Ameen Qudir

Published:
2017-03-16 18:05:50 BdST

রাত আড়াইটা:নাইট ডিউটি :আমার পৃথিবীতে কোন আকাশ নেই



রাহাত আহমেদ , ইন্টার্ন চিকিৎসক , রামেক
_______________________________


আমার পৃথিবীতে কোন আকাশ নেই ।

তখন রাত আনুমানিক ২:৩০ মিনিট !!! আমার নাইট শিফটে ডিউটি । এমন সময় একজন লোক এসে বললো স্যার আমার রোগীটিকে বাঁচান !

এরপর রোগী দেখলাম, জীর্ণশীর্ণ শরীর, পরনে অনেকদিনের পুরোনো ময়লা সাদাটে পায়জামা, গায়ে পুরোনো নিল রঙের ফুলহাতা টি শার্ট যার মধ্য দিয়ে বুকের হাড়গুলো যেন মাথা তুলে উকি মারছে !!! প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে ভুগছে, অক্সিজেনের অভাবে হাত পা ছুটাছুটি করছে, সাথে বড় বড় নিঃশ্বাস !!!

 

বুকে স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে দেখলাম প্রচণ্ড রকমের হাপানী( Acute Severe Asthma) জনিত রোগে ভুগছে । যাইহোক সাথে সাথে অক্সিজেন লাগিয়ে চিকিৎসা দিলাম ও সাপ্লাই বাদে বাকি ঔষধগুলো বাইরে থেকে আনতে বললাম !!! লোকটি হঠাৎ করে কোমর থেকে কয়েনভর্তি একটি থলে আমার টেবিলে রেখে বললো স্যার এতে হবে !

খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম, এইসব দিয়ে আমি কি করবো !

এরপর লোকটি বলতে থাকলো, স্যার আশেপাশের মানুষ যা দিয়েছে নিয়ে এসেছি, এতিম ছেলে স্যার, আমাদের সম্পদ, একটু দেখেন । কি আর করা, অগত্যা আমি নিজেই অন্য রোগীর কাছ থেকে ধার করে কিছু ঔষধ নিয়ে আসলাম !!! আর মনে মনে ভেবে রাখলাম সকাল হলেই, " হাসিমুখ " এ ফোন দিয়ে তার সমস্ত ঔষধের ব্যবস্থা করবো ।
ঘন্টা দেড়েক পর রোগীটি মোটামুটি স্ট্যাবল হলে সেই লোকটিকে আবার ডাকলাম ঘটনা কি জানার জন্যে । যা শুনলাম তার সারাংশ আমার নিজের ভাষায়...

ছেলেটির নাম আকাশ কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস একবার দেখুন তার পৃথিবীতে কোন আকাশ নেই !!! অর্থাৎ জন্মগতভাবেই সে অন্ধ প্রায় !!! এক হাত দুরত্বে সে ঝাপসা দেখে !!! শুধু তাই নই, দেড় বছর বয়স থেকেই তার বাবা নিখোঁজ আর মা মারা যায় মাত্র ৫ বছর বয়সে, থাকে নানীর কাছে !!! নিয়তি তার সাথে যেন একরকম ছলনাই করেছে আর সবচেয়ে বেশী যে ব্যাপারটা ছলনা করেছে তাহলো তার নামটা , আকাশ (দীর্ঘশ্বাস) !

 


কিন্তু জানেন তো, এই আকাশরা কখনো থেমে থাকেনা !!! সৃষ্টিকর্তা হয়তো তার সবকিছু কেড়ে নিয়েছেন কিন্তু যা দিয়েছেন তা আর কাউকে দেননি !!! অত্যন্ত প্রখর ও তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী এই ছেলেটি ১/২ পারা নয় ৩০ পারা কোরআন শরীফের হাফেজ !!! শুধু তাই নয়, কোকিলকণ্ঠী এই ছেলেটির তিলাওয়াত শুনলে পাগল হবেন আপনিও !!!
তাকে এককথায় বাংলাদেশের জাকির নায়েক বলা যায় !!! তাকে জীবনধর্মী/ ইসলাম ভিত্তিক যেকোন প্রশ্ন করলে তাৎক্ষণিক মিলবে উত্তর !!! শুধু তাই নয় কোরআন শরীফের কত নম্বর সূরার কত নম্বর আয়াতে এর ব্যাখ্যা আছে একদম রেফারেন্স সহ !

 

আর তার অর্জন আমার এই ছোট্ট লেখায় শেষ করা যাবেনা !!! তবুও বলি, ২০১৩ সালে সারা বাংলাদেশে কিরাত প্রতিযোগিতায় সে প্রথম স্থান অধিকার করে !!! হ্যা, এই সেই অন্ধ হাফেজ !!! এরপর সে সৌদি আরবে যায় এবং সারাবিশ্বের তেলাওয়াতকারীদের মধ্যে তৃতীয় হয়। ক দিন আগেও আরাম্বাগে এক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয় সে । এককথায় রাজশাহীর চ্যাম্পিয়ন। আর ছোট বড় বিভিন্ন অর্জন তো রয়েছেই !!! আসছে রমজান মাসে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে NTV প্রোগ্রামে আবারো তাকে দেখা যাবে !!! বর্তমানে সে শাহপুর পুর্বপাড়া জামে মসজিদ কাটাখালি তে ইমামতি করছে ।

এই আকাশহীন পৃথিবীর বুকে বাস করা ছেলেটির জন্যে " হাসিমুখ ফাউন্ডেশন " হয়তো আকাশ দেখার ব্যবস্থা করতে পারেনি কিন্তু সে যাতে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে উচ্চস্বরে কোরআন তেলাওয়াত করে এই বাংলার মাঠ ঘাটকে পুনরায় মুখরিত ও মোহিত করতে পারে সে ব্যবস্থা করে দিয়েছে তার চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করে !

 

হ্যা, আমি সেই "হাসিমুখ ফাউন্ডেশনের" কথাই বলছি যা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে " হাসিমুখ " নামে পরিচিত । ২০১০ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ৪২ তম ব্যাচের পাঁচজন স্বপ্নবাজ ছাত্রের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় আজকের এই " হাসিমুখ "!!! সেই থেকে আজ পর্যন্ত হাটি হাটি পা পা করে চলতে থাকা এই ফাউন্ডেশনটি বিগত ৭ বছরে ৬৭৫ জন দরিদ্র অসহায় মৃতপ্রায় রোগীদের অপারেশনের জন্যে চিকিৎসা সরঞ্জামাদি, বিভিন্ন রোগের ঔষধ ও পরিক্ষা নিরীক্ষার ব্যয়ভার বহন করে আসছে যার ব্যয় সর্বসাকুল্যে প্রায় ৯,৫০০০০ ( সাড়ে নয় লক্ষ্য) টাকা !
আর এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি পরিচালিত হয় আপনি যাদের লোভী ডাক্তার/ কসাই বলেন তাদের ও হবু লোভী ডাক্তার / কসাইদের দ্বারাই !!!

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসক তথা কসাইগনের নিয়মিত মাসিক /এককালীন চাঁদা এবং দেশের বাইরে অবস্থানরত প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের বন্ধু/বান্ধবীগন সহ বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের আর্থিক সহযোগীতায় চলে এই "হাসিমুখ" !!!

সাপে কাটা রোগীদের জন্যে এন্টিভেনোম থেকে শুরু করে শীতার্তদের জন্য শীতবস্ত্র অথবা দরিদ্র মেডিকেল ছাত্র, "হাসিমুখ" সবার প্রতি তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে হাসিমুখে । ৬৭৫ জনের আলাদা আলাদা করে তথ্য আমার এই ছোট্ট লেখায় দেয়া সম্ভব নয় তবে কেউ চাইলে প্রত্যেকটি রোগীর ছবিসহ তথ্য আমাদের অফিসে গিয়ে নিতে পারেন :) । ওয়েলকাম....


"হাসিমুখ" স্বপ্ন দেখে, একদিন দেশের প্রত্যেকটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হাসিমুখের একটি করে ইউনিট খুলে সারা বাংলাদেশের সমস্ত গরীব মানুষকে এর সাহায্যের আওতায় আনার !!!

জানি, এইসব খবর কখনোই বাংলাদেশী মিডিয়ায় প্রকাশ পাবেনা !!! কারন মিডিয়ায় কখনো ভালোবাসা বিকয় না যা বিকয় তাহলো হিংসা, বিদ্বেষ , মারামারি আর রাহাজানি !!! শত শত নেগেটিভ নিউজের মাঝে পজিটিভ নিউজের স্থান সংকুচিত হচ্ছে দিন দিন !!! কারন এইসব হল ব্যবসা যার মূল্য নির্ধারিত হয় প্রতি বর্গ ইঞ্চি/প্রতি সেকেন্ড (টেলিভিশন) আকারে !!! যত বেশী মসলা দিয়ে খবরকে মুখরোচক বানানো যায় ততবেশী কাটতি আর যতবেশী কাটতি ততবেশী মুনাফা !!! তাইতো ডাক্তারের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উঠলেই বেশী কাটতির উদ্দেশ্যে কোনরকম সত্যতা যাচাই ছাড়াই শুধুমাত্র অভিযোগকারীর মুখের কথা শুনেই খবরের হেডলাইন হয়ে যায়, '' অতঃপর রোগীর কিডনি চুরি করলো সেই চিকিৎসক !!! " নাহলে " ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু !!!" নইলে রোগীদের প্রতি চিকিৎসক /হবু চিকিৎসকদের এমন অনেক হাজারো নিঃস্বার্থ ভালোবাসার নিদর্শন কেন মাটিচাপা হয়ে পড়ে থাকবে !


(যদিও "হাসিমুখ" নিজের কথা কখনো নিজে প্রচার করতে চাইনা )

বিঃদ্রঃ আমি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলতে চাই, বাংলাদেশে চিকিৎসাই একমাত্র পেশা, যে পেশার লোকজন অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে দরিদ্র অসহায় মানুষের পাশে সবচেয়ে বেশী দাঁড়িয়েছে । সুতরাং, চিকিৎসকদের দিকে আংগুল তুলার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন, জনগণের টাকায় পড়ে আপনি কি করেছেন দেশের জন্যে ?

( ছবিতে হাসিমুখের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ঔষধ তুলে দিচ্ছেন ওয়ার্ডে কর্তব্যরত চিকিৎসকগণ)

___________________________________

রাহাত আহমেদ

Intern Doctor at Rajshahi Medical College Hospital, Rajshahi, Bangladesh

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়