Ameen Qudir

Published:
2017-03-27 17:27:19 BdST

'তোর আপুর সাথে আজ তিন দিন পর দেখা হলো' : মহাকালের মহানায়কেরা


 



 

 

ডা. জামান অ্যালেক্স
_______________________________

১....

আমি তখন ঢাকা মেডিকেলে ইন্টার্নী করি, সার্জারীতে প্লেসমেন্ট।একটা জটিল অপারেশনে অ্যাসিস্ট করতে রাত ১ টায় ওটিতে ঢুকে যখন বের হই-তখন ফযরের আজান দিচ্ছে.....

সকাল ৮ টায় ওয়ার্ডে বসে ঝিমাতে ঝিমাতে রোগীর ফাইলের ফ্রেশ অর্ডার করছি, পাশের চেয়ারে বসে ডাঃ মাছুম ভাই আমাকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন।এমন সময় মাসুম ভাইয়ের ওয়াইফ( উনিও ডক্টর) ভাইয়াকে দেখতে ওয়ার্ডে আসলেন।কিছুক্ষণ কথা বলে আপু বিদায় নিলেন.....

ডাঃ মাছুম ভাইয়ের দেখলাম মন খারাপ।জিজ্ঞেস করলাম, "ভাই, কি হয়েছে?"....ভাই উত্তর দিলেন, "তোর আপুর সাথে আজ তিন দিন পর দেখা হলো, যেভাবে আমার আর তোর আপুর ডিউটি চলছে -তাতে আবার কবে দেখা হয় কে জানে...."

 


চিকিৎসকেরা বাস্তব জীবনে কিভাবে তাদের দিন যাপন করেন তার একটা ছোট নমুনা সেদিন আমি পেয়েছিলাম.....

২.....

ইন্টার্নী কমপ্লিট করে বিয়ে করে প্রোফেশনাল লাইফে ঢুকলাম।নিজেও ডক্টর, ওয়াইফও ডক্টর।দু'জনের ডিপার্টমেন্ট আলাদা.....

নিজে যেদিন একটু ফ্রি থাকি-সেদিন ওয়াইফের ডিউটি থাকে, যেদিন সে কিছুটা ফ্রি থাকে সেদিন আমার ডিউটি থাকে....

বাচ্চা বেশীর ভাগ সময়ে থাকে তার নানীর কাছে।অবস্থা এতটা বেগতিক যে কয়মাস আগে বাচ্চাকে কোলে নিতে গিয়ে দেখি আমার কোলে আসতে চায় না, মাঝে মাঝে আমাকে দেখতে পায়, চিনবেই বা কেমন করে?চোখের পানি আড়াল করলাম.....

সেদিন থেকে নিয়মিত এক কাজ করি, ডিউটিতে বা চেম্বারে ফ্রি হলে ভিডিও কল অন করে বাবুর সাথে কথা বলি....

৩....

গত ঈদের কথা বলি।আগেভাগে হাসপাতালের সব ইমার্জেন্সী ডিউটি করে ফেললাম,ঈদের সময়ের ডিউটিগুলো অন্য ধর্মের কলিগরা করবেন। প্ল্যান করলাম এইবারের ঈদে ফ্যামিলির সাথে বাসায় কাটাবো.....

এক্সপেক্টেড ঈদের আর একদিন বাকী, তার আগের দিন সরকারী ছুটি থাকে।খুশির আমেজ চারদিকে, ঐ ছুটির দিন ফ্যামিলির সবাই মিলে যমুনা ফিউচার পার্কে মার্কেটিংয়ে যাবো, অনেকদিন ঘুরতে যাওয়া হয় না....

ছুটির আগের দিন এক নোটিশ জারী করা হলো--সবার ছুটি থাকলেও সমস্ত চিকিৎসকদের ছুটি বাতিল করে হাসপাতালে থাকতে নির্দেশ দেয়া হলো। ঘটনাটা নিশ্চয়ই আপনাদের অনেকের মনে আছে....

হাসপাতালে যাবার জন্য রাস্তায় বের হলাম। সবাই ঈদের ছুটিতে বাড়ী যাচ্ছে, আনন্দ করছে, আমি সহ বাকী চিকিৎসকেদের রোগী দেখার জন্য সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে যেতে হয়েছিলো.....

৪....

সরকারী ভাবে সপ্তাহে একজন চিকিৎসকের ৩৯ ঘন্টা ডিউটি করার কথা। গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে আমাকে শুধু ইমার্জেন্সী ডিউটিই করতে হয়েছে ৪৮ ঘন্টা, আউটডোর ডিউটির হিসাব বাদ দিলাম....

৩৯ ঘন্টার পরিবর্তে যে অতিরিক্ত সময় আমি বা অন্য চিকিৎসকেরা হাসপাতালে কাটিয়েছি তা ছিলো Without a single penny.

একটা সাইডটক করি- আগ্রহী মন জানতে চায়---চিকিৎসক বাদে আর অন্য কোন্ প্রফেশনের ব্যক্তিরা এই অন্যায়টিকে কি কখনো মেনে নিবেন? অন্যায় ভাবে আমাদের দিয়ে খাটিয়ে নিয়ে জনগণকে যে চিকিৎসার মূলো দেখানো হয়-সেটি কি যুক্তিযুক্ত?....

মূল কথায় আসি, দিনের পর দিন আমরা দেশকে নির্ধারিত সময়ের বাইরেও অতিরিক্ত সেবা দিয়ে যাই।যদি কোনোদিন নিজের সন্তান আমাকে জিজ্ঞেস করে "কেনো তাকে সময় না দিয়ে বঞ্চিত করা হচ্ছে?"--তখন আমাদের জবাবটা কি হওয়া উচিত?

৫.....

আমার কথা বাদ দেই।আমার এক শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকের ডেইলী রুটিনের নমুনা দেই....

স্যার সকাল ৮ টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত হাসপাতালে থেকে ওয়ার্ডে রাউন্ড দেন, গ্রাজুয়েট ও পোস্ট-গ্রাজুয়েট লেভেলের ছাত্রদের পড়ান, নানা একাডেমিক সেশনগুলোতে উপস্থিত থেকে আপডেটেড ইনফো অনুযায়ী প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেন।আড়াইটার পর ক্লান্ত শরীরে বাসায় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া, গোসল কমপ্লিট করে ঢাকার জ্যাম ঠেলে ঠিক ৫ টায় চেম্বারে ঢোকেন।রাত ১২-১ টা পর্যন্ত মানুষের প্রয়োজনে রোগী দেখেন।তারপর বাসায় যান, ঘুমটুম কি দেন জানি না, সকাল ৬ টায় রোগীর প্রয়োজনে এন্ডোসকপি শুরু করেন, সকাল ৮ টায় আবার হাসপাতালে ঢোকেন.....

কিভাবে এই লাইফ তিনি লীড করেন তা আপনারা কেউ কল্পনা করতে পারেন?

একটা তথ্য আমি আপনাদের দেই--এই দেশের অধিকাংশ অধ্যাপক ডক্টরকে মানুষের প্রয়োজনে কিছু রকমফের সাপেক্ষে এইরকম জীবনযাপনের প্যাটার্ন ফলো করতে হয়....

মানুষ চিকিৎসকদের টাকাটা দেখে, তার পেছনে মানুষের প্রয়োজনে নিজের জীবনটাকে যে উৎসর্গ করতে হচ্ছে-সেটা দেখে না.....

৬....

চিকিৎসকেরা কিভাবে তাদের দিনাতিপাত করে সেটার কিছু Example দিলাম।হাসপাতালে ও চেম্বার মিলিয়ে এদেশে অধিকাংশ চিকিৎসকদের কর্মঘন্টা সপ্তাহে ৬০ ঘন্টা বা তারও বেশী। সায়ন্টিফিক্যালি এটা কতটা Rational?

Lancet এ ২০১৫ সালে পাবলিশড্ হওয়া একটা Systematic Review এর তথ্য আপনাদের দেই।Lancet ও Systematic Review সম্পর্কে যাদের আইডিয়া আছে তাদেরকে এরপর এ স্টাডি নিয়ে আর কোনো কথা বলার তেমন কোনো কারণ দেখি না।তথ্যটা বলিঃ

৫,২৮,৯০৮ জন ব্যক্তির উপর প্রায় ৭ বছর স্টাডি চালিয়ে দেখা গেছে যারা সপ্তাহে ৫৫ ঘন্টা বা তার বেশী সময় ডিউটিতে কর্মরত থাকেন, তাদের Stroke রিস্ক সাধারণদের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশী।৬,০৩,৮৩৮ জন ব্যক্তিকে নিয়ে ৮.৫ বছর সময়ে করা স্টাডিতে দেখা গেছে যাদের কর্মঘন্টা ৫৫ ঘন্টা বা তার বেশী তাদের Coronary Heart Disease এর রিস্ক ১৩ শতাংশ বেশী....

চিকিৎসকেরা আগে তার পরিবারের সদস্যদের বঞ্চিত করতেন, Lancet এর এই পাবলিকেশন তো বলে চিকিৎসকরা এখন নিজেরাও নিজেদের বঞ্চিত করছেন.....

৭....

লেখা দীর্ঘ হচ্ছে, শেষ করি.....

মেডিকেল সায়েন্সের যেকোনো বই পড়ার আগে তার ভূমিকা অংশটা আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি।অধিকাংশ চিকিৎসকেরা বইটা লেখার পেছনে তাঁর পরিবারের অবদানের কথা উল্লেখ করেন, কেউ কেউ সরাসরি বইটি তার স্ত্রী বা সন্তানকে ডেডিকেট করেন। আমি এখন কিছুটা হলেও এর কারণটা বুঝতে পারি।এই ক্ষুদ্র জীবনে যাদেরকে দিনের পর দিন ঠকানো হয়েছে বই তো তাদের প্রতিই উৎসর্গ করা উচিত, সেটাই তো শোভনীয়.....

১২-১৪ বিলিয়ন বছর আগে Big Bang এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিলো, এখনো মহাবিশ্ব টিকে আছে, আরো কত বিলিয়ন বছর টিকে থাকবে তা জানি না।তবে এতটুকু বলতে পারি মহাবিশ্ব যে মহাকাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে আমাদের আয়ুষ্কাল তুচ্ছাতিতুচ্ছ.....

যে খনিক সময়টা আমরা পাই, সেটা আর কখনো ফিরে আসবে না, মহাকালের পাতায় আমরা মিশে যাবো।এই ক্ষুদ্র সময়ে অন্যরা যখন প্রিয়জনের সাথে খুনসুটিতে ব্যস্ত থাকে, আমরা চিকিৎসকেরা সে সময়ে আমাদের আপনজনদের বঞ্চিত করে অন্যের সেবা করার অভিপ্রায়ে ব্যস্ত থাকি।অন্যের মুখে হাসি ফোঁটাই, তা দেখে নিজেরা আনন্দিত হই, নিজের প্রিয়জনদের বঞ্চিত করার যে দীর্ঘশ্বাস তা নিজেদের সাথে মহাকালের পাতায় বিলীন হয়। মহাকালের মহানায়কদের সে দুঃখ কাউকে স্পর্শ করে না, কেউ অবশ্য সেটা জানতেও পারে না....

_______________________________

ডা. জামান অ্যালেক্স । সুলেখক। লোকসেবী ডাক্তার ।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়