Ameen Qudir
Published:2018-09-29 22:35:51 BdST
শেরে বাংলা মেডিকেলের সোনালী স্মৃতি :হারানো দিনকে যদি ফিরে আমি পাই
ডা. মাকসুদা খানম অনু
__________________________
পর্ব--১
আমি সারা ক্যাম্পাস ঘুরবো---
আমার প্রিয়জনদের সাথে
ফার্মাকোলজির বাগানের কাঠগোলাপ, দোলনচাঁপা আর লিলি ফুলকে খুঁজবো।
হোষ্টেলের সামনের হলুদ ফুলে ছেয়ে যাওয়া
রাঁধাচূড়া গাছটা কেমন আছে?
হাসপাতালের সামনের হালকা বেগুনী
জারুল ফুলগুলো কি এখনও দোল খায়
একটু একটু বাতাসে?
কীর্তনখোলার হুহু বাতাসে
পাঁচতলার শিশু ওয়ার্ড উড়ে
যায় কি এখোনো?
পর্ব-২
হারানো দিনকে আমি যদিওবা ফিরে পাই কেউ আমার
জন্য অডিটোরিয়ামের দেয়ালে দেয়ালে লিখে রাখবে না
"নতুন মানেই বর্ষাভেজা প্রথম কদমফুল। "
আমরা যেবার শেবাচিমে ভর্তি হয়েছিলাম সেবার কলেজের দেয়ালে দেয়ালে শুধু কদমফুল আর কদমফুলের ছবি।
নতুনদেরকে বড় ভাইবোনেরা এত সুন্দর করে বরণ করেছিল যে আমি অভিভূত হয়েছিলাম।এতো বছর পরেও আমি ঠিক মনে করতে পারছি।কি একটা ভাললাগায় ছেয়ে যায় আমার মন।ধন্যবাদ সেই ভাইবোনদেরকে যাঁরা আমাদেরকে এমনকরে বরণ করেছিলেন।
পর্ব-৩
আগামী সাত তারিখ বরিশাল যাব ইনশাল্লাহ । ভাবতেই আমার ভাল লাগছে।আমি সারা ক্যাম্পাসে ঘুরবো,হাসপাতালটি সব ঘুরবো,ডিশেকশান হলে যাব। আমির আলি ভাইকে খুঁজবো। যদিও আমির আলি ভাই এখন আর নেই ।তবুও তাঁকে আমি খুঁজবো।বলবো আমির আলি ভাই -এই স্লাইডটা কি বলেন তো। উনি বলবেন চিম্পল কলামনার ইপিতিলিয়াম। আমি আমির আলি ভাইয়ের এই কথা শোনার জন্য ওনাকে বার বার জিজ্ঞেস করতাম আর হেসে মরে যেতাম ।
আর ক্যাপ্টেন স্যার তালা দিয়ে রাখতেন ।প্র্থম প্রথম মনে হতো আমার অসহ্য তালাটা ভেঙেই ফেলবো।আমি আর মনু মাঝে মাঝে পালাতাম। বই ফেলে দিতাম ছেলেদের হোষ্টেলের যে গেট আছে সেখান দিয়ে ।তারপর ডোম শিবু বসন্তকে বলতাম গেট খুলে দাও ।
মনু আবার মাস্তানিও করতো। শিবু এসব কিছু ই ভয়
পেত না ।বলতো যাও পড় গিয়া।কিন্তু শিবুর ছেলে বসন্তের মনে হয় আমাদের প্রতি দয়া হতো। সে আমাদেরকে খুলে দিত আর আমরা দে ছুট দে ছুট ।আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে ।।মনু আমি স্বপন কোনও কোনও দিন চলে যেতাম কীর্তনখোলার পারে ।স্বপনের বিখ্যাত গান গাইত অভিমানী তুমি কোথায়?দুপুরের ঝা ঝা রোদ্দুরেওয়াপদার গেটের ভিতর গোডাউনের সুনশান নীরবতা ভেঙে যেত আমাদের হাসির তোড়ে।
পর্ব-৪
আমাদের সবার একটা ভাই ছিল ।তার নাম ছিল খোকা ।মনে হয়েছিল কদিন ধরেই খোকার কথা লিখবোকিন্তু
সময় করতে পারিনি ।এই না পথ ধরিয়া আমি কত না গেছি চলিয়া ।চলবে আরও কত জন নিরন্তর ।খোকা আমাদের সবাই কে ছেড়ে জ্যোৎস্নার ফুল হয়ে আকাশে ফুটে রয়েছে ।খুব শান্ত স্বভাবের খোকার এই শান্ত আর
নিরব স্বভাবের জন্য আমি খুব পছন্দ করতাম ।আমাদের সবাই কে ছেড়ে, রওশন কে ছেড়ে নিরবেই এই পথ ধরে কোথায় চলে গিয়েছে! !কেউ খুঁজে আর পাবে না তোমায় সারা টা পৃথিবী ঘুরে ।আল্লাহ্ তোমাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন ।
পর্ব--৫
পলাশ অনেক হেঁটেছে এই পথ ধরে। আমরা সবাই হেঁটেছি। এই না পথ ধরিয়া আমি কতনা গেছি চলিয়া।
সন্ধ্যার আলোআঁধারিতে যখন wardএ যেতাম তখন একটা গানের সুর ভেসে আসতো -হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস।। গানটা শুনলে আমার মনটা
বিষণ্ণ হয়ে উঠতো। একদিন সুর ধরে গেলাম
কে গায় গানটা দেখতে । গিয়ে দেখি তেরোতম
ব্যাচের পলাশ । জানতে চাইলাম -পলাশ রোজ
এই গানটা কেন গাও?আপা আমার এই গানটা
খুব ভাললাগে। কিছুদিন পর দক্ষিণ আফ্রিকা
গিয়ে পলাশ সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল ।পলাশের এই ছবি টা আনোয়ার পোস্ট দিয়েছে ।পলাশের কথা আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ।সেই অচিনপুরে পলাশ তুমি শান্তিতে ঘুমাও।।আমার মনে পড়ে আমাদের বারোতম ব্যাচের আশফাক, ইউনুস, কবি মনির,মিজান, বাপির কথা ।বাপি আমাকে কেন যেন ক্ষেপাতো আর আমিও ক্ষেপতাম। আশফাক খুব ই আপন মনে থাকতো। মিজানের সাথে আমার আর মনুর দোতলার গ্যালারির সামনে বসে ভীষণ ঝগড়া হয়ে গেল।কারণ টা আর মনে নেই ।।শুধু মনে হয় মিজান আর কোথাও নেই ।কোনখানে তোমরা তাকে খুঁজে পাবে না ।তোমরা কবি মনিরকে যদি সারা পৃথিবী জুড়ে ও খুঁজে পাবেনা। শুধু বন্ধুদের জন্য তার সেই সুন্দর ব্যবহার রেখে গিয়েছে ।চলে গিয়েছে কোথায়! !কোন্ সুদূরে! নিরীহ ছেলে সাধন। বড়ই নিরীহ বন্ধুটি ওহারিয়ে গিয়েছে।এত বড় ছেলেরা আবার হারায় নাকি! !
হারায় মায়ার দেশে ,তারার দেশে তোমরা ভাল থেকো বন্ধুরা আমার ।।গণেশের কথা তো বলা হোল না ।গণেশ আর সাধন একসাথে থাকতো। গণেশ খুব ই সহজ- সরল একটা ছেলে ছিল ।আমাদের সি ব্যাচে ছিল ।মনু যেন গণেশকে কি বলতো আর গণেশ একটু রাগ হয়ে কি কি যেন বলতো!শুধু ঐগুলো শোনার জন্য মনু আর আমি গণেশকে ক্ষেপাতাম।
পর্ব --৬
মোমবাতি আমরা সবাই চিনি ।বিদ্যুত না থাকলে
হোষ্টেলে বসে মোমবাতির আলোয় অনেক পড়েছি । 3r d year,4thyear &5th year একটা combined লেকচার ক্লাশ হতো। সকাল সাতটায় ই বেশির ভাগ ক্লাশগুলো হতো।কোনও কোনও স্যার আবার পড়াও ধরতেন।
একদিনএক সিনিয়র ভাইকে স্যার পড়া ধরলেন । উনি
বললেন উনি পড়া শিখেননি। কেন শিখনি?স্যার
জানতে চাইলেন । ঐ ভাইটি বললেন যে হারিকেনের আলোকে আমার কাছে বিষণ্ণ মনে হয় আর মোমবাতির আলোকে আমার কাছে এতটাই রোমান্টিক মনে হয় যে তাতে আমার পড়া হয় না। স্যার একটুও রাগ করেননি এটা আমার খুব মনে আছে।স্যার বলেছিলেন যেআলোতে আপনার মাঝামাঝি অনুভূতি হবে সেই আলোয় পড়া তৈরি করে নিবেন।
হাসপাতালের পাঁচতলায় শিশু ওয়ার্ড করছি ।
একটানা ওয়ার্ড করার ফাঁকে মাঝে মাঝে একটু বেলকুনিতে দাঁড়াতাম। হু হুকরে বাতাস আসতো সামনের কীর্তনখোলা হতে। আমি দাঁড়িয়ে দেখতাম সামনের ছোট ছোট রাস্তার পাশের ঝুপড়ি দোকানগুলোতে শ্রমিক কিংবা রিকশাওয়ালা মতো লোকদের ভিড়াভিড়ি।গুড় দিয়ে মোটা মোটা আটার রুটিগুলো কি মনের সুখে খাচ্ছে আর গল্প করছে
নিজেদের মধ্যে । সামনে বিশাল বিশাল কৃষ্ণচূড়া
গাছ দাঁড়িয়ে থাকতো আকাশে রং ছড়িয়ে ।মিষ্টি
মিষ্টি রং ছড়াতো সামনের জারুল ফুলগুলো ।দেখা যেত একটু দূরের কীর্তিনখোলা নদী।
একদিন সন্ধ্যায় ওয়ার্ডে গিয়েছি। ওয়ার্ডে ঢুকতে
গিয়ে দেখি সামনে একটা খ্রিস্টান গোরস্থান সেখানে শুধু প্রতিটা কবরে চারপাশে মাঝখানে মোমবাতি আর মোমবাতি দিয়ে সাজানো ।আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম ।আলো আর আলো দূর হতে মোমবাতির আলো কেমন মোহময় মনে হচ্ছিল । সব কবরে আলো আছে একটি কবরে কোনও মোমবাতি নেই, নেই কোনও আলো!সে আজ কত বছর আগের কথা!
কিন্তু এখনও মনে করলে কষ্ট পাই ঐ কবরটায় একটুও আলো ছিল না।ভুল করে হলেও একটু
আলো কেউ দিলনা কেন?
পর্ব--৭
সারোয়ার ভাই, বিপ্লবদা, মিনার ভাই।
-------------------------------------------------------+
মেডিকাল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর পড়াশোনা কিছুই বুঝিনা।তার ওপর রোজই আইটেম পরীক্ষা।জীবন দূর্বিষহ।শিরিন, আমি,মনু তিনজন একসাথে এসেছি পটুয়াখালী হতে।শিরিন খুব মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করতো।কঠিন মনে হতো বলে আমি মনু রোজই পটুয়াখালী চলে যেতে চাাইতাম।সারোয়ার ভাই,বিপ্লবদা আর মিনার ভাইয়ের যে কি পরিমাণ কাউসিলিং আমাদের দুজনকে করতে হয়েেছে!ছোটবোন দুটো তা চিরকাল মনে রাখবে।আমি আর মনু কত সময় অন্যায় আবদারও করতাম।ফুল ছেঁড়া আমার একটা খারাপ অভ্যাসই ছিল বলা যায়।একদিন ওনাদের কাছে বায়না ধরলাম আমার অনেক অনেক ডালিয়া ফুল চাই।বলেছিলাম একবস্তা ডালিয়া ফুল চাই।
আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম।একদিন লাইব্রেরিতে পড়ছি আমি মনু।সারোয়ার ভাই আর মিনার ভাই বস্তার মতো একটা কিছু নিয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকলেন।বললেন এই নাও।আমি বললাম কি এগুলো?সারোয়ার ভাই বললেন খুলে দেখ।বস্তাটা খুলে আমি শব্দ করে চিৎকার করে উঠেছিলাম যে লাইব্রেরির নীরবতা ভংগ হয়েছিল।সবাই একটু বিরক্তও হয়েছিল।কে একজন একদিন মিনার ভাইকে বলেছিল তুই অনু মনুর এতো আবদার সহ্য করিস কেন?মিনার ভাই বলেছিলেন কি করব ছোট বোন যে!
ঠিকই বলেছেন। ছোটবোনদের আবদার এখনও রক্ষা করেন।এখনও বরিশালে কিছু দরকার হলেই ফোন করি সারোয়ার ভাই।
মিনার ভাই আমার ছোট ভাইয়ের অসুখের সময় যা করেছেন আমি তা চিরকাল মনে রাখব।
অনেক বড় ভাইদের কথাই সুযোগ পেলে লিখব।
নাজির ভাই,ছিদ্দিকী ভাই,হারুন ভাই,শারফুদ্দীন ভাইসহ আরও অনেকের কথা।সব বড় ভাইদরকে সালাম এবং আমার বাগানের ডালিয়া ফুল।
পর্ব --৮
আমার বন্ধু মনু শেবাচিমএর গোলচত্বরে
আমি, শিরিন, মনু,ফ্লোরা, তাপসীর একটা ছবি দিয়েছে। ছবিটা দেখে আমি ফিরে গিয়েছি আমার হারানো দিনগুলোতে । যারা লাইব্রেরিতে পড়তেন কিংবা পড়তেন না সকলেই একটু গল্পের তরে গোল চত্বরে বসতেন ।তখন কারও আইটেম পরীক্ষার কথা মনে থাকতো না ।মনে থাকতো না ward এ যাওয়ার কথা ।
জোনাকির রংএ ঝিলমিল সব পাখি ঘরে ফেরে ।
আগামীকাল বসবে বলে।
একটু একটু বাতাসে গোল চত্বরের ভিতরের ছোট ছোট প্রেম কাঁটা গাছগুলো দুলতো।লাল টকটকে ডালিয়া আর হালকা বেগুনী রঙের কসমসগুলো কি সুন্দর হয়ে ফুটে থাকতো!!
শীতকালে সাতটার ক্লাশে যখন যেতাম তখন গোল চত্বরের কাছে এসে মনটা খুশিতে ভরে উঠতো ।দৌড় দিয়ে ভিতরে ঢুকে শিশিরে পা ডুবিয়ে দিতাম ।শিরিন ডাকতো অনু ক্লাশে দেরি হয়ে যাবে আমি শুনতাম না।
এটাই আমাদের প্রিয় গোলচত্বর। এখন গাছগাছালিতে ভরে গিয়েছে ।বিষ্টির পানিতে ভিজছে শেবাচিম,ভিজছে আমাদের গোলচত্বর ।
________________________________
ডা. মাকসুদা খানম অনু। কবি। সুলেখক। প্রাক্তন : শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ।
আপনার মতামত দিন: