Ameen Qudir

Published:
2017-09-19 15:56:46 BdST

হাসপাতালের জার্নালসাম্প্রতিক জ্বর ও আমাদের হাসপাতাল




 

ডা.অরুণাচল দত্ত চৌধুরী

________________________________

 

খবরের কাগজ ও সাম্প্রতিক টিভি খবরে সবাই এখনকার জ্বর আর সেই সঙ্গে ঘটে যাওয়া কিছু মৃত্যু সম্বন্ধে অল্প বিস্তর জেনেছেন।
এই ব্যাপারে আমার নিজের যে'টুকু জানা হয় তো অকিঞ্চিৎকর কিন্তু জানাবার প্রয়োজন বোধ করছি। একটা ডিসক্লেমার দিয়ে রাখি। আমার জানার সীমানা সমস্ত ভারত বা পশ্চিমবঙ্গ সম্বন্ধে নয়। এমন কি পুরো উত্তর চব্বিশ পরগনা সম্বন্ধেও নয়।


আমি বারাসত হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডেই সীমাবদ্ধ থাকব। আমাকে এই ওয়ার্ডে কাজ করতে হয়। অফিসিয়ালি মেল ওয়ার্ডে বারান্দা মিলিয়ে বেড সংখ্যা ষাট, ফিমেল ওয়ার্ডেও প্রায় তাই। সাধারণ ভাবে বছরের যে কোনও সময়েই ভর্তি হলে বিছানায় চান্স পাবার সম্ভাবনা কম। মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে নতুন ভর্তি রোগীকে রাখা হয়।।তাঁরা বিছানা খালি হলে প্রোমোশন পান। এ'টি বছরের সব সসময়েরই চিত্র।
প্রথমেই এই ছবিটা দিলাম, কারণ তাতে সমস্যার ব্যাপকতা বুঝতে সুবিধে হবে।

 

প্রসঙ্গ ১)
বেডের বর্তমান অবস্থাঃ-
গত কয়েক সপ্তাহে মেডিসিন ওয়ার্ডে মোট ভর্তির সংখ্যা জ্বরের জন্য বেড়ে গিয়ে দিনে দু'শ' থেকে তিনশ' হয়েছে। যেমনটি রটছে সেই খবর মত, জ্বরের রোগীদের আউটডোর বা এমারজেন্সি থেকে মোটেই ফেরানো হচ্ছে না। সত্যি বলতে কী ফেরানো সম্ভবও না। গায়ে ধূম জ্বর, মুখ চোখ লাল টক্সিক লুক। জ্বর নেই, হাতের ব্লাড রিপোর্টে ডেঙ্গুর রিপোর্ট এনএসওয়ান পজিটিভ, বা প্লেটলেট কাউন্ট কমের দিকে, স্থানীয় হেলথ সেন্টার বা ডাক্তার বাবু বা খবরের কাগজ পড়া বিশেষজ্ঞ দাদা পইপই করে বলেছেন ডেঙ্গু হয়েছে। রোগীর মুখ আমসিপানা। বাড়ির লোক পাড়া প্রতিবেশী মিলিয়ে উদ্বিগ্ন জনা দশেক মানুষ। । আর এমন অনিশ্চিত এই ডাক্তারিশাস্ত্র, সত্যিই যে ভর্তি হতে আসা কেউ ফিরিয়ে দেবার পর মারা যাবেন না, গ্যারান্টি দিয়ে বলার উপায়ই নেই। কাজেই সবাই ভর্তি।
ওয়ার্ডে এসে টের পাওয়া গেল, মাটিতে কম্বল বিছানো। তা'ও নির্ধারিত ঘর-বারান্দা ভর্তি হয়ে যাবার কারণে নতুন খোলা দু'টো ঘরে। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে শুতে হচ্ছে। কুছ পরোয়া নেই। তার মধ্যেই স্যালাইনের বোতল চলবে। চিকিৎসা চলছে বোঝানোর একমাত্র রাস্তা ওই ঝুলতে থাকা স্যালাইন। কে চালাবে স্যালাইন? কেন, সিস্টার! দু'শ তিনশ' রোগীর জন্য বরাদ্দ পাঁচ কিম্বা ছ'জন। হন্তদন্ত হয়েও সামলাতে পারছেন না। পারা সম্ভব নয়, তবু সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে চলেছেন তাঁরা।

 

ল্যাবরেটরি নাজেহাল। রিপোর্ট, আমি করতে বললে হবে। আমাকেই রিকুইজিশন লিখতে হবে।
আর আমি?
অ্যাডমিশন ডে, আমার নামে ভর্তি হওয়া সব রোগীকে রাউন্ডে অন্তত একবার ছোঁবার চেষ্টা করছি। পেরে উঠছি না। মাটিতে শোয়া পেশেন্ট ডিঙি মেরে দেখতে(?) হবে বাষট্টি বছর পেরোনো আমাকে, আমার কোমর আর হাঁটুর প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে।
পাঠক খেয়াল করবেন, এই দু'শ রোগী, যাঁদের রাউন্ডের সময় আমায় দেখতে হচ্ছে, সব কিন্তু জ্বর নয়। মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছেন হার্ট অ্যাটাক বা হার্টফেইলিওর, শ্বাসকষ্ট, সেরিব্রাল স্ট্রোক, হেপাটাইটিস, কাশিতে রক্ত ওঠা টিবি আর অন্যান্য রোগীরাও। সব এক জায়গায় গাদাগাদি। আর আমি নাকি তাঁদের দেখছি(!)। আপনি যদি সত্যিই বিশ্বাস করেন চিকিৎসা চলছে, আপনাকে চিত্তের সারল্যের জন্য 'বিশ্বাসশ্রী' গোছের পুরস্কার দিতেই হবে।

 


প্রসঙ্গ ২)
কী চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছেঃ-
ধরুন এই জ্বরের রোগীদের। ভর্তি হবার পর কোনও প্রমাণ ছাড়াই দেওয়া হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। না দিয়ে উপায়ই বা কী? এই এত ভিড়ে, প্রায় মুখোমুখি শোওয়া রোগীদের ক্রস ইনফেকশনের ভয় তো সব সময়। কিন্তু ব্যাপারটা যারপরনাই অবৈজ্ঞানিক হচ্ছে নিঃসন্দেহে। এক সদ্য পাশ করা ডাক্তারের নিকটাত্মীয়কে ভর্তি করা হয়েছিল জ্বর আর কম প্লেটলেট কাউন্টের জন্য। তিনি ঘোরতর আপত্তি জানালেন। আমি বেড হেড টিকিট বাড়িয়ে দিয়ে বলতে বাধ্য হলাম লিখে দিন অ্যান্টিবায়োটিক দিতে আপত্তির কথাটা। তিনি খানিক বাদে যাচ্ছেতাই গালাগালি( কাকে আবার? আমাকেই…) দিয়ে রোগীকে নিয়ে গেলেন অন্য কোথাও, যেখানে হয় তো মেঝে খালি, এক বিছানায় একজন।
মাটিতে বা বেডে, জ্বর ছাড়াও অন্যান্য ভিড় করা রোগীদের দেখে(?) কী চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব তা' একমাত্র লটারি-দেবতা বলে কেউ থাকলে একমাত্র তিনিই জানেন।
রোগীর অভিভাবক হিসেবে আপনি গ্যারান্টেড একশ' শতাংশই চান।
আমি জানি।
আজ্ঞে হ্যাঁ, এই আমি।
যে আমি, জেনারেল মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ না হয়েও সরকারি পুতুলনাচের আঙিনায় সরকারি নির্দেশে জেনারেল মেডিসিনের বেড দেখা পুতুলের ভূমিকায় হাত পা মাথা নাড়ছি।
আপনি যখন অসহায় ক্রোধে আছড়ে পড়বেন, আপনি জানতে পারবেনও না, যথার্থ বিশেষজ্ঞ নয় এমন একজন বাধ্য হয়ে আপনার প্রিয়জনকে দেখেছে, মানে রোগীর স্রোতের মধ্যে দেখার চেষ্টা করেছে।

 

চেষ্টাই। বিশ্বাস করুন, চেষ্টার বেশী কিছু কার্যকরী সে করে উঠতে পারে নি বাস্তবে।
এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা না বললেই নয়। আমাদের হাসপাতালে, প্রয়োজন থাকুক না থাকুক, কিছু বিশেষ ওষুধ যে'টি হাসপাতালে পাওয়া যায় না(বা, এমন কী পাওয়া গেলেও) কিনবার জন্য লিখে দেওয়া হচ্ছে। মজার কথা, বেড হেড টিকিট হাতে দিয়ে সেই ওষুধ এমারজেন্সিতেই ছিপি খুলে রোগীকে খেতে বাধ্য করা হচ্ছে। ছিপি খোলানোর কারণ, সে'টি যাতে আর ফেরৎযোগ্য না থাকে! আর ওষুধটা( অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুকরালফেট লিকুইড) কেন লেখা হচ্ছে? কারণটা লজ্জার, কিন্তু হাসপাতালের সবাই জানে। এক শিশি ওষুধের দাম আড়াইশ' টাকা। প্রাপ্য কমিশন ২৫%। কে পায় সেই কমিশন। যিনি লেখেন, একমাত্র তিনিই জানেন।
প্রসঙ্গ ৩)
মিডিয়ার কথাঃ- যত কম বলা যায় ততই ভালো। আমি আর কে বলুন? এই ফেসবুকটুকেই যা সামান্য লিখি। তো সেই সব পড়েই সম্ভবত আকর্ষিত হয়ে এক আনন্দিত সাংবাদিক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলেন। কী ভাবে? বলি শুনুন, সে'খানেই তো আসল মজাটা। আমার কোনও এক প্রশাসক আমাকে টেলিফোনে ডেকে বললেন,
"দাদা, আপনি ফেসবুকে কী সব লিখেছেন। অমুক সাংবাদিক ফোনে জিজ্ঞেস করলেন আপনার কথা। আপনাকেও আগামীকাল ফোন করবে"। প্রশাসক একটু থেমে যোগ করলেন, "চাকরি জীবনের শেষে এসে কেন আবার ঝামেলায় যাচ্ছেন দাদা। বুঝছেনই তো, পাওনাগণ্ডা সব আটকে গেলে…"
আমি সত্তরের 'মারীচ সংবাদ' দেখা পাবলিক। মারীচকে কেস দেওয়ার দশাননীয় শাসানি বিলক্ষণ স্মরণে আছে আমার।
পরের দিন সাংবাদিক ফোন করতেই, তাঁকে সবিনয়ে বললাম, 'আজ্ঞে হ্যাঁ, হাসপাতালের ব্যাপারে এ'রকম ফোনে তো সব বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়।


থ্রু অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আসুন, তাঁদের সামনে বসে কফি খেতে খেতে না হয় জানানো যাবে এখন।'
এই যে সাংবাদিকটি নিজের ডেস্কে বসে খবর রচনা করতে চাইলেন, তিনি চাইলেই বিনা পরিচয়ে আমার হাসপাতালে এসে চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করে যেতে পারতেন। আমাদের হাসপাতালে চব্বিশঘণ্টা পেশেন্টপার্টি ঢোকে বেরোয়। ভিজিটিং আওয়ারে পারলে ফুচকাওয়ালাও ঢোকে। ঘোড়ার মুখের খবর জোগাড় এমন কী আর ব্যাপার?
না, আমাকে ফেসবুকে ইনবক্সে যোগাযোগ করলেও অতিবাধ্য সরকারি চাকর আমি, কোনও সুবিধে হবে না কিন্তু।
আমাকে দিল্লি প্রবাসী বোন জিজ্ঞেস করেছিল, তোমরা যে রাউন্ড দাও তখন কী কী কর তোমরা আসলে?


আমি বুঝিয়ে বলেছিলাম, আমাদের সম্মিলিত কাজ হচ্ছে প্রতিদিন ভর্তি থাকা মোট দু'শ তিনশ' রোগীকে হয় ছুটি দেওয়া, নয় রেফার করা, নইলে ডেথ সার্টিফিকেট। কারণ, আজকে ঠিক ওই পরিমান রোগী ভর্তির জন্য আসবেন।
হ্যাঁ, প্রশাসক তা'ই বলেছেন।

_______________________________


ডা.অরুণাচল দত্ত চৌধুরী। বাংলার প্রখ্যাত লোকসেবী চিকিৎসক । কবি ও সুচিন্তক।

আপনার মতামত দিন:


ক্লিনিক-হাসপাতাল এর জনপ্রিয়