএ, স্বাচিপ, ড্যাবের নেতাদের কথা আর কী বলবো? কোথায় তাঁরা পেশার পরে এত বড় অসম্মান- অবিচার- অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন, উল্টো তাঁদের কেউ কেউ বিদেশী চিকিৎসকদের নিজেদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে আমন্ত্রন জানাচ্ছেন, কেউ বা বিদেশী হাসপাতালের শাখা খুলছেন!

বাকী থাকলো, সরাসরি আক্রান্তরা অর্থাৎ পরামর্শক (কনসাল্টেন্ট) থেকে অধ্যাপক পদমর্যাদার বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা। একটি হাসপাতালে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ বিদ্যমান থাকা অবস্থায় ভিন দেশের বিশেষজ্ঞ আনা মানে দেশী চিকিৎসকটির প্রতি শুধু অনাস্থা প্রকাশ করা হয় না, আত্মসম্মানে আঘাতও হানা হয়। কথা হলো, আঘাতটা তিনি টের পেলেন কি না? সদ্য পাশ করা বিশেষজ্ঞের কথা বাদ দিলাম, যে সব হাসপাতালে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সিনিয়র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন, তাঁদের কোনো বাদ- প্রতিবাদ তো চোখে পড়ে না! অনেকেই যুক্তি দেন, তা হলে তো চাকুরি চলে যাবে। যাঁদের কথা বলছি তাঁদের কিন্তু চাকুরি না হলেও চলে। সামান্য কিছু কাগুজে নোটের চেয়ে মান- সম্মানটি ইতো এই বয়সে তাঁদের দরকার বেশি, না কি! সব চেয়ে বড় কথা, আমাদের শিল্পী সমাজ তো টিভি চ্যানেল গুলোর বিরুদ্ধেই আন্দোলন করছেন। তা হলে, বিশেষজ্ঞরা বিশেষ করে সিনিয়ররা কেন সেই সব হাসপাতাল বর্জন করতে পারেন না! তাঁদের প্রত্যেকের ঘরে কী ভাতের এত্তো অভাব!

 

 

কত কত বিষয়ে মাননীয় আদালত স্যুয়োমুটো রুল জারি করেন; কত কত দেশপ্রমিক জনস্বার্থে আদালতে রিট- পিটিশন দাখিল করেন। এই বিষয়ে সবাই কিন্তু চুপ! ভাবছেন, চিকিৎসা পেশা জাহান্নামে যাক, আমার কি, আমি তো বিদেশে চিকিৎসা নেব ইত্যাদি। কিস্তু আপনার আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া- প্রতিবেশী সবার কি বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ আছে? তা ছাড়া, জরুরি চিকিৎসা তো আপনাকে এই দেশ থেকে নিতে হবে। তার পর না হয় বিদেশ গেলেন। আর এক পক্ষ তো আরও এক কাঠি সরেস। বড় গলায় বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসকদের প্রতি মানুষের কোনো আস্থা নেই। তাই বিদেশে চিকিৎসা নেওয়া কিংবা বিদেশী চিকিৎসক আমদানী করা দোষের কিছু নয়। বলি, বাংলাদেশের সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ, কোন পেশার প্রতি মানুষের শতভাগ আস্থা আছে? তা হলে তো, প্রত্যেক পেশাতে লোকবল আমদানী করা শুরু করতে হয়? তা না হলে, বিদেশী একজন চিকিৎসকও আর আমদানী করা যাবে না। সাফ কথা। তবে হ্যাঁ, যে সকল বিষয়ে আমাদের পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ নেই, তার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা নিতে হবে। বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ এনে কিংবা দেশের চিকিৎসকদের বিদেশে পাঠিয়ে। আর যেই সব ব্যবসায়ী (চিকিৎসক কিংবা নন- চিকিৎসক) হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবসা করছেন, তাঁদের বলতে চাই, বাংলাদেশে আলু, পটল থেকে শুরু করে হাজার রকমের ব্যবসা আছে। তাতে মনোনিবেশ করুন। চিকিৎসা সেবার(!?) নামে দেশ বিরোধী, পেশাবিরুদ্ধ ব্যবসা আর নয়।

 

 

আজকে, চিকিৎসা পেশার করুণ অবস্থায় যাঁরা দাঁত কেলিয়ে বিকৃত সুখের ঢেঁকুর তুলছেন তাঁদের বলতে চাই, চোখ বন্ধ রাখলেই প্রলয় বন্ধ থাকে না। পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের হতবিহবল অবস্থার সুযোগ না নিয়ে, সাহায্যে এগিয়ে আসতে হয়, আগুন নিভিয়ে দিতে হয়। না হলে, সেই আগুন আপনার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় খুব বেশি লাগবে না। আর তাই, আসুন মহৎ চিকিৎসা পেশা ধ্বংসের দেশি- বিদেশী চক্রান্তের বিরুদ্ধে সম্মিলিত ভাবে রুখে দাঁড়াই। অবশ্যই, শুরুটা হতে হবে চিকিৎসকদের মাঝখান থেকেই। সাধারণ চিকিৎসক, ড্যাব- স্বাচিপ, বিএমএ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সর্বোপরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের 'উট পাখি' এর ভূমিকা থেকে বের হয়ে আসার আর কোনো বিকল্প নেই। এবং সময়ও খুব বেশি নেই।

_____________________________

ডা. এনামুল হক চৌধুরী
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ
মেমন মাতৃসদন হাসপাতাল
চট্টগ্রাম।
প্রাক্তন ছাত্র
খুলনা মেডিকেল কলেজ(২য ব্যাচ)।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়