Ameen Qudir

Published:
2020-01-12 20:23:29 BdST

"আমি তারায় তারায় রটিয়ে দিবো তুমি আমার"


 

ডা.সাঈদ এনাম
সহকারী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি)
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ
______________________

[...চিকিৎসা পেশা এমনই এক পেশা, যা কখনো কখনো একজন চিকিৎসককে আত্মীয়, অনাত্মীয়, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে স্নেহমতার অমোঘ বন্ধনে বেঁধে ফেলে...]

এক.

জনসন যখন বললো, 'ডাক্তার গত বছর বড়দিনে আমরা তোমার জন্যে সবাই অপেক্ষা করেছিলাম, তুমি যাওনি। আমি সবার কাছে খুব লজ্জা পেয়েছি। এবার কিন্তু যাবে..'।

আমি সে কথায় অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে করার চেষ্টা করলাম, 'সত্যি কি গতবছর তাকে কথা দিয়েছিলাম, বড়দিন এ তাদের বাড়ি আমি যাবো?'। ঠিক মনে করতে পারলাম না।

আসলে ডাক্তারী পেশাটা ব্যতিক্রম। ব্যস্ততায় অনেকের বিয়ে, বৌভাত, জন্মদিন, পুজা বা বড়দিনে ইচ্ছে থাকা সত্যেও যাওয়া হয়না। আর কেউ দাওয়াত দিলে' তো মুখের উপর বলে দেওয়া যায় না, 'আমার চেম্বার আছে বাপু, আমি যেতে পারবো না। রোগীরা অযথা এসে অপেক্ষা করে ফিরে যাবে'।

তাই প্রায়শই এমন ইনভাইটেশনে স্মিত হেসে যাওয়া না যাওয়ার মধ্যে একটা কথা বলা হয়, এই যেমন, 'আচ্ছা যাবো সময় পেলে...', কিংবা 'দেখি সময় করতে পারিনা কিনা..'।

আমার মনে হয় আমি জনসন কে সে রকম কথা হয়ত গতবছর বলেছিলাম, 'যদি সময় পাই তাহলে যাবো'। আর জনসনও আমার সে অনিশ্চিত 'আশ্বাস' কে নিশ্চিত ভেবে আমার জন্যে অনেক কিছুর আয়োজন করে বসেছিলো।

এবার যখন সে গত বছরের কথাটি স্মরণ করিয়ে বললো, 'গত বড়দিনে আমরা অপেক্ষা করেছি, তুমি যাওনি, আমি লজ্জা পেয়েছি, এবার কিন্তু তুমি যাবে...', আমি তখন নিতান্ত 'সরি' জানিয়ে বললাম, 'ইনশাআল্লাহ এবার আমি এবার যাবই যাবো'।
আমার কথায় জনসনের চোখ চক চক করে উঠলো।

চা বাগানের ভিতর দিয়ে অনেক দূর যেতে যেতে এক নির্জন নিস্তব্ধ চৌমুহনীতে গিয়ে আমি থামলাম। সামনে আঁকাবাঁকা, উঁচুনিচু পথ। গাড়ি আর যাচ্ছেনা। ভয়ও লাগছিলো বন্য প্রানী মেছোবাঘ বা বিড়ালের। যদিও মাঝেমধ্যে দু'য়েক পথচারী আসছে যাচ্ছে তারা বেশির ভাগ চা শ্রমিক বা পাহাড়ি। তাদের হাতে ধারালো দা। চলতে ফিরতে সহজ সরল এ মানুষ গুলোর হাতে প্রায়শই ধারালো দা' থাকে স্রেফ জীবিকা বা আত্মরক্ষায় প্রয়োজনে 'দলাদলি' বা 'সিলমারো ভাই সিলমারোর' জন্যে নয়।

জনসন কে ফোন দিলাম, 'আমিতো চলে আসছি কিন্তু একটা চৌমুহনীতে এসে থেমে গেছি। এখানে কেউ নেই। নির্জন নিস্তব্ধ সব দিক, সরু রাস্তা। গাড়িও বোধহয় এগুবেনা। কি করবো জনসন?'।

জনসন বললো, 'ওহ বুঝেছি ডাক্তার তুমি কোথায়, ওখানেই থাকো। আমার ছেলেকে পাঠাচ্ছি'।

জনসন তার ছেলে জিম'কে পাঠালো। জিম'কে আমি আগে কখনো দেখিনি। জনসনের পরিবারের সকল আত্মীয় স্বজন 'ফ্যামিলি ডাক্তারের' মতো আমার চেম্বারে গত কয়েকবছর ধরে এলেও রবার্ট কে কখনো দেখিনি।

যাহোক আমি, জিম ও পাভেল আঁকাবাঁকা উঁচু নিচু টিলা পেরিয়ে জনসনদের বাসায় পৌছুলাম। যেতে যেতে বিভিন্ন গির্জায় বড়দিনের গান বাজনা, ধর্মীয় আলাপ আলোচনা কানে ভাসলো। চারিদিকে সাজসজ্জা, সকলই বড়দিন উপলক্ষে।

দুই.

জনসন ও তার স্ত্রী নানান রান্নার আয়োজন করেছে। তার স্ত্রী বললো, 'আপনাদের প্রিয় খাবারই রান্না করেছি। মাছ, ডাল, মুরগী, গরু, খাসি সব। আপনি আসবেন বলে কাল জনসন শহর থেকে বাজার করে এনেছে এসব। আর আমি জনসন ও আমাদের মেয়ে সবাই রান্না করেছি।

আমাকে ডায়েট করতে হয় তারপরও তাদের অনুরোধে সব চেখে দেখতে হলো। জনসনের স্ত্রী কে বললাম, 'তোমার রান্নাতো দারুন। মনে হলো একেবারে আমার বাসার খাবার'। সে বললো, 'কাল আমার মেয়ে ঢাকা থেকে এসেছে জামাই সহ। সে আমাকে আর জনসন কে দেখিয়ে দিয়েছে তোমাদের রান্না গুলো কেমন করে করতে হয়। ওভাবেই রেঁধেছি '।

জনসনের বড় মেয়ে লিন্ডা ঢাকার একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার। আমাকে এসে 'বাও' করলো তার বর সহ। তার বর ও ঢাকায় থাকে। অর্পন নামের তাদের দু বছরের একটা ছেলে আছে। বড়দিন উপলক্ষে বেড়াতে এসেছে সবাই।

ভূরিভোজ শেষে তাদের ড্রইং রুমে বসলাম। শেলফের কাছে দুটো গিটার। জিম'কে জিগ্যেস করলাম, 'কে বাজায়..?'।

সে বললো, সে নিজেই বাজায়। তাদের একটা ব্যান্ড দল আছে। সে লিড গিটারিস্ট।

জিম ও আমি দুজনেই গিটার হাতে নিয়ে টুং টাং সুর তুলার চেষ্টা করলাম। আমি বাজাতে পারিনা, কেবল কর্ড ধরে টানাটানি কিন্তু সে অসম্ভব সুন্দর বাজায়। বললাম, 'জেমসের আমি তারা তারায় রটিয়ে দিবো তুমি আমার...সুরটি তুলতে পারবা?

সে বললো, 'আংকেল তোমাকে শুনাবো বলে আমি রাতে এরকম কয়েকটি গান প্রেক্টিস করেছি..!'।

ডাক্তারী পেশা এমনই এক পেশা যা কখনো কখনো ডাক্তার'কে আত্মীয়, অনাত্মীয়, ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের বন্ধন ছাড়াও অনেকের সাথে 'স্নেহমতার অমোঘ বন্ধনে জড়িয়ে ফেলে....।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়