Ameen Qudir

Published:
2018-07-04 17:54:44 BdST

চিকিৎসা দিতে গিয়ে সেবার ভীষন বিপদে পড়েছিলাম



ডা. মৃণাল সাহা
_______________________

(১)

চিকিৎসা দিতে গিয়ে একবার ভীষন বিপদে পড়েছিলাম।
সে সময় আমার আশেপাশের অনেকেই আমার ভুল ধরতে উঠে পড়ে লেগেছিলো। যিনি আমাকে বিপদ মুক্ত করেছিলেন আমি এখনো তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। আমি ভীষন হতাশ ছিলাম আর রোগী দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিলাম। অবশেষে যিনি আমাকে দোষ দিচ্ছিলেন তিনি তাঁর ভুলটা বুঝতে পেরেছিলেন। এই মধ্যস্থাকারীরা আছেন বলেই ডাক্তাররা এখনো বেঁচে আছে, বাংলাদেশে কাজের পরিবেশ আছে।

ডাক্তারের অবহেলায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ ক্রমশই মহামারী হয়ে উঠছে। মেডিকেল সায়েন্সের নূন্যতম জ্ঞান কিম্বা ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হয়েই আমরা ডাক্তারের কাছে যাই। একে ধরে, ওর কাছে শুনে, বিজ্ঞাপন আর ডিগ্রী দেখে আমরা ডাক্তার সিলেক্ট করি।ডাক্তারদের উপর আমাদের একেবারেই বিশ্বাস নেই। রোগীর মৃত্যু হলে প্রায়শই আমরা উত্তেজিত হয়ে উঠি, অনেক ক্ষেত্রে বিদ্রোহী হয়ে হাসপাতাল ভাংচুর করি, কখনো ডাক্তারকে মারধর করি। কাজের পরিবেশ সুনিশ্চিত করতে আমরা যা করছি তা কতটা যৌক্তিক? এতে রোগী ও চিকিৎসক সম্পর্কের দ্রুত অবনতি হচ্ছে, সম্পূর্ন চিকিৎসা ব্যবস্থাই নজুক পরিস্থিতির দিকে চলে যাচ্ছে।

(২)

কারো স্বজন হারানোর ব্যথা আমাদেরকেও ব্যথিত করে। কিন্তু এই ব্যথার ভার মাঝে মাঝে এতটাই বেশী হয়ে যায় যে, সারা জীবনের জন্য ডাক্তারী করাটাই হুমকীর মুখে পড়ে যায়। কেন এমন হবে? রোগী মৃত্যুর ফলে ডাক্তারের অবহেলার ঘটনা হয়তো হাতে গোনা, কিন্তু সেই হাতে গোনা ঘটনা গুলোকে এভাবে হাইলাইট করলে জনগনের মাঝে ডাক্তারদের প্রতি ক্ষোভ আর বিরূপ মনোভাব আরো তরান্বিত হবে সন্দেহ নেই!

একজন ডাক্তারের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ উঠলেই তাকে গ্রেফতার করার অনুমতি আছে কি? আইন অনুযায়ী এটা অযৌক্তিক। কেউ দোষী সাব্যস্ত হবার আগে তাকে খুনী বলা যায় না অথচ ডাক্তারকে ভুল চিকিৎসার দোষ দেয়া যায়, খুনী বলা যায়। এটা কিন্তু বেআইনী এবং ডাক্তারের তথা সমাজের জন্যই ন্যাক্কারজনক। এভাবেই চিকিৎসা সেবা ব্যহত হচ্ছে।

(৩)

ডাক্তারদের কোন অভিভাবক নেই, যদিও বা এক দুইজন জীবন বাজী রেখে অভিভাবক হন, তখনই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, আসে চক্রান্ত। এই আত্মত্যাগী মানুষ গুলোকে যে জাতির ভীষন প্রয়োজন এই কথা সাধারণ মানুষকে কে বুঝাবে? আমাদের দেশে বর্তমান সময়ে দক্ষ ডাক্তারের অভাব নেই, অভাব রয়েছে এমন দক্ষ পরিচালকের যারা ডাক্তারদেরকে তাদের অভিভাকত্ব দিয়ে সুন্দর একটা দিক নির্দেশনা দেবেন। এমনই একটা বিএমএ আমরা চেয়েছিলাম। কথায় কথায় ডাক্তাররা বিএমএ কে অভিযোগ করতো, তাদের পেছনে দাঁড়ানোর কেউ ছিলো না।

সেই যুগ এখন আর নেই। চট্টগ্রাম বিএমএ দেখিয়েছে কিভাবে ডাক্তারদের পাশে দাঁড়াতে হয়। চট্টগ্রাম বিএমএ এর সম্মানিত সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী খুব সুন্দর ভাবেই এই কাজ গুলো করে আসছিলেন। উনি এত দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন যে উনার বিরুদ্ধে মামলা আর হয়রানীর শেষ নেই। উনার একান্ত প্রচেষ্টায় বিনা বিচারে গ্রেফতারকৃত ডাক্তার থানা থেকে মুক্তি পেয়েছেন, তাই উনাকে অভিনন্দন জানাই। একটা কথা প্রচলিত আছে, আপনি যখন বেশী আলোচিত হবেন ধরেই নেবেন সমাজে আপনার একটা অবস্থান তৈরী হয়েছে। ফয়সাল ভাই সেটা করে নিয়েছেন। এর পেছনে কতটা ত্যাগ আছে সে প্রসংগে না যাই।

(৪)

- হাসপাতালে মানহীন খাবার পরিবেশন, ক্যান্টিনের উন্নয়ন উনার হাতেই। হঠাৎ একদিন দেখলাম কেন্টিনের চেহারা বদলে গেলো। এখানে ডাক্তার এবং সাধারন মানুষ দুজনেরই লাভ।

- মানহীন ল্যাব আর দালাল প্র‍্যাক্টিস বন্ধ করতে গিয়ে উনার অনেক কষ্ট হয়েছিলো। অনেক সিন্ডিকেট এর চক্ষুশূল হয়েছিলেন। এটা কিন্তু উনি সাধারণ মানুষের ভালোর জন্যই করেছিলেন।

- ডাক্তারদের বদলী বানিজ্য এখন আর নেই। তিনি নিজের দক্ষতা দিয়েই মধ্যসত্তভোগীদের হাত থেকে আমাদের বাঁচিয়েছেন।

- ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী নিজের উদ্যোগে ভুয়া ডাক্তার দেরকে উচ্ছেদ করেছেন। নিজ দায়িত্বে পুলিশ ও প্রশাসনকে সহায়তা করে প্রকারান্তরে সাধারণ মানুষেরই উপকার করেছেন।

- ডাক্তারদের নিয়ে মানববন্ধন হয়েছিলো আবদুল্লাহ স্যারের ঘটনায়, ফরিদপুরের ঘটনার সুন্দর সমাধান হয়েছিলো। সেদিন দেখেছি কিছু ডাক্তার আন্দোলন চালিয়ে গেলেও বাকীরা কিভাবে হাসপাতাল সচল রেখেছিলো। সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা দিয়েও কিভাবে সুন্দর ভাবে আন্দোলন চালানো যায় সেটাই বিএমএ দেখিয়েছে।

(৫)

কিছুদিন আগে ফয়সাল ভাই সহ কয়েকজন স্যার এর উক্তি বিকৃত করা হলো। এরপর ফয়সাল ভাই মামালার আসামী হলেন একজন দুর্নিতিপরায়ন মানুষের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে গিয়ে। তিনি ব্যক্তি ইমেজ এর বাইরে গিয়ে সব দায়িত্ব পালন করেছেন বিএমএ এর পক্ষ থেকে। অথচ যখন অভিযোগ আসে তখন উনার উপরই ব্যক্তিগত আঘাত আসে।

সাধারণ মানুষ কোনদিন বুঝবেন না একজন মানুষ কি ভাবে ডাক্তার হয়েও উনাদের জন্যই কাজ করেন। আর ডাক্তারদের নেতা হয়েও তিনি কিভাবে ডাক্তারদের ভুল গুলো চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। শাসন করা তারেই সাজে সোহাগ করে যে। ডা.ফয়সাল ইকবাল কখনোই ডাক্তারদের ভুলকে প্রশ্রয় দেননি, আর অভিভাবক হিসেবে তিনি ডাক্তারদের পেছনে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক।

(৬)

সবধরনের সংগঠনের নেতাই তার পেশার মানুষের জন্য প্রতিবাদ করেন। ডা. ফয়সাল ইকবালও তাই করবেন এটাই স্বাভাবিক। তিনি যে নীতির প্রশ্নে আপোষহীন সেটা সবাই জানেন। কোন ডাক্তার কোন রকম দুর্নীতি করলে বিএমএ অবশ্যই সেটার প্রতিবাদ করেছে এবং করবেন। কাজেই ডাক্তারদের প্রতি অভিযোগ থাকলে বিএমএ কে অবহিত করাটাই সাধারণ মানুষের কাজ হওয়া উচিত। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া সমাধানের কাজ হতে পারে না। এটাই উনি বোঝাতে চেয়েছেন।

পরিশেষে বলবো, একজন ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী যুগে যুগে আসেন না। অনেক ত্যাগের বিনিময়েই আজকের অবস্থানে। সে আসন একেবারেই ঠুনকো নয়। বিরোধীদলের রাজনীতি, সন্ত্রাসীর বুলেট, জেল, আইনী লড়াই এসব কিছুই উনার কাছে নতুন নয়। একজন মুজিব আদর্শের সৈনিক কখনোই আদর্শের সাথে সমঝোতা করেন না। যত বাধাই আসুক ডা. ফয়সাল ডাক্তারদের আশার আলো হয়েই থাকবেন এই প্রত্যাশাই থাকলো। উনার প্রতি ডাক্তারদের যে অগাধ আস্থা আর ভালোবাসা আছে সেটাই উনাকে পথ দেখাবে। ঈশ্বর উনার মঙ্গল করুন।


_______________________________

ডা. মৃণাল সাহা। সুলেখক।

 

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়