Ameen Qudir

Published:
2017-03-15 17:08:59 BdST

কিছু অর্থলোভীর প্রতি ঘৃণা দেখাতে গিয়ে ডাক্তার সমাজের অবদান ভুলে যাওয়া অকৃতজ্ঞতা নয় কি?


 

 

 

নন্দিতা পাল
_____________________________

ডাক্তারদের প্রতি এখন সকলেই বীতরাগ। কারণ অনুমেয়। মিডিয়ার কল্যাণে আমরা সব পড়ি, দেখি কিন্তু প্রকৃত সত্য অনুধাবন করতে চাই না। এই প্রসঙ্গে কয়েকটি অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চাই।

প্রায় আড়াই দশক আগে পথদুর্ঘটনায় আহত হয়ে আমার এক আত্মীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। মাথা ও কোমরে বিশেষ চোট পান। সপ্তাহ তিন চার পর বিশেষ উন্নতি না হওয়ায় উদ্বিগ্ন পরিজনরা রোগীকে অন্যত্র নিয়ে যেতে চাইলে রিস্ক বন্ডে মেডিক্যাল ডকুমেন্টস ছাড়াই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাঁর মাথায় চারটি সেলাই দেওয়া ছাড়া ওখানে আর কিছুই হয়নি। কোমর থেকে পা পুরোপুরি অসাড়।

বিছানাই আশ্রয়। এ হেন রোগীকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনেন এক জন নিউরোমেডিসিনের ডাক্তারই। এক জনের ভুল চিকিৎসায় পঙ্গুত্বপ্রাপ্তি, অন্য জনের সুচিকিৎসায় সুস্থ জীবনে ফিরে আসা। পারিবারিক উদ্যোগে তিনি নীরোগ হন।

অন্য ঘটনাটি স্কুলজীবনের। দুর্গাপূজার মাসখানেক আগে। খুব জ্বর নিয়ে ভুগছি। ডাক্তারপথ্যি সব চলছে। জ্বর আর সারে না, বাবা মায়ের দিনের শান্তি, রাতের ঘুম নেই। ভাইবোন দুটি মনমরা। পুজো চলে গেল নিরানন্দে। পুজোর সময় ডাক্তার পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সে যুগে এবং এ যুগেও। অবশেষে এক জন ডাক্তার দেড় মাস ভোগা মরোমরো রোগীকে সারিয়ে তুললেন মাত্র একটি প্রেসক্রিপশনে। ভিজিট মাত্র আটষট্টি টাকা। আগের ডাক্তার রোগনির্ণয়ে ভুল ছিলেন, পরের জন ঠিক ছিলেন।

 

পরের ঘটনাটি গত বছরের। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে। আমার এক আত্মীয় রাতের বেলা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হাই প্রেশার। সঙ্গে বুকে ব্যথা। প্রতিবেশী ডাক্তারবাবু দেখেশুনে কিছু ওষুধ দিয়ে তাড়াতাড়ি জেলা হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন। গেলাম। ভর্তি করে দিলাম। তার পর অপেক্ষা। শুনলাম ডাক্তার আসবেন রাতে। প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ তিনি এলেন। এসেই দুটো ওষুধ আনতে লিখে দিলেন। দিলাম। তিনটে ইঞ্জেকশন দেওয়া হল। তিনি চলে গেলেন। রোগীর ব্যথার উপশম হল না, কিন্তু নিরুপায় মেল ওয়ার্ডে ফিমেল থাকা যায় না। অগত্যা মেল আয়া রেখে দুরুদুরু বুকে রাত তিনটে নাগাদ ফিরে এলাম। টানা তিন দিন বাদে কোনও সুরাহা না হওয়ায় রোগীকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে এলাম।

এ বারেও কোনও ঠিক মেডিক্যাল ডকুমেন্টস পেলাম না। নামকরা চিকিৎসক দেখাবার আশায় পাড়ি দিলাম কলকাতায়। সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে ঘণ্টা দুয়েক লাইন দিয়ে প্রায় হাজার খানেক রোগীর পরে অবশেষে সুযোগ এল। একটি দেড়শো এমজি জিনট্যাক টানা তিন মাস খেতে দিলেন। না পেলাম পছন্দসই ডাক্তার, না হল মনোমত চিকিৎসা। আরোগ্যের প্রশ্নই ওঠে না। অগত্যা বেসরকারি হাসপাতালে যাত্রা। কিছুটা নিয়মানুবর্তিতা আর কিছুটা সুচিকিৎসায় আপাতত স্থিতিশীল ওষুধনির্ভর জীবনযাপন।


স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে, এত বকলাম কেন? চিকিৎসা ব্যবস্থার দুটি প্রান্ত। এক দিকে চিকিৎসক। অন্য প্রান্তে রোগী ও তার পরিবার পরিজন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, দু’পক্ষই বেশ অসহায়। দু’পক্ষেরই লক্ষ্য রোগীর আরোগ্যলাভ। শুধু এই দুই পক্ষের সদিচ্ছায় সব সময় রোগমুক্তি ঘটে না। আরও কয়েকটি দিকে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সহায়ক কর্মী, চিকিৎসক, সেবক বা সেবিকা, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম, উপযুক্ত পরিকাঠামো, দালালরাজমুক্ত হাসপাতাল, পর্যাপ্ত ওষুধপত্র, সর্বোপরি আন্তরিক সদিচ্ছা অত্যন্ত প্রয়োজন। এরই সঙ্গে প্রয়োজন সমস্ত রকম প্রভাব মুক্ত বা চাপমুক্ত পরিবেশ। এর অন্যথা হলে সুচিকিৎসা ব্যাহত হবেই।

 

কলকাতার সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতালের ওপিডি’তে নজর দিলে ডাক্তারদের প্রতি মায়াই হয়। অত্যধিক রোগীর চাপে ডাক্তারদেরই করুণ দশা। ডাইনে বাঁয়ে ঘাড়ে মাথায় সামনে পিছনে সব দিকে রোগীর মাথা। রোগী তথৈবচ। ছোটবড় সব সরকারি হাসপাতালেরই একই দশা। কী জেলায় কী মহানগরে। এই কারণেই অসরকারি চিকিৎসা ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত। দীর্ঘ দু’তিন দশক ধরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য অসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোম। এমনকী প্রত্যন্ত গ্রামেও এর ব্যতিক্রম চোখে পড়ে না। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবার যাবতীয় ব্যবস্থা থাকলেও মূলত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই তা চালিত হয়। কর্পোরেট ব্যবস্থায় লাভই মুখ্য। এখানে মহানুভবতার প্রত্যাশা নিতান্ত মূর্খামি।

 

এ হেন পরিস্থিতিতে কতিপয় অর্থলোভী অমানবিক ডাক্তারদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করতে গিয়ে সমগ্র চিকিৎসক সমাজ ও তাঁদের অবদানের কথা ভুলে যাওয়া অকৃতজ্ঞতার নামান্তর নয় কি? সুষ্ঠু চিকিৎসা পরিষেবা পেতে হলে কুসংস্কারমুক্ত জনমানস, সুচিকিৎসক এবং সুস্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ একান্ত কাম্য। দেবতার থান এবং উৎসব বাহুল্য কমিয়ে শিক্ষার ‘থান’, চিকিৎসার ‘থান’-এর প্রতি যত্নশীল হলে সকলেই উপকৃত হবেন। না হলে আমজনতার বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে চলবে। আর আমরা ‘মার মার কাট কাট’ আত্মঘাতী খেলায় মেতে উঠব।

____________________________

নন্দিতা পাল কৃষ্ণনগর, নদিয়া

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়