Ameen Qudir

Published:
2016-11-22 19:21:49 BdST

'"একা মা'" (অথবা 'একা বাবা' )


ছবিগুলো মডেল ছবি।

 

____________________________________________

 

ডা. নাসিমুন নাহার


__________________________________

#আমি কান্নাবান্ধব মেয়ে নই,মানুষ তো কিছুতেই নই।
বেশ কয়েক বছর আগেই তুমুলবেগে কান্না আর মন খারাপের সাথে চুক্তি করেছি-- 'উহাদের সঙ্গে আমার আঁড়ি'।তারপরও as a normal Human being আমিও কাঁদি। আমার বেশিরভাগ পোস্টই আমি কাঁদতে কাঁদতেই লিখি।কারন- এখনও জানি না ।লেখার পর মোবাইল হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ি।ঘুম থেকে ওঠার পর সবকিছু ঠিকঠাক।একমাত্র এই একটা প্ল্যাটফর্মেই আমি খুব সহজেই খুব কঠিন কথাগুলো বলে ফেলতে পারি (যা আমি এই অত্যন্ত অদ্ভুত সমাজকে চিৎকার করে বলতে চাই)


অফিস থেকে দুইদিনের সাপ্তাহিক ছুটি সহ মোট সাতদিনের লম্বা ছুটি নিয়েছে নিশি। একটু আগে আম্মুকে এ কথা বলার পর তার রিএ্যাকশন ছিল এরকম --- 'খুব ভালো কাজ করেছিস। বাচ্চার ফাইনাল পরীক্ষা বেশি গুরুত্ব পূর্ণ নাকি অফিস !! অফিস তো সারাবছরই করতে পারবি।কিন্তু পরীক্ষার সময় টুকুনের এখন তোকে বেশী প্রয়োজন।'
কথা খুবই সত্যিই।তবে শুধু পরীক্ষার সময়ে নয়, একজন 'একা মায়ে'র সন্তানের জন্য একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত মা'কে আসলেই খুব খুব খুব বেশিই প্রয়োজন সন্তানের।

 

 

#ব্রোকেন ফ্যামিলি এবং #সিঙ্গেল প্যারেন্টের মতো সেনসেটিভ ইস্যু নিয়ে অনেকেই অনেকবার বলার পরেও লেখা হয়ে ওঠেনি। ইনশাআল্লাহ কোন একদিন লিখব ,যেদিন আমার সন্তানকে নিয়ে মাথা উঁচু করে এই কুৎসিত সমাজকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারব----'মানুষের জন্য সমাজ, আমিই আমার সমাজ'।
ভবিষ্যত সেই লেখার কিছু অংশ সবার সাথে শেয়ার করলাম---------------

 

#সবার প্রথমে একটা ব্যাপার পরিষ্কার করা প্রয়োজন। আমাদের সমাজটা তো ভীষণ অদ্ভুত।তাই আমাদের সমাজে নিত্য অশান্তিতে, অসুস্থ পরিবেশে, দিনের পর দিন একই ছাদের নিচে ভিন্ন রুমে কিংবা মাঝখানে কোলবালিশের দেয়ালে সংসার ধর্ম পালনে, কখনও বা পরকীয়া করেও সংসার টিকিয়ে রাখাকেই বেশি প্রেফার করা হয় আলাদা হয়ে যাওয়ার থেকে।
কিন্তু আমাদেরকে এটাও মাথায় রাখতে হবে --পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ ইউনিক, প্রতিটি মানুষের ভাবনা চিন্তা জীবনবোধ একদমই ভিন্ন, ব্যাখ্যাতীত রকমের ভিন্ন হতে পারে।কারো কারো কাছে সমাজ কি বলবে, কি ভাববে এসব ভাবনা ভাবার থেকেও thousand times গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক একটা জীবন কাটানো, অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সম্মান এবং ভালোবাসাময় একটা জীবন, যেখানে নিজের সাথে মিথ্যে 'সুখী কাপল' হবার অভিনয়ের কোন সুযোগ নেই, সবাই পারে না নিজ সংসারে বেঁচে থেকেও রোজ রোজ মরে যেতে।
যারা বলে, 'সন্তানের জন্যই নিত্য অশান্তি সহ্য করেই সংসার করে যাচ্ছি'।তাদের জন্য আমার একটাই কথা--- যে সন্তান প্রতিদিন বাবা কে দেখে মায়ের গায়ে হাত তুলতে অথবা যে সন্তান বোঝার বয়স থেকে দেখে আসছে বাবা মা দুজন ভিন্ন রুমে থাকে , কখনো একসাথে খেতে পর্যন্ত বসে না সেই সন্তান বড় হয়ে আর যাই হোক না কেন একজন সুস্থ ফ্যামিলি ম্যান/ওম্যান হতে পারে না কিছুতেই।নিজের জীবন দিয়ে এই কথার সত্যতা দেখেছি আমি। প্রমান লাগলে বলবেন, হাজার হাজার ছেলে আর মেয়ে সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিব।

 

 

 

তবে সবথেকে বড় কথা হলো---- কোন মানুষ হোক ছেলে কিংবা মেয়ে স্বেচ্ছায়/মনের আনন্দে/ শখের বশে 'single' অথবা 'ডিভোর্স' হতে কখনোই চায়না।
একমাত্র এই পথে জার্নি করার দুর্ভাগ্য এবং দুঃসাহস যে ছেলেটা /মেয়েটা করেছে সেই জানে এক-এক ফোঁটা চোখের জলের দাম,এক একটা নির্ঘুম রাত, এক একটা সিডেটিভের পাতায়/সিগারেটের ধোঁয়ায় কাটানো মাসের পর মাস- বছরের পর বছর রাত, দিনের আলোয় সমাজ চ্যুত হবার অপমান, লোকের ফিসফিস, লোকের আঙ্গুল তুলে করা মন্তব্য, পরিবারের শব্দহীন বেদনা,মায়ের চোখের জল, বাবার হেট হয়ে যাওয়া মাথা, সমস্ত জীবনের হিসেব উল্টা করে দেয়া অংক এবং অবধারিত ভাবেই ডিভোর্সী মানেই মুখস্থ শব্দ 'চরিত্র হীনের' লেবেল, ছেলে/মেয়ে যাই হও না কেন মুক্তি নেই তোমার এই উপাধি লাভ করা থেকে।অবশ্য যে ছেলে/মেয়েটি এত বড় পৃথিবীতে একা চলার মতো দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে অথবা পরিস্থিতির জন্য সিদ্ধান্তটি মেনে নিতে বাধ্য হয়, আমার মনে হয়- সে থোড়াই কেয়ার করে এইসব লেবেল নিয়ে।

 

আপনাকে শুধু মনে রাখতে হবে, আপনি একা মানুষ হলেও আপনাকে নিতে হচ্ছে দুজন মানুষের দায়িত্ব এবং অবশ্যই আপনি সক্ষম এই দায়িত্ব পালনে।শুধু প্রয়োজন নিজের উপর আস্থা আর বিশ্বাসের।

 

 

 

 

#তবে পাশাপাশি আপনাকে এটাও মনে রাখতে হবে , আপনাকে কেউ দুকথা শোনানোর সুযোগ না পেলেও আপনার সন্তান কে কিন্তু আমাদের so called সমাজ এবং পরিবারের অতি পরোপকারী সদস্যরা ছেড়ে দিবে ভুল করেও তা ভাববেন না যেন।
স্কুল থেকে শুরু করে খেলার মাঠ, জন্মদিনের অনুষ্ঠান থেকে বিয়ে বাড়ি এমনকি হাসপাতালে রোগী দেখতে গেলেও কিন্তু আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে আপনার সন্তান।সুতরাং আপনাকে একদম শুরু থেকেই এই ইস্যুটা মাথায় রেখে সন্তানের মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।কাউকে এই ইস্যুতে একটুও ছাড় দিবেন না।হোক সে যত আপন আত্মীয় বন্ধু।কোন রকম offensive প্রশ্ন আসা মাত্রই তার সমুচিত জবাব দিতে হবে।মনে রাখবেন,এই সমাজ শক্তের ভক্ত নরমের যম।আপনি যদি বেচারি/বেচারা সেজে থাকেন সবাই আপনার সিঙ্গেল হবার ফায়দা নিতে চাবে, সব্বাই।তাই খুব পরিষ্কার করে নিজের অবস্থান বুঝিয়ে দিবেন।এতে সন্তানেরও মনে হবে, আমার মা/বাবা সব সময় আছে আমাকে পচা পরিস্থিতিতে রক্ষা করার জন্য।কিছুদিন পরে দেখবেন সন্তান একা একাই সুন্দর করে এই পরিস্থিতি সামলে নিতে শিখে যাবে।

 


#একটি শিশুকে লালন পালন করা কোন সহজ কাজ নয়।বাবা মা দুজন মিলেই অনেক সময় হাপিয়ে ওঠে সেখানে একা এত বড় দায়িত্ব। এজন্য শিশু মনস্তত্ত্ব নিয়ে নিয়মিত পড়াশোনা করা উচিত।প্রয়োজনে নিজে প্রফেশনাল কাউন্সিলিং এর সাহায্য নিতে পারেন।
যদিও আমাদের দেশে parenting নিয়ে লেখাপড়ার আবশ্যকতা রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ। সন্তান জন্ম দিলেই বাবা মা হয়ে যাওয়া যায় !
এই ভাবনার দিন শেষ। মনে রাখা দরকার parentingও একটা শেখার বিষয় বটে।

 

#যেহেতু আপনি একাই সন্তানের মা এবং বাবার দায়িত্ব পালন করছেন সেহেতু আদর আর শাসনের সুষম বন্টন খুব জরুরী সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য।তবে ভালোবাসার কোন কমতি যেন না হয় কখনোই তা নিশ্চিত করতে হবে।এই বাচ্চাটার আসলে তো কেউ নেই পৃথিবীতে এক আপনি ছাড়া।আপনার তো তাও বাবা মা ভাই বোন আছে।বাবা/মায়ের শূন্যতা কখনোই পূরণ হবার নয় এটা যেমন সত্য।ঠিক তেমনি এটাও সত্য একমাত্র ভালোবাসাতেই জীবনের সমস্ত শূন্যতা পূরণ হয়ে যায়।সন্তানের সাথে আপনি না হয় আরেকবার জীবনের রোলার কোস্টারে চড়লেন।দেখবেন, নিজের শূন্যতা আপনাকে খুঁজেও পাচ্ছে না।

 

 

তুলনা করা খুবই খারাপ একটা প্রাকটিস আমাদের সমাজে।অন্য পরিবারগুলো কি দিচ্ছে বা কি করছে সন্তানের জন্য এসব তুলনায় না যেয়ে আপনি কি করছেন এবং কি পারছেন/পারবেন সন্তানের জন্য এটা ভাবা জরুরি।মনে রাখতে হবে, প্রতিটি পরিবারের একটা নিজস্বতা
আছে।আপনার এবং আপনার সন্তানের এই টুনটুনি সংসারের নিজস্বতা আপনারা দুজন মিলে ঠিক করবেন।

 

#Single parent অথবা ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান হওয়া কোন পাপ নয়, তাদের জন্ম অবৈধ নয়, নয় তাদের জন্ম পদ্ধতি ভিন্ন।তাদের মা তাদেরকে ছত্রিশ/সাঁইত্রিশ সপ্তাহ গর্ভে ধারণ করেই পনেরো থেকে বিশ ঘন্টার লেবার পেইন সহ্য করেই জন্ম দিয়েছে।তাদের বাবা মায়ের কোন এক প্রেমময় মূহুর্তে ই হয়তো সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় এই সন্তানের জন্মলগ্ন মাতৃজঠরে।হুম পরবর্তীতে যেকোন কারনে তাদের পিতা মাতার একসাথে আর থাকা হয়ে ওঠেনি।কিন্তু তার জন্য কখনোই সন্তানের জন্ম অশুদ্ধ হয়ে যায় না।
বাবা মায়ের সিদ্ধান্তের জন্য,এমনকি যা ধর্ম এবং সমাজ সম্মত পর্যন্ত, সেই সিদ্ধান্তের জন্য সন্তানকে কেন সারাজীবন নিজেকে 'ভিন্ন' ভেবে বড় হতে হবে? কেন বেশীরভাগ ব্রোকেন ফ্যামিলির বাচ্চা এই মিথ্যা শিখে বড় হয় ----বাবা(কখনোবা মা) বিদেশে থাকে !! কেন কেন ??? একটা সত্য কে ঢাকতে যেয়ে কেন হাজারটা মিথ্যের সাথে বসতি স্থাপন করতে হবে ??

 


#সত্য জেনে যে নিশি এবং তার সন্তানের জীবনে থাকবে সে থাকবে আর যার তাদের অচ্ছুৎ মনে হবে সে নিজের রাস্তা দেখতে পারে, সে যেই হোক না কেন।হুমম , নিশির ছেলেকে যেদিন সিঙ্গেল মা হিসেবে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়েছিল সেদিনই সে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।যদিও তার মা বারবার করে বলে দিয়েছিল --বাবা বিদেশে থাকে এটা বললে কি এমন অশুদ্ধ হয়ে যাবে ? নিশি দৃঢ় কন্ঠে বলছিল --- আমার ছেলের আইডেন্টিটি ই অশুদ্ধ হয়ে যাবে মা। তুমি ভাবছ ডিভোর্সীর ছেলে জানলে কেউ টুকুনের সাথে মিশবে না, তাই তো ? দরকার নেই মিথ্যে দিয়ে বন্ধুত্বের।আমার ছেলে যদি নিজের যোগ্যতা, আচার, ব্যবহার দিয়ে বন্ধু এবং শিক্ষকদের মন জয় করতে পারে, তাতেই চলবে।সামাজিক সমস্যাকে আর ভয় পাই না মা। বাংলাদেশের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন কোন নিয়ম নেই যে, একা মায়ের সন্তান সে স্কুলে ভর্তি হতে পারবে না।আর যদি থাকেও ঐ স্কুলে কোনদিনই আমার টুকুনকে পড়তে হবে না।

 

 

সব শেষে একটা কথা বলতে চাই, হিউম্যান সাইকোলজি খুবই জটিল ব্যাপার।কখন কি মনে হবে তার উপরে আমাদের কারো হাত নেই।তাই কখনোই মনের ভেতরে এই অস্বস্তি দানা বাঁধতে দিবেন না যে, আমার জন্য আমার সন্তান বাবা মা দুজনকে একসাথে পেল না জীবনে।এটা একটা পরিস্থিতি সাপেক্ষ ইস্যু।আর এই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রক হচ্ছে --- প্রকৃতি।

#It's LIFE, জীবনে তাই ঘটবে যা সৃষ্টিকর্তা চাইবেন।আমি আপনি কে তা বদলে ফেলার! অথবা 'আমার কপালেই কেন এমন হলো?' এই প্রশ্নের কারন বুঝে ফেলার।বরং এটা ভাবুন, সৃষ্টিকর্তা আপনাকে এতটাই যোগ্য মনে করেন যে, একই সাথে সন্তানের বাবা এবং মা হবার মতো সৌভাগ্য এবং যোগ্যতা আপনাকে দিয়েছেন।দেখবেন, জীবনটাই বদলে গেছে আপনার।আর একা হাতে সন্তান সংসার লালন পালনের যে সাহসিকতা আপনি দেখাচ্ছেন এবং পাশাপাশি শুধু নিজের জন্য না ভেবে, নিজেকে সামলে নিয়ে এই যে 'মা সন্তান'/'বাবা সন্তান' এর জার্নি আপনার, সেজন্য নিজেকে নিজে একটা ধন্যবাদ দিন না প্লিজ।
মনে রাখবেন- Life is all about practice.
_________________________

 

 


লেখক ডা. নাসিমুন নাহার দরদী কথা সাহিত্যিক। জনপ্রিয় চিকিৎসক। জনপ্রিয় কলামিস্ট।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়