Ameen Qudir

Published:
2017-03-28 01:23:01 BdST

প্রেম যখন পাগলামী


 

অধ্যাপক ডা.মো. তাজুল ইসলাম

_______________________________

 


মিসেস রুবি,বয়স যখন ১৩ তখন ৩৫ বছর বয়সী একজনের সঙ্গে মা বিয়ে দেন।

বর্তমানে বয়স ৩৫ ও দুই ছেলের মা।বিবাহের বয়স ২২ বছর।

বাবা মারা গেছেন।বড় বোনের জন্য ঐ লোকের আগ্রহী ছিল, কিন্তু বড় বোনের অন্যত্র সম্পর্ক থাকাতে বড় বোন সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

মা তখন তার সঙ্গে বিয়ে দেয়।তিনি খুব একটা প্রতিবাদ করতে পারেননি।

তার ভাষায় আমি বুঝতামই না বিয়ে কি জিনিস।

বিয়ের ৪ দিন পর শারিরীক সম্পর্ক হয় কিন্তু আমার কোন ফিলিংস ছিল না।

ওনার আগে একটি বিয়ে হয়েছিল এক এমপির মেয়ের সঙ্গে।কিন্তু সে মেয়ে ছিল " পাগল"।

তাই পরে ডিভোর্স হয়ে যায়।
বিয়ের ১৫ দিন পর উনি ব্র্নাই চলে যান।২ বছর পর ফিরে আসেন।

দেশে চাকরী নেন।আমি ও মেয়েদের জন্য একটি জিম খুলি।আমিই মূল ইনস্ট্রাক্টর। মাসে লাখ টাকার মতন আমার ইনকাম।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমার মানসিক, শারিরীক চাহিদা বাড়ে।

কিন্তু তিনি সে চাহিদা পূরন করতে পারেন না,সে নিয়ে তার কোন ভ্রুক্ষেপ ও নেই।

আমার পছন্দগুলো( কোথাও ঘুরতে যাওয়া বা খেতে যাওয়া) কোন গুরুত্ব দিতো না।

ধীরে ধীরে উনি কাছে আসলে বিরক্ত লাগতো।যেহেতু বিছানায় আমাকে তৃপ্ত করার তার কোন আগ্রহ ছিল না,ডাক্তার দেখাতে বললে তা এড়িয়ে যেতো,তাতে আমি হতাশ ও ক্লান্ত হয়ে পড়ি।

বলি তার চেয়ে তুমি দূরে থাকো।

এভাবে দুজন আলাদা রুমে ঘুমাতাম।ক্রমশ আমাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ে।

তাকে একদম সহ্য করতে পারতাম না।

নেটের যুগ আছে।ফেইসবুকে একজনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়।চ্যাট হয়,আলাপ হয়।

ছেলেটি দোহার থাকে।পরে ঘন্টার পর ঘন্টা টেলিফোনে কথা হতো।

সম্পর্ক গভীর হয়।
সে আমাকে বিয়ে করবে বলে।আমি না করি।

সে বলে তোমার সন্তান থাকুক,তুমি মোটা হও তাতে কিছু যায় আসে না,আমি তোমাকেই বিয়ে করবো।

আমি ভয় পেতাম এটি সম্ভব না।

ক্রমে সবাই বুঝে ফেলে।মা- বোন- স্বামী- সন্তান সবাই টের পেয়ে যায়।

আমার দুই ছেলে।সবাই বিভিন্ন ভাবে বাধা দেয়।কিন্তু আমি বাধা মানি না।

কয়েকবার ফোন ও নিয়ে নেয়। কাজ হয় না।

গতমাসে ঐ ছেলে দেশে আসে।আমার সঙ্গে দেখা করতে বাড়ীতে আসে।

কিন্তু ঘর ভর্তি লোক, কিভাবে বের হবো।

তাকে মানা করি।আমি উপর থেকে তাকে দেখি,কিন্তু ও দেখতে পায় না।

সে কাকুতিমিনতি করে ১ সেকেন্ডের জন্য দেখা করো।আমি যাই না।

এতে ও খুব কষ্ট পায় ও কাদতে কাদতে চলে যায়।

যেতে যেতে বলে( ফোনে) তুমি আমাকে অপমান করলে, আমি আর কখনো তোমার কাছে আসবো না।

পরে তাকে ফোন করি, সে বলে ফোন করার দরকার নেই।

সে দারোয়ানের কাছে আমার জন্য একটি গিফট এর লাগেজ রেখে যায়।

সেখানে দুটি স্বর্নের আঙটি,কানের দুল,বোরখা,চকোলেট, চা,ছুরি,খেজুর ছিল।

এগুলো দেখে বাসার লোক আরো ক্ষেপে যায়।ভাবে এই লোক তো যেভাবেই হোক আমাদের মেয়েকে নিয়ে যাবে।

৩ দিন পর ফেইসবুকে দেখি ১ টি মেয়ে গলায় ফাসি দিয়ে মারা যায়।তখন হঠাৎ মনে হলো আমার ও কি এ দশা হবে?

আমি চিৎকার করে ঐ ছেলেের নাম ধরে ডাকি,

রুম থেকে বের হয়ে পাগলের মতন তাকে খুজি,

বলি তুমি ফোন ধরো( যদিও তখন আমার কাছে ফোন নেই)।

তখন ছেলে ফোন দেয়। আমি ফোন করি, তার ছোট ভাই বলে ভাইয়া গোসল করছে পরে ফোন দেবে।সে ফোন করে।

আমি পাগলের মতন তাকে আসতে বলি,নিয়ে যেতে বলি।

সে বলে শান্ত হও,এমন করলে লোকে কি বলবে,আমি ১ সপ্তাহ পর আসছি।

এদিকে আমার অবস্হা খুব খারাপ।

দম বন্ধ হয়ে আসতো,

চিৎকার করতাম তুমি কোথায়?

খাওয়া দাওয়া বন্ধ,ঘুম নাই।

কাপড় চোপর খুলে বাইরে চলে যেতে চাইতাম,

ঘরের ভিতর দৌড়াদৌড়ি করতাম,

কান্নাকাটি করতাম।

বড় ছেলে বলে মা ওনার জন্য তোমার এতো মায়া আমাদের জন্য মায়া লাগে না?

আমার তখন ব্রেইন কাজ করতো না।

তাদের বলি বাবা আমি ওনাকে বিয়ে করবো তোমরা বাধা দিওনা।

স্বামীকে বলি তোমাকে ছেড়ে দেবো ওকে বিয়ে করবো।

স্বামী বলে ঠিক আছে তাকে আসতে বলো,এমনিতে তোমাকে কোথায় ছাড়বো।

তবু জিদ করি তালাক দাও।স্বামী বাধ্য হয়ে বলে ঠিক আছে কাজী অফিস এসো।

কিন্তু ঐ ছেলে ফোন ধরে না,কোন ভরসায় তালাক নেবো।

৭ দিন পর ঐ ছেলে আসে।তার সঙ্গে রিক্সায় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরি।

কয়েকদিন এ ভাবে তার সঙ্গে ঘুরি।

যখন তার সঙ্গে থাকি তখন সব ঠিক।

তাকে না দেখলে বা কথা বলতে না পারলেই অস্হির হতাম,পাগলামো করতাম।

এটি বাসার সবাই বুঝতে পেরে তার সঙ্গে ঘুরতে ও কথা বলতে দিতো।

কয়েকদিন পর সে বরিশাল চলে যায়।

এখন আর ফোন ধরে না।বলে ফ্যামিলি না করছে তাই বিয়ে করবে না।

সে অন্যত্র বিয়ে করতে চায়।

বলে আমরা ফ্রেন্ড হিসেবে থাকবো,

তোমার ছেলে স্বামী আছে তাদের নিয়ে থাকো।

সে যোগাযোগ করে না।

স্বামী ফোন নিয়ে নেয়।

বলে ফোন থেকে দূরে থাকলে আমি সব ভুলে যাবো, সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু আমার মনে সারাক্ষন তার কথা।

আত্মীয়দের পরামর্শে একজন সাইকলজিস্ট দেখাই।

তিনি ঘন্টাখানেক কথা শুনে ১ হাজার টাকা নিয়ে নেয়।

শুধু বলে" বলেন"

নিজে কিছু বলে না।বিরক্ত হয়ে আর যাইনি।

আপনি বিদেশ ছিলেন তাই কয়েকদিন অপেক্ষা করে আপনার দেখা পেলাম।

আমি কিভাবে ঐ ছেলেকে ভুলে যাবো তার ব্যবস্হা করেন।

..........................
এই কেইস হিস্ট্রি থেকে আমরা কি শিখতে পারি?

১। বাল্য বিবাহ ও সে বিয়েতে স্বামী- স্ত্রীর মধ্যকার বয়সের পার্থক্য খুব বেশী হলে যে অনেক সংসারে বিপর্যয় নেমে আসে তা নিয়ে সমাজকে আরো সতর্ক থাকতে হবে।

সংসার জীবনে পারস্পরিক বোঝা পড়া,মানসিক- শারিরীক - আবেগগত এডজাস্টমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ।

২। দাম্পত্য জীবনে সন্তোষজনক ও তৃপ্তিদায়ক শারীরিক সম্পর্ক একমাত্র না হলে ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ন বিষয়।

এ রকম যৌন সমস্যার ৮০-৮৫% মানসিক কারন সম্ভুত।

তাই যথাসময়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখিয়ে তার সমাধান না করে একে উপেক্ষা করে চললে, একসময় সম্পর্ক শীতল হতে পারে।এখানেও রোগীনি স্বামীর সঙ্গে এক বিছানায় শোয়াকে বিরক্তিকর, কষ্টদায়ক মনে করে ভিন্ন বিছানায় থাকতো

৩। তাকে সহ্য করতে পারতাম না,ভিন্ন বিছানায় থাকতাম-

অথচ এ রকম অস্বস্তিকর সম্পর্ক উন্নয়নে তাদের বা পরিবারের কোন কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি।

দাম্পত্য সম্পর্কে মাঝেমাঝে ভাটা পরতে পারে।

কিন্তু দীর্ঘ দিন শীতল ও বিদ্বেষ পূর্ন সম্পর্ক কখনোই কাম্য নয়।

বিদ্বেষ,ঘৃনা, তিক্ততা সময়ে কমে আসে না,বরং ব্যবস্হা না নিলে তা বাড়ে

এরকম ক্ষেত্রে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রফেশনাল সাহায্য নেওয়া জরুরী।

কেবল "পাগল" হলেই মানসিক সহায়তা নিতে হয় এ ধারনা বদলাতে হবে।

( এবার কিন্তু ঠিকই আমাদের কাছে এনেছেন।কেননা তারা ভাবছেন মেয়ে " পাগল" হয়ে গেছে)

৪। ফেইসবুকের অপব্যবহার আমাদের দেশে মাত্রাতিরিক্ত।

বেশীরভাগ এটিকে খারাপ উদ্দেশে ব্যবহার করেন অথবা অপ্রয়োজনে ব্যবহার করেন এ ব্যাপারে দ্বিমত করা যাবে না।

অনেক সামাজিক, পারিবারিক সমস্যার অন্যতম কারন হয়ে দাড়িয়েছে এই ফেইসবুক।

( আমরা প্রচুর সংখ্যক রোগী পাই ফেইসবুক ব্যবহার জনিত জটিলতার জন্য)

এর ব্যবহার এর ধরন কার কি রকম তা পরিবারে নিরীক্ষনের ব্যবস্হা থাকতে হবে।

একবার বদ স্বভাবে দাড়িয়ে গেলে তখন ফেরানো কঠিন( অনেকে আসক্তি পর্যায়ে চলে যায়)

৫। প্রেম- ভালোবাসা অহরহ হচ্ছে।

কিন্তু কখনোকখনো তা মানসিক,পারিবারিক, সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়।

আবার তা হঠাৎ মানসিক বিপর্যয় হিসেবে ও আসতে পারে( যেমন এ কেইস)।

তখন দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখানো জরুরী।

প্রয়োজন মত ঔষধ ও লাগবে।

মনে রাখবেন প্রেম বা আবেগের পিছনে রয়েছে মস্তিষ্কের রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপ।

তাই রাসায়নিক( ঔষধ) চিকিৎসার প্রতি নাক সিটকালে কাজ হবে না।

তাহলে পাবলিকের মনে কথায় চিড়া ভিজে না ধারনা জোরদার হবে।

৫। সাইকোথেরাপিতে শুধু বলে যান নিয়ে যে অভিযোগ রোগিনী করেছেন তা থেকে আমাদের( প্রফেশনালদের) যেমন শেখার আছে,রোগীদেরও কিছু শেখার আছে।

এটি ঠিক সাইকোথরাপিতে মনোযোগ দিয়ে শোনাটা গুরুত্বপূর্ণ,

উপদেশ বা সাজেশন দেওয়া কাজ নয়।

তবে থেরাপিস্টকে অভিজ্ঞ ও গভীর তাত্বিক জ্ঞান সম্পন্ন হতে হবে।

মনে রাখতে হবে রোগীরা তাদের কষ্টের উপশমের জন্য ডাক্তারের কাছে যান

এবং প্রথম সেশনেই তার কিছুটা হলেও প্রমান রাখতে হবে।

আমাদের ইনস্টিটিউটের একমাত্র সাইকলজিস্ট একদিন আমাকে বলেন, স্যার আপনি তো অনেক জায়গায় লিখেন,সাইকোথেরাপি যে কার্যকর সেটিও লিখবেন।

আমি বলি কথায় চিড়ে ভিজে না লোকে মনে করলেও " কথায় ও চিড়ে ভিজে" এ নামে কিছু লিখবো।

এখনো লেখা হয়নি( একসময় সাইকোথরাপি নিয়ে লেখার ইচ্ছে আছে)।

কিন্তু চিড়ে ভেজাতে হলে( মন গলাতে) বিজ্ঞান সম্মত জ্ঞান,মাঠ পর্যায়ের সবল দক্ষতা থাকতে হবে।

পয়সা দিয়ে রোগীরা শুধু কথা বলতে যান না বা কথা শুনতে।তারা নিরাময় চায়,ডাক্তারকে তা দেওয়ার মতন সক্ষমতা থাকতে হবে।


_____________________________

অধ্যাপক ডা.মো. তাজুল ইসলাম: দেশের জনপ্রিয় লেখক কলামিস্ট। সুবক্তা। সোশ্যাল সাইকিয়াট্রিস্ট। অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়