Ameen Qudir
Published:2017-02-09 17:00:47 BdST
পুরুষটার দোষ নাই? মেয়েটাই কেবল নোংরা?
ডা. শিরিন সাবিহা তন্বী
_____________________________
ঘরে ঢুকতেই ছেলে মেয়ে দুটো দৌড়ে এল।মেঝেতে পাটি পেতে বসে হাতের বাটিটার ঢাকনা খুলল ময়না।পোলাওর মিষ্টি গন্ধে ঘর খানা যেন মৌ মৌ করে উঠল।অন্ধ বাপ বলে উঠল ময়না, মা রে!পোলাওর সুবাস পাই যে!
কাজল আর কলি লোভাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে রইল বাটির দিকে।বাটির মধ্যে পোলাও,দু টুকরো বেগুন ভাজা,বুকের এক ফালি মাংস আর দুটো ডিমের কোর্মা।
লাল চুল নানী বড্ড ভালা।তার ছেলে মরেছে গত বছর লিভার অসুখ হয়ে।তার পর থেকে পালা পর্বনে মরা ছেলেকে মনে করে ওদের ঘরে খাবার পাঠায়।রাস্তার ওধারেই দোতলা বাড়ী তাদের।
ডেকেছিল আজ।অসুস্থ শরীরে তাও ময়না উঠে গেছিল।ছেলে মেয়ে আর বাপের খুশি দেখে মনটা ভরে গেল।ভাগ করে তিনজনকেই দিল।
তৃপ্তি করে খাচ্ছে।হঠাৎ মেয়েটা উঠে এল।পাত থেকে এক লোকমা পোলাও মায়ের মুখে তুলে বলল,তুই খাবি না মা!
কান্না আটকাতে পারল না ময়না।কলিকে বুকে জড়িয়ে হাউ মাউ করে কাঁদল।যত না মেয়ের কথায় তার থেকেও বেশী খুন করা মেয়েকে মনে করে।সাড়ে তিন মাস হয়েছিল।রুনা সিস্টার বলেছে মেয়ে ছিল ঐটা।তিন দিন আগেই জোর করেই বাচ্চাটাকে এবরশন করাইছে ময়না।এইটারে তো খুন ই বলে তাই না?
চারদিন পর কাজের বাসায় গেল ময়না।শরীর খুব ই খারাপ ছিল।জ্বর উঠে গেছিল।পেটে কি অসহ্য যন্ত্রনা।
কাজলের বাপ ভাত দেয় না।কাপড় দেয় না।কাম কাজ যা করে,তা দিয়ে বিড়ি খায়,গাজা খায়।বাঁধা একজন মেয়ে মানুষ ও আছে।পানির মত টাকা ঢালে তার পিছনে।সংসারে এক টাকা দেয় না।অনেক ভাবছে।শেষে তিন দিন আগে রাতে আইসা যখন মারল ওর স্বামী,তখন অনেক টা জিদে আর দুশ্চিন্তায় পড়েই বাচ্চাটারে ফেলে দেবার সিদ্ধান্ত নিছিল ময়না।
দরজা খুলেই এক চোট বকে নিল আপা।ময়না গায়ে না মেখে কাজ করতে শুরু করল।
আপার এক বোন আসছে।দুজন গল্প করছিল।এই বাসার সাহেব ব্যাংকে চাকরী করে।এদের পাশের ফ্লাটে একজন পুলিশ।এই দুই বাসার কাজ দিয়েই সংসার চালায় ময়না।অন্ধ বাপ,দুইটা বাচ্চা!তাই এদের বকা ঝকা গায়ে মাখে না।
রান্না বসাতে বসাতে শুনল আপা তার আত্মীয়কে পেপার পড়ে বলছে,এই মেয়েগুলোকে বেঁধে পিটাইতে ইচ্ছা করে।ইস!নিষ্পাপ বাচ্চাটা।স্বামী ই হোক বা প্রেমিক ই হোক এমনকি জোর করেও যদি বাচ্চা আসে,পুরুষ ছেড়ে যেতেই পারে তাই বলে মেয়েটা মা হয়ে কি করে বাচ্চাকে ফেলে দেয়।ছিঃ!এইসব নোংরা মেয়েদের এমন শাস্তি হওয়া উচিত না !!!
ময়নার যেন হাত পা অবশ হয়ে গেল।মাত্র বলি দেয়া স্নেহের কান্নার দাগ এখনো শুকায়নি।এ কি বলছে আপা?
সে কি জানে বাপের সাহায্য ছাড়া দুইটা বাচ্চাকে বড় করতে ময়না একা কত বড় একটা যুদ্ধ প্রতিদিন করে যাচ্ছে!কত মানুষের কত বাধ্যবাধকতা থাকে।পুরুষটার দোষ নাই?মেয়েটা নোংরা?
ডালের বাটিটা টেবিলে রাখতে না রাখতেই আপার চিৎকার শুনে দৌড়ে ছুটে গেল ময়না।ঘটনা শুনে ও স্তব্দ্ধ।
এই বাসার সাহেবের অফিস কাছেই।দুপুরে খেতে আসে!আইজ যেন কি দিন!ভালবাসা না কি যেন!স্যার আপার জন্য উপহার আনছে।ঐ উপহার তার পছন্দ হয় নাই।সেই রাগে আপা চিল্লাইতেছিল আর তার জমজ ছেলের দুটিকেই ঠাস ঠাস করে কাঠের স্কেল দিয়ে মারতেছিল।
ময়নার বুক থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেল।বাচ্চা দুটোকে মায়ের রোষ থেকে কেড়ে নিয়ে খেতে বসাল।
খানিক পরে বলল,আপা!একটা কথা বলি?পুরুষ মানুষ ছেড়ে গেলেও যে মহিলা বাচ্চার দায়িত্ব নেয় না,আপনে কইলেন সে নোংরা মানুষ!!আর পুরুষ মানুষ ভালবাইসা উপহার দিলে যদি উপহার পছন্দ না হয়,তাইলে যে মহিলা নিজের বাচ্চাদের এমন নির্দয় ভাবে মারে,সে কি মানুষ???
আপা বিস্ফোরিত চোখে ময়নার দিকে চেয়ে রইল।
ময়নাকে দুপুরের খাবার দিয়েছে।বাটিটা শাড়ীর আঁচলে লুকাতে লুকাতে বাসার দিকে হাঁটতে লাগল।এই খাবার বাবা আর দুই বাচ্চাকে খাইয়ে সে কোনদিন এক মুঠো খায়।কোনদিন খায় না।সে নোংরা মানুষ না।সে অপারগ।তার অপারগতা তার নিষ্পাপ মেয়ে টাকে পৃথিবীর আলো দেখতে দিল না।এই দুঃখ সে কোথায় রাখে?
দু চোখ জলে ভরে।তবু চোখের কোলে বেঁচে থাকার স্বপ্ন বাসা বাঁধে!!!
____________________________
ডা. শিরিন সাবিহা তন্বী । দেশের জনপ্রিয় কলামিস্ট। মেডিকেল অফিসার, শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
আপনার মতামত দিন: