Ameen Qudir

Published:
2017-03-14 17:15:50 BdST

আত্মহত্যা নয়, মেয়েটি মেডিকেল বা ভার্সিটিতে ভর্তি হতে চেয়েছিল


 



 

মুশতারী মমতাজ মিমি
______________________________
১.
কাটায় কাটায় রাত তিনটা।সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি নীতু।ঘুমানোর যে চেষ্টা করেনি তাও নয়।ঘুম আসেনি আসলে।চিন্তা আর উত্তেজনায় এপাশ ওপাশ করেছে শুধু। দেয়ালঘড়ির দিকে কতক্ষণ উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো ও। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে বিছানা থেকে নামলো। দুচোখের নীচে পুরু করে কালি পড়েছে ওর,চেহারাটাও কেমন মলিন আর ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।


বয়সের তুলনায় অনেক কঠিন একটা সিদ্ধান্তু নিয়ে ফেলেছে সে। ভিতরে ভিতরে যে কি ভোগান্তিটা ভুগেছে ও, সেটা ওর বিদ্ধস্ত চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।অবশ্য নীতুর মা ছাড়া আর কেউই ব্যাপারটা খেয়াল করে নি। দুএকবার নীতুকে বলেছেনও ।নীতু হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।বলেছে আজকাল ভার্সিটিতে পরীক্ষার চাপ পড়েছে খুব।নীতুর মা সেজন্য আগের থেকে বেশী যত্ন নেন মেয়ের।

বিড়ালের মতো নি:শব্দে রেডি হলো নীতু।দু-তিনদিন চলার মতো কাপড়চোপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে নিলো।ডেস্কের টেবিল থেকে ফাইল বের করে জন্মসনদ আর দুকপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি বের করে পার্টসে রাখলো।

খুব পিপাসা পাচ্ছেকেন জানি!স্নায়ু দূর্বল হয়ে গেছে বোধহয়।এসি রুমের মধ্যেও ঘামছে ননস্টপ। ডাইনিং-এ এসে কেবল জগে হাত দিয়েছে জগের


ঢাকনাটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে বিকট শব্দ করতে শুরু করলো। নীতুর মা ঘুম থেকে একটু সজাগ হলেন।ঘর থেকেই চিৎকার করে বললেন-'ওখানে কে?' নীতু ভয় পেয়ে ধরা গলায় বলল-'পানি খাব মা!'নীতুর মা আর কিছু বললেন না। নীতু ঢক ঢক করে অর্ধেক জগ পানি শেষ করলো। তারপর আগের থেকে দ্বিগুন সতর্কতার সাথে নিজের রুমে ফিরে গেলো।

ঘড়িতে সাড়ে চারটা বাজে।একটু পর ফজরের আজান দেবে।বাড়ির সবাই জেগে যাবে তখন।তার আগেই ওকে বাড়ি থেকে বেড়োতে হবে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে সজীবকে মেসেজ করলো-'আমি বেরচ্ছি।'
ওপাশ থেকে রিপ্লায় এলো-'সাবধানে!'
নীতুর রুমের সাথে লাগোয়া বেলকনি।যথাসম্ভব কম শব্দ করে ওটার দরজার তালা খুললো ও। নিজের রুমটা শেষ বারের মতো দেখে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপথ ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে দরজার দিকে এগোলো...

২.

রাস্তায় নেমেই জোরে জোর হাঁটা শুরু করলো নীতু।চারপাশে ভালোই কুয়াশা পড়েছে।সামনে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছেনা।বাইরে বের হওয়ার সাথে সাথেই গরম ভাবটা কেটে গেছে।তার বদলে ঠান্ডা লাগছে এখন।অক্টোবার মাসের শেষ দিক।শীত নামছে।এই সময়টা আবহাওয়া আঁচ করা যায় না। আগে জানলে শীতের কাপড় নিয়ে বের হতো ও।এখন আর উপায় নেই।সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে রাস্তার মোড়ে চলে এলো ও। সজীব মাইক্রো দাঁড় করিয়ে রেখেছে।গাড়িটা দেখেই নীতুর নিজেকে অসহায় মনে হতে লাগল।কাজটা কি ঠিক করছে সে?জেদের বশে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।পরিনাম কি হবে জানে না..


সজীব এগিয়ে এসে নীতুর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে লাগেজ বক্সে রাখলো।তারপর গাড়ির দরজা খুলো দিয়ে বলল-"ওঠো।হাতে সময় খুব কম আমাদের।"

গাড়ি ছুটতে শুরু করেছে।কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখার পর ধাতস্থ হলো নীতু। চোখ মেলে সজীবকে বলল-দশটার আগে পরীক্ষার হলে পৌঁছাতে পারবো তো সজীব?
-পৌছানোর পরেও আরও এক ঘন্টা হাতে থাকবে।ফ্রেশ হয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকতে পারবে।
-আমার ভয় করছে খুব।যদি চান্স না হয় ?
-না হওয়ার প্রশ্ন নেই।বাসার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।পরীক্ষা ভালো হবে।

আজগর সাহেব।নীতুর বাবা।চার মেয়ে আর এক ছেলের বাবা তিনি। স্থানীয় একটা ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ। সত্তর দশকের গ্রাজুয়েশন করা লোক।ভীষণ রাগী আর একগুয়ে স্বভাব। আজগর সাহেব মেয়ে মানুষ সহ্য করতে পারেন না।তার পেছনে কারণ যেটা আছে সেটাও অমূলক নয়।আজগর সাহেবের বড় বড় তিনটা বোন আছে।তাদেরকে বিয়ে দিতে গিয়ে ওনার বাবা অনেক দেনা-দরবার করেছিলেন।সেই দেনার ঘানি টানতে গিয়ে আজগর সাহেবের পড়াশোনা লাটে উঠেছিল প্রায়।ইচ্ছে ছিলো অক্সফোর্ড পড়ার।টাকার অভাবে হয় নি। তার বদলে থার্ড ডিভিশন নিয়ে টেনে টেনে পাশ করছেন।তার সাথের বড়লোকের ছেলেরা জজ-ব্যারিষ্টার হয়ে দেশ চালাচ্ছে।আর তিনি অখ্যাত একটা কলেজের প্রধান হয়ে বসে আছেন।যদিও তার সামাজিক মর্যাদা আর প্রতিপত্তির কোন অভাব নেই তবুও তিনি নিজেকে সুখী মনে করেন না। তার বিশ্বাস তিনি বোনদের জন্যই বড় কিছু করতে পারেননি।সেজন্য বোনদের সাথে খুব একটা যোগাযোগও রাখেন নি।

আজগর সাহেবের প্রথম সন্তান যখন মেয়ে হলো তখন তার খুব মন খারাপ হলো। মনকে বোঝালেন পরেরটা অবশ্যই ছেলে হবে।পরপর চারটা মেয়ে হওয়ার পর রাগে,দুঃখে তিনি স্ত্রীর সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিলেন।যদিও তিনি জানেন যে সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে এর জন্য তিনিই দায়ী।তারপরেও স্ত্রীকে তার অশুভ মনে হতো।চতুর্থ মেয়ে হওয়ার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন আর একবার বাচ্চা নেবেন তিনি।ছেলে না হলো আরেকটা বিয়ে করবেন। উপরওয়ালা হতভাগা বউয়ের দিকে মুখ তুলে চাইলেন।পাঁচবারের বার ছেলে সন্তানের বাবা হলেন তিনি।


এমনিতেই আজগর সাহেব তার মেয়েদেরকে দেখতে পারতেন না।ছেলে হওয়ার পরে মেয়েদের প্রতি স্বৈরাচারী হয়ে গেলেন।তিনি চার বোনকে তার ছেলের যত্নে লাগিয়ে দিলেন।ছেলে তার মস্ত বড় হবে একদিন।পরপর চারমেয়ে হওয়ার কষ্ট ঘুচবে তার।
বড় মেয়ে তিনটাকে কোনমতে এসএসসি পাশ করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন।

তার মতে মেয়ে মানুষ দিয়ে দুনিয়াতে দুইটামাত্র কাজ হয়।একটা হলো বাচ্চা দেওয়া আর একটা রান্না করা।এই দুইটা বাদে তাদের দিয়ে আর কিছু করা যে সম্ভব তিনি তা মানেন না।তাই মেয়েদের পড়াশোনা করানোর ধার দিয়ে যান নি।নিজে একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ হয়েও তার মেয়েদের ব্যাপারে তিনি চরম বামপন্থী।তাদের পেছনে একটা টাকা খরচ করতেও তার প্রচন্ড আপত্তি।মেয়ে বাড়িতে থাকবে,খাবে,বড় হবে আবার বিয়ের সময় টাকা খরচ করে বিয়েও দেয়া লাগবে। সবদিক থেকে লস।তার এসব ভালো লাগেনা।


নীতু মেয়েদের মধ্যে চার নম্বর, সবার ছোট।আজগর সাহেব এই মেয়েকে একটু বোধহয় ভয়ই পান।অন্য তিন মেয়ে তার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস রাখেনা কিন্তু নীতু মাঝে মাঝে বেশ ঝেড়ে দেয়।এক ধরনের জেদ করেই নীতু পড়া শোনা করে।
এইসএসসির রেজাল্টের পরদিন। নীতু একরম সাহস করেই আজগর সাহেবের রুমে গেল,ভার্সিটি কোচিং করার পারমিশন নিতে।আজগর সাহেব মুখের ওপর না করে দিয়ে বললেন- অনেক পড়াশোনা হয়েছে।এবার বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নাও। নীতু জানে আজগর সাহেবের "না" দুনিয়া ওল্টালেও "হা" হবে না।তাই সে বাবাকে আর দুবার সাধলো না।উপায় খুঁজতে লাগলো।

নীতুর সাথে সজীবের সম্পর্ক দুবছরের।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে জব করছে এখন।সজীব পড়াশোনার সবকিছু ম্যানেজ করে পাঠিয়ে দিলো নীতুকে।নীতু নাকমুখ বন্ধ করে পড়তে লেগে গেলো।একদিকে নীতুর বাবা পাত্র খোঁজেন আর অন্যদিকে নীতু খোঁজে ওর ভবিষ্যত।সজীবের সাহায্যে ঢাকা ভার্সিটি ফর্ম পূরণ করে ফেললো ও।এডমিট কার্ড হাতে পাওয়ার পরে নীতু আজগর সাহেবের কাছে আবার পরীক্ষা দেয়ার পারমিশন চেয়ছে।কিন্তু আজগর সাহেব তার আগের সিদ্ধান্তে অনড় থেকেছেন। বাধ্য হয়ে নীতু পরীক্ষার দিন বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে পরীক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।সজীব সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে। আজ সেই মাহেন্দ্রদিন।নীতু বাসা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।ভালবাসার জন্যে নয়।বড় হওয়ার জন্যে,নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্যে।পরীক্ষা দিয়ে নীতু ওর বড় বোনের বাসায় যাবে।দুদিন পর নিজের বাড়ি ফিরবে।পরীক্ষা দিয়ে এসে বাবাকে বললে বাবা রাগ হলেও পালিয়ে যাওয়ার অপরাধ মাফ করবেন নিশ্চয়ই...


৩.


ঘন্টাখানেক হলো কুঁড়িল ফ্লাইওভারে জ্যামে আটকে আছে নীতুদের গাড়ি।গাড়িঘোড়া নড়ছেই না। হাতে সময় আছে আর 40 মিনিট।নীতু টেনশানে ঘেমে গেছে।সজীব বারবার গাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে সামনে খানিকটা পায়চারি করে আসছে।জ্যামের খবরাখবর নিচ্ছে।কোন এক মন্ত্রী যেন গুলি খেয়েছে।তাকে হাসপাতালে নেয়া হবে।ইমারজেন্সি ভিত্তিতে ফ্লাইওভারের সামনের রাস্তা ক্লিয়ার করা হয়েছে।কতক্ষণ জ্যাম থাকবে কেউ জানেনা।সজীব কয়টা জায়গায় ফোন করলো একটা বাইক পাওয়া যায় কিনা!তাহলে ফাঁকফোকর দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা যেতো।পাওয় গেলো না।নীতুকে সজীব ব্যাপারটা কিভাবে জানাবে বুঝতে পারছে না।হতাশ হয়ে গাড়িতে উঠে এলো ও।নীতুর কাঁধে হাত রেখে বলল-"তোমার বোধহয় পরীক্ষাটা দেয়া হবে না নীতু।চল তোমাকে বাসায় রেখে আসি।"


নীতু সজীবের চোখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপরঅসহায় ভঙ্গিতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে।নিঃশব্দে কাঁদছে।সজীব হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে আছে নীতুর দিকে।কি বলবে বুঝতে পারছে না। ড্রাইভারকে ডেকে বলল-"ভাই, জ্যাম ছাড়লে গাড়ি ব্যাক করেন।যেখান থেকে আসছি সেখানে ফিরে যাব।"

নীতুর বাড়ি।গাড়ি থেকে নেমে নীতু ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে এগোলো।বাড়িতে ঢুকেই বুঝতে পারলো বাসার সবাই গুমোট হয়ে আছে।নীতুর রুমে ওর মা বসে আছে।নীতুকে বলল-"তোর বাবা ডাকে।ওনার রুমে যা।"
বলতে না বলতেই আজগর সাহেব নীতুর রুমে চলে এসেছেন।কোন রকম ভনিতা ছাড়াই বললেন-বাড়িতে এসেছিস কেন?
-বাবা,ঢাকা ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিতে গেছিলাম।
-এতো তাড়াতাড়ি পরীক্ষা দেয়া হয়ে গেল?
-জ্যামের জন্য পৌঁছাতে পারেনি সময়মত।পরীক্ষা না দিয়েই ব্যাক করেছি।
-বেয়াদপ মেয়ে।আমার সাথে চালাকি? ভোর না হতেই বাড়ি থেকে ভেগে গিয়ে বলছে পরীক্ষা দিতে গেছে!

-এটা ছাড়া আর উপায় ছিলো না বাবা।
-আমি শুনেছি সজীব ছেলেটা তোমাকে নিতে এসেছিল।তা ভেগেই যখন যাবে আবার ফিরে এলে কেন?সজীব বিয়ে করলো না বুঝি?
-বাবা,আমি তোমার কাছে পরীক্ষা দেয়ার পারমিশন চেয়েছিলাম।তুমি দাও নি বলে বাধ্য হয়েছি।

-ন্যাকামো যথেষ্ট হয়েছে।ব্যাগ গুছিয়ে ভোর না হতেই বয়ফ্রেন্ডের সাথে মানুষ পরীক্ষা দিতে যায় না। বাড়ি থেকে বের হও তুমি।এখনই বের হও...
-বাবা,তুমি একটু বোঝ।
-তুমি বের হয়ে যাবে নাকি আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব?
-এমন করে বোলো না বাবা।আত্নপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দাও।
-তোমার মায়ের কসম লাগে তুমি আমার বাড়ি থেকে বিদেয় হও।আমি তোমাকে ত্যাজ্য করলাম।
নীতু কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।মাথা নীচু করে বলল-যাচ্ছি বাবা।

মায়ের দিকে ভাবলেশহীন একবার তাকলো সে।তারপর গেটের দিকে পা বাড়ালো।নীতুর মা আজগর সাহেবকে বললেন-ছেলেমানুষি করো না।মেয়ে মানুষ ও।কোথায় যাবে?
-জাহান্নামে যাক।তোমার ইচ্ছে করলে তুমিও যাও।
দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিলেন আজগর সাহেব।নীতুর মা অসহায়ের মতো জুলঝুল দৃষ্টিতে গেটের দিকে তাকিয়ে থাকলেন....

নীতু সজীবের মুখোমুখি বসে আছে।
-বাসা থেকে একেবারে চলে এসেছি, সজীব।
-বল কি?
-আমাকে বিয়ে কর।বাসায় ফেরা সম্ভব না।
-আমি কেবল নতুন জবে ঢুকেছি।
-আমাকে বাবা মায়ের কসম দিয়েছে।বাসায় যেতে পারবো না।
-নীতু রাগের মাথায় বাবা কি বলেছে না বলেছে তার জন্য এতো অপরিনত সিদ্ধান্ত নেয়ার মানে হয় না।
-বিয়ে করবে কিনা?
-এতো আগে তো অবশ্যই নয়।নতুন চাকরি,নতুন দ্বায়িত্ব।গুছিয়ে নিতে সময় লাগবে।
-সজীব,আমার বাবাকে তুমি চেনোনা।আমি ফিরে গেলে হয় আমাকে আবার বের করে দেবে নয়তো বিয়ে দিয়ে দেবে।
-দেখো নীতু।তুমি ব্যাপারটা বুঝছো না।আমারও তো পরিবার আছে।আমি তাদের অবাধ্য হই কিভাবে?আমর বড় ভাই এখনো বিয়ে করেন নি তুমি জানো।
-এখন বিয়ে না করলে তুমি আমাকে হারাবে সজীব ।
-আমার কিছু করার নেই আমার সময় লাগবে।তুমি বাসায় ফিরে যাও।

 

সারাদিন এখানে সেখানে ঘোরাঘুরি করলো নীতু।সন্ধ্যা নামছে।বাইরে থাকাটা রিস্ক হয়ে যাচ্ছে।ভেবে পাচ্ছে না কি করবে এখন।
ছেলে মানুষ হলে দরকার পড়লে ষ্টেশনে কুলিগিরি করে খেত ও।কিন্তু মেয়ে মানুষ সে।এই নোংরা সমাজ তাকে একা গ্রহণ করবে না কোনমতেই।

একটা ছেলে সাররাত বাড়ি ছেড়ে একা বাইরে থাকলেও কোন মেয়ে তার দিকে ফিরে তাকাবেনা,ক্ষতি করা তো দূরের কথা।কিন্তু একটা মেয়ে রাতের বেলা বাইরে থাকবে পুরুষসমাজ সেটা মেনে নেবেনা।পারলে হায়েনার মতো ছিঁড়েকুড়ে খাবে মেয়েটাকে। একা একা কই যাবে সে?কি করবে? ছেলে হলে দিনমজুর খেটে হলেও পড়াশোনা করত সে।বাবার ভরসায় থাকতো না।

এসব ভাবতে ভাবতে একা একাই ফিক করে হেসে দিলো সে।ছেলে মানুষ হলে তার বাবা আজগর সাহেব তো কিডনি বেঁচে হলেও পড়াতেন।তখন কি আর এসব ভাবা লাগতো। নাহ্ আরেকবার বাসায় যাবে সে।বাবার পায়ে পড়বে।এমনকি বাবা বিয়ে দিলে বিয়েও করে নেবে।আগামী মাসে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা।ভার্সিটি হলো না।মেডিকেল মিস গেলে চলবে না।পরীক্ষা দেবে সে।তার জন্য বাবার কাছে যত নিচে নামা লাগুক সে নামবে।

বাসায় ঢুকে ডাইনিংয়ে গেলো নীতু।আজগর সাহেব দাঁত খিলাল করছেন।নীতুকে দেখেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন।নীতুর মার দিকে তাকিয়ে বললেন-কাল সকাল হওয়ার আগেই যেন ও বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।আমি ওর মুখ দেখবো না।
-বাবা,আমাকে ক্ষমা করো।তুমি যা বলবে আমি তাই করবো।

-তবে আমার সামনে আর কখনো আসবে না।তাহলে আমার মরা মুখ দেখবে।
আজগর সাহেব নিজের ঘরে চলে গেলেন।
নীতু অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।মাথা ঘুরছে ওর।যে কোন সময় মাটিতে পড়ে যেতে পারে। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিলো।দরজায় ছিটকিনি দিতে দিতে বলল-ঘুমোতে গেলাম মা।

রুমে ঢুকেই ফ্যান ছাড়লো সে।চার হাত-পা চারদিকে ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো।ফ্যানের ঘোরা দেখছে।মাথা ব্লাঙ্ক হয়ে আছে ওর।ভাবতে পারছে না কিছু।কি ভেবে চট করে উঠে দাঁড়ালো।ওয়ার্ডরোব থেকে দুটো জর্জেট ওড়না বের করে একসাথে বাঁধলো সে। ফ্যানের সুইচ অফ করে ফ্যানের স্ট্যান্ডের সাথে ওড়না বেঁধে ফাঁস বানলো।পড়ার চেয়ারটা টেনে ওটায় চড়ে ফাঁসটা গলায় পড়ে নিলো।থর থর করে কাঁপছে।দুচোখ বেয়ে অঝোরে করে পানি পড়ছে তার।পুরুষশাসিত সমাজের প্রতি ঘৃণা ধরে গেছে নীতুর।তার ভাই পড়াশোনা করতে চায়নি।অথচ তাকে ধরে বেঁধে বিদেশে পড়তে পাঠানো হলো।আর সে পড়ার জন্য ঘর পর্যন্ত ছাড়লো বিনিময়ে তার বাবা তাকে ঘর থেকে বের করে দিলেন!

দুচোখ বন্ধ করে ফেলল নীতু।কি মনে করে একদলা থুথু মেঝেতে ফেলল সে। সে থুথু যে আজগর সাহেবের মতো নারীবিদ্বেষী লোকদের উপর গিয়ে পড়লো তাতে কোন সন্দেহ নাই। নীতু আলতো করে পায়ের তল থেকে চেয়ারটা ঠেলে দিলো এবার।নারী হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিল সে।নারী হয়েই চলে গেল।মানুষ আর হওয়া হলো না....

তারপর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে।নীতু মারা যাওয়ার দুবছর পরেই নীতুর মা মারা যান।আজগর সাহেবের একমাত্র পুত্র বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে বউ-বাচ্চাকে নিয়ে বিলেতে থাকে এখন।মেয়েরা চাইলেও শ্বশুরবাড়ির চাপে বাবাকে তাদের বাড়িতে নিতে পারেন না। আজগর সাহেবের মাঝে মাঝেই নীতুকে মনে পড়ে।বেঁচে থাকলে নীতুটা নিশ্চয়ই কিছু একটা করতো এতোদিনে। শেষ বয়সে তাকে আর হয়তো এমন নি:সঙ্গ স্বজনহীন জীবন কাটাতে হতো না।ভাবতে ভাবতে আজগর সাহেবের চোখে জল এসে যায়।বড় নিস্ফল আর নি:সঙ্গ সে জল! অনেক বড় অন্যায়ের শাস্তিমাখা...

________________________________

মুশতারী মমতাজ মিমি
। Studied Bachelor of Medicine and Bachelor of Surgery(MBBS) at Rangpur Medical College

 

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়