Ameen Qudir

Published:
2017-03-13 15:16:43 BdST

রিটো একজন অতি মাত্রায় ইন্টেলিজেন্ট এবং সাহসী ভাইরাস



ডা. অনির্বাণ বিশ্বাস
_________________________


রিটো একজন অতি মাত্রায় ইন্টেলিজেন্ট এবং সাহসী ভাইরাস । স্মল সেল লাংস ক্যান্সারের(SCLC)( এক ধরনের লাং ক্যান্সার) অন্যতম ভাইরাস, সেনেকা ভ্যালী ভাইরাসদের জগতে প্রায় সব বড় বড় পরীক্ষাতেই সে খুব ভাল রেজাল্ট করে উর্ত্তীর্ণ হয়েছে । এখন সে জুনিয়র ভাইরাসদের ক্লাস নিতে পারে । এত অল্পবয়সে জেনেটিক মিউটেশনে পারদর্শীতা খুব সহজ কথা নয় ।

তার সবচেয়ে ভাল লাগে ক্লাসের সময়টা । অসংখ্য ছোট ছোট ভাইরাসদের দেখে মনটাই ভাল হয়ে যায় । কলোনী যত বাড়বে, তত বেশী হিউম্যান সেল পাওয়া যাবে । ভাবতেই বুকটা ভরে যায় রিটোর । আর ভাইরাসগুলো কি মনযোগ দিয়েই না তার কথা শোনে ! তবে এদের প্রশ্নগুলোও হয় অদ্ভূত । এই যেমন আজকে এক পুচকে ভাইরাস জিজ্ঞেস করে, কেমোথেরাপির সময় আমরা কেন বাড়ি পাল্টাই ?কেন আমরা সবাই মিলে ওটার বিরুদ্ধে একবারে লড়াই করিনা ? খুবই অদ্ভূত প্রশ্ন ।
রিটো জীবনেও এই ধরণের কথা শোনে নি । কোন উত্তরও এলো না তার মুখে । বাচ্চাগুলি এমন খুশী হলো বলার না । মেজাজ পুরোপুরি খিঁচড়ে গেল তার । একমাত্র ভালোলাগার জায়গাটাও অসহ্য বোধ হচ্ছে আজকাল । তবে এমন কিছু করতে পারলেও মন্দ হয়না । সারাক্ষণ সার্ভাইভালের চিন্তায় চিন্তায় ছোট্ট জীবনটা কেটেই যায় একভাবে । উপভোগ করার সময় কোথায় ?

আজকে ক্লাসের শেষে প্রফেসর উইজার্ড রিটোকে ডেকে পাঠালেন । খুব জরুরী সভা নাকি । সভায় পৌঁছে জানা গেল আজকেই ছেলেটার ব্রেইন অবসার্ভেসনের জন্য ভাইরাস মনোনীত করার দিন । অনেকদিন হয়ে গেছে, তারা ফুসফুসে আছে । টিউমারটাও তাদের দখলে । ডাক্তারেরা হয়ত বুঝে ফেলছে ব্যাপারটা । সেই দিন ঘুমানোর সময় এক্সরে’র মারাত্মক রে’ টাও টের পাওয়া গেল তাদের ছোট্ট সেলে । তারপর থেকেই সবাই একটু চিন্তিত । হয়ত কেমো আসা শুরু করবে কিছুদিনের মধ্যেই । ভাইরাসদের জীবনটা এত অদ্ভূত কেন ! একটুও শান্তিতে বসবাসের যো নেই !

‘‘…আপনারা সবাই তো জানেন, আমার বাবার কথা । গতবারের মেয়েটার মাথায় তিনিই প্রথম অ্যাক্সেস নিয়েছিলেন । খুবই নীরবে এবং সফলতার সাথে টিকেছিলেন অনেকগুলো মাস । এবং মানুষগুলোর কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন আমাদের । শেষ পর্যন্ত তারা যখন বুঝতে পারলো, তখন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে । রেডিয়েশন থেরাপীর এক পর্যায়ে যখন আমাদের টিকে থাকাটা খুব কষ্টের হয়ে গিয়েছিল, তখন বাবা বলতেন…’’

‘‘এক্সকিউজ মি, মিঃ রিটো । আপনার সময় শেষ ।’’
সবাই কেমন বিরক্ত মুখে বসে আছে । আশ্চর্য ! এই গল্প না হয় অনেকবার করা হয়েছে তাদের কাছে । তাই বলে এইভাবে বিরক্ত হওয়ার কি আছে ? তাছাড়া আজকের দিনে এটা ছাড়া আর কিই বা বেশী গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকতে পারে ? কুৎসিত ভাইরাসগুলোর হিংসায় ভরা মন !
পুরো সভায় এরপর আরো অনেকক্ষণ অনেকেই অনেক বিরক্তিকর কথা শোনালো । শেষমেশ রিটোকে সিলেক্ট করা হল । সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল । প্রফেসর উইজার্ড ভারিক্কি গলায় কিছুক্ষণ মানুষের ব্রেনে টিকে থাকাটা কত কঠিন এবং তাদের এই অভিযান তাদের পুরো কলোনীর জন্য কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তার উপর ছোটখাট বক্তৃতা দিলেন । মানুষের ব্রেইনের সবচাইতে আকর্ষণীয় জায়গা, মানুষের স্মৃতিতে একমাত্র আরোহন করতে সক্ষম ভাইরাস তারা হলেও, রিটোর বাবা তাদের কলোনীকে ঠিক কতোটা ভালবেসে আজীবন স্মৃতি থেকে দূরে ছিলেন, সেই স্মৃতিচারণ করলেন খানিকক্ষণ । সবাই তাঁর কথা স্মরণ করল ভক্তি ভরে ।

ব্রেন সেলে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা সবসময়েই মনে রাখার মত ।ক্যান্সার আক্রান্ত ছেলেটার অলস লিম্ফোসাইটগুলো এইখানেই সবচাইতে সচল যেন ! পুরো লিম্ফোসাইটদের কলোনীতে হুলস্থূল পড়ে গেল । বিরক্তিকর বুড়ো লিম্ফোসাইটগুলো যেন যুগ যুগ ধরে ক্ষুধার্ত । তাদেরকে কি আর দশটা ভাসমান প্রোটিন সেলের মত দেখাচ্ছে ? রিটো এমনকি তাদের সাথে যুদ্ধে যাওয়ার আগ্রহ ও বোধ করলো না । নির্বোধ লিম্ফগুলো জানেও না, তারা কার পিছনে ছুটছে !

রিটো যত দ্রুত সম্ভব ব্রেনের ডাটা নিচ্ছে ।চারপাশটা এত ঠাণ্ডা আর গুমোট কেন।কিছুতেই স্মৃতিতে ঢুকবেনা,রিটো ঠিক করেছে...মানুষের স্মৃতি সেনেকা ভাইরাসকে দূর্বল করে,রিটো জানে।

আজ ব্রেইনের সব ডাটা নেয়া শেষ হবে । এই কয়েকদিন বেশ উত্তেজনায় গেছে রিটোর । লিম্ফোসাইটগুলোর তাদের কৌশলের সাথে প্রায় তাল মিলিয়ে নতুন কৌশল আয়ত্ত করতে দেখেও চমৎকৃত রিটো । তবে যতটা ভাল যেতে পারত সময়টা, ততটা ভাল যায়নি ।ছেলেটার এত দূর্বল ইমিউন সিস্টেম দেখে রিটো খুশি। একবার ছেলেটার স্মৃতিতে উঁকি দিলে কেমন হয় !!

ছেলেটার স্মৃতির ঘরটা কেমন এলোমেলো । অসংখ্য মুছে যাওয়া স্মৃতির অবশিষ্টাংশ চারপাশে । ওতে কিছু কবিতা ...তার মাঝে হঠাৎ ভেসে এল একটা মেয়ের মুখ । গালে কান্নার শুকিয়ে যাওয়া দাগ । দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকা মেয়েটার গায়ে রোদের আলো । পুরো দৃশ্যটার মাঝে এত অপার্থিব কষ্ট লুকিয়ে থাকতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হতো না কোনদিন রিটোর ! মেয়েটার গায়ে হঠাৎ বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল । সেই ফোঁটা মেয়েটাকে ধুয়ে দিতে চাইল স্মৃতি থেকে ....

আর পারা যাচ্ছে না...ভাগ রিটো..রিটো দুদ্দার দৌড়য়...এক নিউরোনের গা বেয়ে ছিটকে কোথায় যেন পড়ে রিটো... ডাটা বেস ছিটকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে ......

( একটি বিদেশী গল্পের ছায়ায়...)

_____________________________
ডা. অনির্বাণ বিশ্বাস । প্রখ্যাত লেখক । কবি। বাংলা র লোকসেবী চিকিৎসক।
প্রোফেসর, পালমোনারি মেডিসিন এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ, কলকাতা ।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়