SAHA ANTAR

Published:
2021-10-10 14:49:22 BdST

টাটা এয়ার থেকে এয়ার ইন্ডিয়া : ৬৮ বছর পর নিজ সহোদরকে ১৮ হাজার কোটি টাকায় কিনে নিলো টাটা সন্স


 

ডা. রাজ কিরণ বসু
____________________

৬৮ বছর পর টাটার এয়ার লাইন টাটার হাতে ফিরে এলো। প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকায় একসময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব হয়ে যাওয়া নিজেদের বিমান সংস্থাকে কিনে নিতে হয়েছে তাদের।

এয়ার ইন্ডিয়ার জন্ম টাটা এয়ারলাইন্স নামে ১৯৩২ সালে অখন্ড ভারতবর্ষে । তাদের হাতেই নাম বদলে এয়ার ইন্ডিয়া।
প্রথম উড়ানে চিঠির ডাক নিয়ে  বোম্বে, মাদ্রাজ  প্রেসিডেন্সি - করাচি ভ্রমণ করে ইতিহাস রচনা করেন টাটাধিপতি।

তারপর অংশীদার হয়ে যোগ দেয় স্বাধীন ভারত বর্ষের সরকার। তারপর পুরোটা গিলে নেয় কেন্দ্র সরকার রাষ্ট্রায়ত্বকরণে।
তারপর সরকারি পরিচালনায় দীর্ঘ পথ পাড়ি। টাটা অধিপতিকে চেয়ারম্যান হিসেবে রাখা হয়েছিল। মোরারজী দেশাই প্রধানমন্ত্রী হয়ে তুঘলকি করে তা কেড়ে নেন।
টাটাবিহীন উড়তে থাকে এয়ার ইন্ডিয়া।
গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেনার ভারে জর্জরিত এয়ার ইন্ডিয়া। উপায় হিসাবে তাই বিলগ্নিকরণেই আস্থা ছিল কেন্দ্রের। কেন্দ্রীয় সরকার গত সপ্তাহের শুরুতে এয়ার ইন্ডিয়ার দরপত্র মূল্যায়ন শুরু করে।

গোড়ার কথা 

অবিভক্ত ভারতে, ১৯৩২ সালে, ‘টাটা এয়ারলাইনস’ চালু করেছিলেন শিল্পপতি জে আর ডি টাটা। সেই বছরের ১৭ অক্টোবর করাচি থেকে চিঠিপত্র নিয়ে বোম্বে হয়ে মাদ্রাজ উড়ে গিয়েছিলেন জে আর ডি টাটা স্বয়ং। সেই ঘটনার ছয় বছরের মধ্যেই আকাশে ওড়ে টাটা এয়ারলাইনসের প্রথম যাত্রীবাহী বিমান। তার কয়েক বছরের মধ্যেই নামবদল। টাটা এয়ারলাইনস হয়ে যায় ‘এয়ার ইন্ডিয়া’। মালিকানা পুরোটাই থাকে টাটাদের হাতে।

সে ছিল স্বাধীনতা-পূর্বের ভারত। ব্রিটিশমুক্ত স্বাধীন ভারত ১৯৪৮ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার ৪৯ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। সেই বছরেই প্রথম আন্তর্জাতিক উড়াল। বোম্বে টু লন্ডন। এর পাঁচ বছর পর, ১৯৫৩ সালে, জওহরলাল নেহরুর সরকার এয়ার ইন্ডিয়া রাষ্ট্রীয়করণের সিদ্ধান্ত নেন নাটকীয়ভাবে। তখন ভারতের যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন জগজীবন রাম। জে আর ডি টাটাকে তিনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন। রুশি মোদিকে সঙ্গে নিয়ে জগজীবন রামের সঙ্গে দেখা করতে গেলে টাটার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। তাঁকে জানানো হয়েছিল, সরকার এয়ার ইন্ডিয়া অধিগ্রহণ করে নিচ্ছে।

জগজীবন রামকে ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত জে আর ডি টাটা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি কি মনে করেন যেভাবে আপনারা সরকারি মন্ত্রণালয় চালান, সেইভাবে বিমান পরিবহন চালাতে পারবেন? পারবেন না। নিজেই সেটা দেখতে পারবেন।’ জগজীবন রাম ঠান্ডাভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এটা সরকারি সিদ্ধান্ত। তবে সরকারি সংস্থা হলেও এয়ার ইন্ডিয়া চালাতে আমরা আপনার সাহায্য নেব।’ সেই দিনের সেই বৈঠক অসমাপ্ত রেখে টাটা ফিরে গিয়েছিলেন। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে এক সাক্ষাৎকারে সরকারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে টাটা বলেছিলেন, ‘কোনো কিছুরই রাষ্ট্রীয়করণ দেশের জন্য মঙ্গলের হতে পারে না। কারণ, সংস্থা চালাবেন আমলারা। যেকোনো সিদ্ধান্তের জন্য তাঁরা তাকিয়ে থাকবেন রাজনৈতিক প্রভুর দিকে। ফলে ঠিক সময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত কিছুতেই নেওয়া যাবে না।’ সাক্ষাৎকারের এক প্রতিলিপি নেহরুকেও পাঠিয়েছিলেন টাটা এই আশায় যে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পিছিয়ে আসবেন। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা।

 

করপোরেট দুনিয়ায় এক বিস্ময়কর প্রত্যাবর্তন
শেষমেশ আরও একটা চেষ্টা টাটা করেছিলেন। নেহরুকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উড়াল বিচ্ছিন্ন করে দুটি সংস্থা তৈরি করা হোক। দেশীয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত করা হোক, আন্তর্জাতিক সংস্থা থাকুক তাঁর হাতে, যাতে দেশের সম্মানটুকু অন্তত বজায় রাখা যায়। নেহরু সেই যুক্তিও মানেননি। তবে টাটাকে তিনি চেয়ারম্যান হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। জে আর ডি টাটা তা মেনেও নিয়েছিলেন। সেই যোগসূত্রও অবিশ্বাস্যভাবে ছিন্ন হয় ১৯৭৮ সালে। ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেসকে পরাস্ত করে আগের বছর প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন মোরারজি দেশাই। নেহরুর মতো শালীনতার ধার তিনি ধারেননি। জগজীবন রাম তাঁর দপ্তরে টাটাকে ডেকে পাঠিয়ে সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন, মোরারজি দেশাই চেয়ারম্যান পদ থেকে টাটাকে বরখাস্ত করার কথা জানিয়েছিলেন চিঠি লিখে। সেই পদে বসানো হয়েছিল অবসরপ্রাপ্ত এয়ার চিফ মার্শাল প্রতাপ চন্দ্র লালকে।

এয়ার ইন্ডিয়ার অবক্ষয় শুরু আশির দশক থেকে। কেন্দ্রীয় সরকার যত দুর্বল হয়েছে, ততই বেড়ে গেছে এয়ার ইন্ডিয়ার লোকসানের বহর। একটা সময় এমন অবস্থা হয়েছিল যে আমলারা কেউ দায়িত্বই নিতে চাইছিলেন না। উদার অর্থনীতির সরণি ধরে বেসরকারি বিমান পরিবহনব্যবস্থা চালু হওয়ার পর এয়ার ইন্ডিয়ার হাল আরও খারাপ হয়ে যায়। ২০০৭ সালে সরকার এয়ার ইন্ডিয়া ও ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসকে মিলিয়ে একটি সংস্থা করে, যাতে লোকসান কমে। অসামরিক বিমান পরিবহনমন্ত্রী অজিত সিং ৩০ হাজার কোটি রুপির জোগানও দেন রুগ্‌ণতা সারাতে। কিন্তু লাভ তো দূরের কথা, ২০১৭ সালে দেনার বহর ৫২ হাজার কোটি রুপি পেরিয়ে যায়, যা কিনা দেশের ১০০ দিনের কাজের মোট বাজেটের চেয়েও বেশি। আজ, ২০২১ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত এয়ার ইন্ডিয়ার মোট ঋণ প্রায় ৬২ হাজার কোটি রুপি। দৈনন্দিন লোকসানের পরিমাণ ২০ কোটি। বার্ষিক ৭ হাজার ৩০০ কোটির ধাক্কা।

এয়ার ইন্ডিয়ার বিলগ্নীকরণের চেষ্টা চলছিল ২০ বছর ধরে। ২০০১ সালে সরকার ৪০ শতাংশ শেয়ার বেচতে চেয়েছিল। পারেনি। ২০১৮ সালে ৭৬ শতাংশ বিলগ্নীকরণের চেষ্টাও বাতিল হয় ক্রেতা না মেলায়। সরকারের সামান্য অংশীদারত্বও যে বিক্রির পথে প্রধান বাধা, অবশেষে সেই উপলব্ধিই কাজ হাসিল করে। টাটারা সবার চেয়ে বেশি দরপত্র দিয়ে হারানো নিধি ঘরে তুলেছে।

সোনালী এক চিঠি
___________________
‘আপনি শুধুমাত্র চেয়ারম্যান ছিলেন না, আপনি ছিলেন (এয়ার ইন্ডিয়ার) প্রতিষ্ঠাতা এবং লালন-পালনকারী।’

'আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে আপনি আর এয়ার ইন্ডিয়ার সঙ্গে যুক্ত নেই।' ১৯৭৮ সালে হাতে লেখা চিঠিতে জাহাঙ্গির রতনজি দাদাভাই টাটাকে (জেআরডি টাটা) এমনই লিখেছিলেন প্রাক্তন ইন্দিরা গান্ধী। যিনি সেই সময় প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে ছিলেন না। ৪১ বছর পর ভাইরাল হয়েছে সেই চিঠি।


এমনিতে ঋণগ্রস্ত জাতীয় উড়ান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়ার ক্ষমতা নিজেদের হাতে ফিরে পেতে চলেছে টাটা সনস। তারপরই কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ টুইটারে ইন্দিরার লেখা একটি চিঠি সামনে এনেছেন। ১৯৭৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গির রতনজি দাদাভাই টাটাকে এয়ার ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দিতে বলা হয়েছিল। তারপরেই সেই চিঠি লিখেছিলেন ভারতের একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী।

 


কী ছিল চিঠিতে?

ইন্দিরা লিখেছিলেন, 'আপনি (টাটা) শুধুমাত্র চেয়ারম্যান ছিলেন না, আপনি ছিলেন (এয়ার ইন্ডিয়ার) প্রতিষ্ঠাতা এবং লালন-পালনকারী। যিনি ব্যক্তিগত স্তরে গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। সাজসজ্জা থেকে এয়ার হোস্টেসদের শাড়ি - ক্ষুদ্রতম বিষয়ে আপনি নিখুঁতভাবে মনোযোগ দেওয়ার ফলে এয়ার ইন্ডিয়া আন্তর্জাতিক স্তরে উঠেছিল। এমনকী সেই তালিকার শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিল। '

১৯৩২ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাহাঙ্গির রতনজি দাদাভাই টাটা। সেই সময় উড়ান সংস্থার নাম ছিল টাটা এয়ারলাইন্স। ১৯৪৬ সালে সংস্থার নাম পালটে রাখেন এয়ার ইন্ডিয়া। তবে স্বাধীনতার পর সরকারের সঙ্গে টাটার সম্পর্কের সমীকরণ পালটে গিয়েছিল। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর এয়ার ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল চালুর পরামর্শ দিয়েছিল টাটা গ্রুপ। প্রস্তাব অনুযায়ী, সরকারের হাতে থাকত ৪৯ শতাংশ মালিকানা। অতিরিক্ত দু'শতাংশ শেয়ারও কেনার সুযোগ ছিল। টাটার দখলে থাকত ২৫ শতাংশ শেয়ার। বাকি শেয়ার থাকত অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার হাতে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সেই প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছিল সরকার। পাঁচ বছর পর এয়ার ইন্ডিয়ার জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। জাতীয়করণ সত্ত্বেও ২৫ বছর এয়ার ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান ছিলেন জাহাঙ্গির রতনজি দাদাভাই টাটা। ১৯৭৮ সালে তাঁকে এয়ার ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বোর্ড থেকে সরিয়ে দিয়েছিল মোরারজি দেশাইয়ের সরকার।

 

তারপরই ইন্দিরা চিঠি লিখে বলেছিলেন, ‘আপনি এবং আপনার উড়ান সংস্থাকে নিয়ে গর্বিত আমরা। কেউ আপনার থেকে এই সন্তুষ্টি বা সরকারের কৃতজ্ঞতা ছিনিয়ে নিতে পারবে না।’ দু'জনের মধ্যে ‘ভুল বোঝাবুঝির’ বিষয়টির উল্লেখ করে চিঠিতে ইন্দিরা দাবি করেছিলেন, তাঁকে প্রবল ‘চাপের’ মধ্যে কাজ করতে হত। সেইসঙ্গে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ‘অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের মধ্যে রেষারেষি’ ছিল। যে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ১৯৮০ সালের এপ্রিলে জাহাঙ্গির রতনজি দাদাভাই টাটাকে দুটি সংস্থার বোর্ডে ফিরিয়ে এনেছিল। কিন্তু ফিরে আসেননি তিনি।

তবে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন টাটা। বলেছিলেন, ‘উড়ান সংস্থা গড়ে তোলার জন্য আমার ভূমিকার বিষয়ে আপনি যা উল্লেখ করেছেন, তাতে আমি অভিভূত।’ সহকর্মী, কর্মী এবং সরকারকেও ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন জাহাঙ্গির রতনজি দাদাভাই টাটা।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়