Ameen Qudir

Published:
2017-03-14 19:32:01 BdST

প্রাণপণ লড়ে মানুষের জীবন বাঁচান এই ডাক্তাররা


ডা. কানিজ ফাতেমা ও ডা. ফাতেমা আহমেদ। ছবি: খালেদ সরকার

 

 

 

 

ডা. তানজিনা হোসেন

_______________________________

 


দুর্ঘটনায় আহত হয়ে প্রায় এক মাস অচেতন অবস্থায় আইসিইউতে ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। পরিবার তাঁর বেঁচে ওঠার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। কিন্তু ভরসা মোটেও হারাননি তাঁর চিকিৎসক, ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ ডা. ফাতেমা আহমেদ। প্রাণপণ লড়াই করেছেন যমদূতের সঙ্গে। আর তারপর একসময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন সেই পুলিশ কর্মকর্তা। আইসিইউ থেকে এইচডিইউ, তারপর সাধারণ বেড হয়ে অনেক দিন পর বাড়ি ফিরলেন তিনি। এক চোখে ভালো দেখতে পান না বটে, তবে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছেন তিনি। তিন মাস পর একদিন সস্ত্রীক ডা. ফাতেমার কাছে এসে হাজির। কী ব্যাপার? তাঁর স্ত্রী হাসতে হাসতে বললেন, ‘সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে সে দেখতে চাইছে ওই ডাক্তারকে, যিনি সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখোমুখি তাকে লড়াই করতে সাহায্য করেছেন। আবছা আবছা তার চেহারা মনে পড়ে, কিন্তু আসলে কে তিনি? তাকে দেখতেই আজ আসা।’

 


গল্পটা বলতে বলতে হাসছিলেন বাংলাদেশের নারী ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ ডা. ফাতেমা আহমেদ। এখন বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে সহকারী অধ্যাপক। তাঁর পাশেই বসেছিলেন একই বিভাগের আরেক সহকারী অধ্যাপক ডা. কানিজ ফাতেমাও। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে যথাক্রমে ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন এই দুজন নারী চিকিৎসক। বাংলাদেশে এই বিষয়ের ধারণাটিই আনকোরা। দেশে অনেকগুলো আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র চালু থাকলেও এই বিষয় নিয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নেওয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এক দশক আগেও ছিল না।

 


২০০৯ সালে প্রথম বারডেম একাডেমি বাংলাদেশে ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন বিষয়ে স্নাতকোত্তর শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে। প্রথম ব্যাচে স্নাতকোত্তর করেন ডা. আরিফ আহসান, এই বিভাগেরই জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক। এরপর তাঁর এবং বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ওমর ফারুক—এই দুজনের উৎসাহ-উদ্দীপনায় পরপরই স্নাতকোত্তর করেন দুজন নারী চিকিৎসক। ফাতেমা আহমেদ ২০০০ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এবং কানিজ ফাতেমা ২০০১ সালে শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে দুজনেই মেডিসিন বিষয়ে এফসিপিএস সম্পন্ন করেন। তারপর নিজেদের আগ্রহেই এই ক্ষেত্রটিতে আসা। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও চালু হয়েছে এই কোর্স। আরও মেয়েরা পড়ছেন এই বিষয়ে।

 


দিনভর আইসিইউয়ের ভেতর সংকটাপন্ন রোগীদের চিকিৎসা দিতে, যেখানে প্রায় সারাক্ষণই ছায়া ফেলে আছে মৃত্যু, যেখানে সব সময়ই ঘাড়ের কাছে যমদূতের ভারী নিশ্বাস—এভাবে কাজ করতে কেমন লাগে? ফাতেমা আহমেদ বলেন, ‘খুবই চ্যালেঞ্জিং লাগে। জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কাজ করি আমরা। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করার জন্য প্রস্তুত থাকি। বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র্য মেদিনী—এ রকম আরকি। মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়ে অনেকে ফিরে আসেন। তখন দুর্দান্ত লাগে ব্যাপারটা।’
আর খারাপ লাগে না? যখন হেরে যান? প্রশ্ন করি। এবার উত্তরটা দেন কানিজ ফাতেমা। তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ লাগে। বিশেষ করে যদি রোগীটি তরুণ বা শিশু হয়।’ তবে হতাশা? ‘না, তা কখনোই হয় না। কারণ, এখানে প্রতিটি দিনই লড়াই ও যুদ্ধের। প্রতিটি মুহূর্ত নাটকীয়। সারাক্ষণ নানা রকমের জরুরি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এর মধ্যে হতাশা পেয়ে বসলে তো মুশকিল।’
কিন্তু এই সারাক্ষণ জরুরি অবস্থা, বিপদের জন্য সদাপ্রস্তুত থাকা, টেনশন, মানসিক চাপ—এগুলো কি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনকে বাধাগ্রস্ত করে না? এই প্রশ্নের উত্তরও দুজনেরই প্রায় এক। অভ্যাস হয়ে গেছে। তা ছাড়া এ ধরনের ইউনিট একটি টিমওয়ার্কে চলে। এই দলে নার্স, জুনিয়র চিকিৎসক, সিনিয়র চিকিৎসক, টেকনিশিয়ান—সবাই জড়িত। তাই খুব একটা অসুবিধে হয় না।

 


লোকে বলে, মৃত রোগীকেও নাকি মেশিন লাগিয়ে রাখা হয় হাসপাতালে—এ ধরনের দুর্নামের শিকার হয়েছেন কখনো? ফাতেমার জবাব, ‘দেখুন চিকিৎসাবিজ্ঞানে মৃত্যু দুধরনের। কার্ডিয়াক ডেথ আর ব্রেন ডেথ। কার্ডিয়াক ডেথ হয়ে গেলে হাজার যন্ত্র লাগিয়েও কিছু হবে না, মৃত্যু-পরবর্তী শারীরিক পরিবর্তন শুরু হয়ে যাবে। তাই কথাটা ভিত্তিহীন। আর ব্রেন ডেথ বিষয়টা একটু গোলমেলে। ব্রেন ডেথ ঘোষণা করার সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও আইন আছে। কিছু ক্রাইটেরিয়া আছে, যা পূরণ হতে হবে। যে কেউ হঠাৎ করে এই ব্রেন ডেথ ঘোষণা করতে পারেন না। এ জন্য যে প্রশিক্ষণ, যে স্থাপনা ও সুযোগ-সুবিধা দরকার, তাও দেশের সব হাসপাতালে নেই। তো যখন সব ধরনের চেষ্টা সত্ত্বেও শতকরা শূন্য ভাগ রিকভারির সম্ভাবনা, তখন আমরা সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাই। বিদেশে এ রকম পরিস্থিতিতে হাসপাতালে সমাজকর্মীরা এসে উপস্থিত হন। অরগান ডোনেশন বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। আমাদের দেশে এমন সময়ে স্বজনেরা দুভাগ হয়ে যান। এক ভাগ চান দ্রুত সব কিছু খুলে নিয়ে যেতে, আরেক ভাগ চান কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চলুক। এ রকম নাজুক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েই চিকিৎসকেরা সিদ্ধান্ত নেন কী করবেন। অনেক রকমের আবেগঘন পরিস্থিতি তৈরি হয়। এগুলো মোকাবিলা করতে হয়।

 


ডা. কানিজ ফাতেমা যোগ করেন, ‘রোগীর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে খোলাখুলি আলাপ-আলোচনা এ সময় খুবই জরুরি। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, বেশির ভাগ সময়েই রোগীদের স্বজনেরা পরিস্থিতি বুঝিয়ে বললে ঠিকই বোঝেন। তাঁদের সময় দিতে হয়।’
আমাদের দেশে ক্রিটিক্যাল কেয়ার সেবা যেমন অপ্রতুল, তেমনই ব্যয়বহুল। বিশেষজ্ঞের সংখ্যাও অনেক কম। আর আইসিইউ সেটআপে যে বিনিয়োগ দরকার, তা সরকারের পক্ষেÿ একা সবখানে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তাই এ ব্যাপারে সবারই এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তাঁরা দুজন। যেমন কোনো কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তি আইসিইউয়ের যেকোনো একটি বিছানার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার গ্রহণ করেন। তখন একজন গরিব রোগী চিকিৎসার সুযোগ পায়। আরও অনেক প্রশিক্ষিত নার্স দরকার আমাদের, দরকার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বেসিক লাইফ সাপোর্ট বা অ্যাডভান্সড লাইফ সাপোর্ট প্রশিক্ষণ দেওয়া। তাহলেই অনাকাঙ্ক্ষিত ও অসময়ে মৃত্যু অনেকখানি এড়ানো যাবে।
সৌজন্য : প্রথম আলো।

১৪ মার্চ প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়েছে দৈনিক প্রথম আলোয়।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়