Ameen Qudir
Published:2018-10-29 17:41:37 BdST
এসবিএমসির দিনগুলো এবং হোসাইনের জন্য প্রার্থনা
ডা. ছাবিকুন নাহার
_________________________________
নিরানব্বই এর কোন এক মায়াময় সকালে অবাক করা চোখ আর কাঁপন ধরা বুক নিকে নিয়ে ক্যাম্পাসে হাজির হই। যা দেখি সব যেনো চোখে বসে যায়। বড় বড় হল রুম, বিশাল বিশাল দরজা জানালা, ক্যাম্পাসের ছায়া পথ আর ইয়া বিশাল হাসপাতাল সবই আমার লিলিপুট চোখে গালিভারের ন্যায় চক্রবৃদ্ধি হারে জুম হয়ে চারপাশে ঘুরতে লাগল কিংবা বলা যায়, আমিই বিন্দু থেকে বিন্দু হয়ে শেবাচিমের আকাশ বাতাশ পানি মাটির সাথে মিশে গেলাম যেনো। প্রিয় কিছু জিনিসের একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে, ওম থাকে, মায়ের কোলের মতো মায়া থাকে, তেমনি একটা ব্যাপার ঘটে গেলো আমার ভিতর ক্যাম্পাসকে ঘিরে। এই অনুভূতি আরো জোড়ালো হলো যখন মাইগ্রেশন ফর্ম পুরণ করে সাইন নিতে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে গেলাম। স্যার বললেন, আরেহ, মুন্সিগঞ্জ কোন দুরত্ব হলো? মাইগ্রেশন ফরম পুরণ করতে হবে না, আমরা আমাদের মেয়েকে দিয়ে আসব নিয়ে আসব! এরপর আর কথা চলে না, মাইগ্রেশন ফরমে স্যারের ফাইনাল সাইন আর নিলেন না বড় ভাইয়া। এমন অভিভাবক ছেড়ে কোন মেয়ে পরের বাড়িতে পড়তে যায়!
ভর্তির ফর্মালিটি শেষে খেতে গেলাম সদর রোডের রয়েলে। ভর্তি প্রক্রিয়ার সবটুকুই করেছেন মেডিসিন ক্লাবের সিনিয়র ভাই সুরজিৎ দত্ত, কবে ক্লাশ শুরু হবে, সেই ব্যাপারটিও জানাবেন বলে আশ্বস্ত করেছিলেন এবং চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত তখন মোবাইল কেবল আসি আসি করছে। শেবাচিমের প্রথম দিনেই বুঝে গেলাম, এইখানেই খরচ হবে কিংবা জমা হবে আমার সোনালী আলোর দিনগুলো। তারপরও কেমন যেনো হাহাকার লাগে! এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কিভাবে থাকব? উল্লেখ্য যে বরিশাল তখন আমার জন্য বিদেশই ছিলো। গ্রামীন সবুজে আমার বেড়ে ওঠা। দখীনের হাওয়া, পশ্চিমের সূর্য ডোবা আলোয় ঘাসের গালিচায় হুটোপুটি খাওয়া এই আমার বাইরের পৃথিবী খুব একটা চেনা ছিলো না। কিভাবে কাটবে এখানে? একজনকেও তো চিনি না। তারপর আচমকা হোসাইনকে দেখলাম। বিশ্বাস করেন আমি ঠিক বোঝাতে পারব না, ওকে দেখে কতটা আনন্দিত হয়েছিলাম! মুহূর্তে আমার ভাবনা জগৎ যেনো চেঞ্জ হয়ে গেলো। আরেহ, আমি তো একা নই। আমার পরিচিত একজন তো আছে! ওহ, বলতে ভুলে গেছি, আমরা একসাথে একই ব্যাচে শুভেচ্ছার মেডিকেল ভর্তি কোচিং এ পড়তাম। যদিও কোচিংএ ওর সাথে আমার কখনো কথা হয়নি। অবশ্য ক্যাম্পাসেও যে খুব কথা হতো তা না, দেখা হলো ঝকঝকে একটা হাসি দিত। ব্যাস। এতেই মনে হতো সুহৃদ একজন।
এই একটুখানি পরিচিত মুখ সেদিন আমাকে এই বোধটুকু দিয়েছে, যে আমি একা নই। ওই সময় এটা আমার জন্য এটা দরকার ছিলো। বাড়ির কথা, শেষ বিকালের আলোয় প্রিয় পোষা ছাগলটির ঘরে ফেরার সঙ্গী না হওয়া এমনকি দুটো হাঁসকে তই তই শব্দে দানা খাওয়াতে না পারার দুঃখে যখন তখন কান্না আসত। মেঝো বোনের জমজ বেবি ছিলো, স্বর্ণা শিহাব। বিয়ের তেরো বছর পর আপার সন্তান, এক সাথে দুজন, তাও আবার একজন ছেলে, একজন মেয়ে! কোলে রাখি না মাথায় রাখি অবস্থা। এই দুইটার জন্যও চিৎকার করে কান্না আসে। এমনি যখন মনের অবস্থা তখন হোসাইনের উপস্থিতি আমাকে একটু স্বস্তি দিয়েছিলো, স্থিরতা দিয়েছিলো। সেই হুসাইন এখন বিছানাবন্দি। জটিল এক লিভারের অসুখ তাকে আমাদের কাছ থেকে ছিঁনিয়ে নিতে চাচ্ছে। আমরা সবাই চেষ্টা করলে কি আমাদের হুসাইনকে ফিরিয়ে আনতে পারবো না?
আমি যেহেতু #রোগী_কথন লিখি, হেপাটাইটিস সম্বন্ধে অনেক কিছু লেখার আছে। অনেক দরকারী। এখানে সামান্য একটু আলোকপাত করি। হোসাইনের লিভার হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত। বি ভাইরাস সাধারণত নব্বই ভাগ ক্ষেত্রে সেরে যায়। শতকরা দশভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতা তৈরী করে। তার মধ্যে সিরোসিস অন্যতম। সিরোসিস হলে লিভার নষ্ট হয়ে যায়। লিভার ছাড়া কি বাঁচা যায়? তে বাঁচতে হলে ড্যামেজ লিভার বদলে ফেলতে হয়। যত সহজে বল্লাম বদলে ফেলা কি এত সহজ? না, সহজ না। আরেকজন মানুষের কাছ থেকে তার লিভারের অংশ কিংবা পুরোটা নিতে হয়, লাখ লাখ টাকা লাগে। কোথায় পাবে সেই জন, কোথায় পাবে টাকা? কে করবে এই বিশাল কর্ম যজ্ঞ? কোথায় সে সুজন? না, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বিশ্বাস হারানোরও কিছু নেই। আমি পজিটিভ মানুষ ভাই। আমার অগাধ বিশ্বাস মানুষে। মানুষ ই পারে এই অসাধ্য সাধন করতে।
এখানেই মানুষ নামের বিশেষত্ব। হোসাইন তোমার ভয় নাই। রাত যত গভীর হোকনা কেনো, মনেরেখো ভোর ততই নিকটে। জাস্ট সাহস রাখো, তোমার হয়ে যুদ্ধটা আমরা করব এবং আমরা করব জয় ।
_____________________________
ডা. ছাবিকুন নাহার । সুলেখক। প্রাক্তন শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ। বর্তমানে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
আপনার মতামত দিন: