Ameen Qudir

Published:
2018-11-12 18:45:55 BdST

সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে লজ্জা করলেও কবিরাজের ভন্ডামির শিকার হতে লজ্জা নেই


 



ডা. মো. সাঈদ এনাম
_________________________


এক.

কি ব্যাপার কি হয়েছে বলুন?

'স্যার স্কুলে পরীক্ষা আসলেই মেয়েটির চঞ্চলতা বেড়ে যায়, এদিক ওদিক লুকায়, কখনো পালিয়ে যায়।'

তাই?

'জ্বী স্যার।'

কি সে পড়ে?

'ক্লাস নাইনে'

পড়াশুনায় কেমন?

'মোটামুটি, কোনমতে পাশ করে যাচ্ছে'

কি নাম তোমার?, মেয়েটিকে জিগ্যেস করলাম

প্রথমে কিছু বললনা, দ্বিতীয় বার জিগ্যেস করায় আস্তে করে বললো, হাসনাহেনা।

সুন্দর নামতো, সামনে পরীক্ষা?

জ্বী।

ভয় লাগছে?

না

তাহলে?

সে আর কিছু বললনা। টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইলো। এক হাতের আংগুল দিয়ে আরেক হাতের আংগুল গুলোকে প্যাচাঁতে থাকলো।

আপনার ক' ছেলে মেয়ে?

'স্যার ও আমার মেয়ে নয়, আমার ভাগনি'

একটু অবাক হলাম। মানসিক রোগীদের সাধারণত মা বাবা বা ভাই বোনরা নিয়ে আসে। এখানে মামা নিয়ে নিয়ে এসেছেন। অনেক সময় এরকম হয়। মামারা ভাগ্না ভাগ্নিদের অনেক আদর করেন। নিজের ছেলে মেয়েদের চেয়ে বেশী।

ওর মা বাবা কেউ আসেন নি?

'জ্বী না,ওর চাচা এসেছেন'

মা বাবা আছেন?

আমার এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে চাইলেন না। ইতস্তত বোধ করলেন।

কি ব্যাপার?

'জ্বী মা বাবা দুজনেই আছেন'

তাহলে আসেন নি কেনো?

স্যার আসার মতো না। (দেখলাম ভদ্র লোক নিয়ে আর কিছু বলতে চাইছেন না, এড়িয়ে যাচ্ছেন। তাই আমিও একটু প্রসঙ্গ পাল্টালাম। এমনিতেই বেরিয়ে আসবে)

আচ্ছা, ওরা ক' ভাই বোন।

'তিন ভাই বোন। একজন ভাই মারা গেছে। এখন এক ভাই এক বোন'

আরেক ভাই?

'আছে, কিন্তু সে তেমন ভালোনা'

মানে? খুলে বলুন।

'ওর ভাইটা একেবারে বেখেয়ালি। কিচ্ছু বুঝেনা। যখন তখন রেগে যায় ভাংচুর করে। একে ওকে গালি গালাজ করে। আবার কখনো কখনো একেবারে চুপচাপ। একা একা থাকে। ধ্যান করে'

পড়াশুনা, খেলাধুলা, বন্ধুবান্ধব দের সাথে মেলামেশা?

'না। ওগুলো কিছুতেই নেই। ওকে মানসিক রোগের ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছি। আগে মোল্লা কবিরাজ দেখিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুই হয়নি। খামাখা লাখ লাখ টাকা অপচয় হয়েছে। পরে মানসিক ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছি। এখন আল্লাহর রহমতে কিছুটা শান্ত। তবে পড়াশুনা আর করাতে পারিনি'

আচ্ছা ওর মা বাবার কথা জানা হলোনা।

'স্যার খুলেই বলি। ওর বাবা পুরোই পাগল। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। বছরের তিনমাস ভালো তো তিন মাস পুরা পাগল। আমার বোনকে যখন বিয়ে দেই তখন যতটা মনে পড়ে সে ভালো ছিলো। বিয়ের পর আস্তে আস্তে কেমন জানি হয়ে যায়। ও অবস্থাতেই সংসার চলে এতোটা বছর। ভাগ্নাভাগ্নি গুলার জন্ম হয়।
আমরা সময় সময় সাহায্য সহযোগীতা করতে থাকি। কিন্তু গেলো ক'বছর থেকে সে আমার বোনটি আর অতোটা ভালো নেই। তাই ভাগ্না গুলাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসছি। কিন্তু দিনকে দিন দেখি ওরাও এখন কেমন হয়ে যাচ্ছে। কিছুটা ওদের বাবার মতো'

ওদের মা?

'মানে আমার বোনের কথা বলছেন?'

হ্যা।

'ওতো ভালো ছিলো। এখন ওর অবস্থা ও কেমন জানি। নাওয়া খাওয়া ঠিক নাই। কেবল কান্নাকাটি করে। মাঝেমধ্যে একাএকা কথা বলে। বলে, আল্লাগো, আমার স্বামী কে নিলা। কইলজার ধন একটা কে একেবারেই নিয়া নিলা। এখন বাকি দুই ছেলে মেয়ে। এদের ও নিয়া নিবা? আমি কি অপরাধ করছি আল্লাহ? ক্যান আমারে এতো কষ্ট দিতেছো। তার চেয়ে আমারে একেবারে দুনিয়া থাইকা নিয়া নেওগো আল্লাহ'

আচ্ছা আপনাদের মা বাবা চাচা ফুপু কারো কি মানসিক রোগ আছে বা ছিলো?

'না স্যার। আমাদের বংশে এরকম কিছু নেই। তবে ভাগ্নিটার চাচা, ফুফুদের মধ্যে কিছু কিছু আছে। শুনেছি ওদের দাদাও নাকি কেমন ছিলেন। যদিও উনি এক সময় গ্রামের চেয়ারম্যান ছিলেন। পরে কেমন নাকি হয়ে যান। আচ্ছা স্যার মানসিক রোগ কি এভাবে পরিবারের সবার হয়?'

প্রশ্নটা জটিল। একটু থেমে বললাম,
না, ঠিক তেমন করে না। হতে পারে, নাও হতে পারে। তবে একটা চান্স থাকে। আবার এমন ও আছে, সংসারে বা রক্তে কারো মানসিক রোগ নাই কিন্তু পরবর্তীতে দেখা দিয়েছে।

'জ্বী। আমার বোনটাও এখন কেমন জানি ওদের মতো হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বংশেতো কারো মানসিক সমস্যা নেই? তাহলে ওর কিভাবে দেখা দিলো? বোন'টাতো মাঝে মধ্যে কান্নাকাটি করে, একা একা কথা বলে'

"আপনার ভাগ্না ভাগ্নি গুলোর যেটা হয়েছে তা হলো বংশ গত। ওদের বাবা ও দাদার মধ্যে সেটা ছিলো। কিন্তু আপনার বোনের যেটা হলো সেটা হলো পারিবারিক স্ট্রেস, যন্ত্রণা, কষ্ট এসবের জন্যে।
মানসিক রোগি নিয়ে পরিবার সংসারে চলা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। সবাই পারেনা। একসাথে থাকতে থাকতে অনেক সময় কিছুটা মানসিক রোগের লক্ষন দেখা নিজেদের মধ্যে দেখা দিতে পারে। একে শেয়ার ডিলিউসন বলে।
আমাদের সমাজ, সংসার মানসিক রোগী আছে এমন পরিবার কে দেখলে এড়িয়ে চলে। বাঁকা চোখে তাকায়। অথচ এটা ঠিক নয়। এটা এক ধরনের অশিক্ষিত মুর্খদের মতো আচরন। বরং এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে তোলা উচিৎ। উন্নত বিশ্বে তাই করে তারা"

'স্যার, ওরা কি ভালো হবেনা? পরিবার'টাকি এভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। দেখুন কবিরাজ কি করেছে মেয়েটার। গত সপ্তাহে গিয়েছিলো ল্যাংটা কবিরাজের কাছে। গরম সুই দিয়ে দুই কান ফুটা করে দিয়েছে। আর একটা আংটি পড়িয়ে দিয়ে বলেছে দ্রুত মেয়েকে বিয়ে দিতে। আংটিটার দাম নিয়েছে তেত্রিশ হাজার এক টাকা।

টাকা ব্যাপার না স্যার, কিন্তু এই অবুঝ ভাগ্নিটা কে কিভাবে বিয়ে দেই এখন, আপনিই বলুন? আমার স্ত্রী এখোনো তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেই। আর আরেকটি কথা, আমার ভাগ্নি খুব ভালো গান গাইতে পারে। কখনো কখনো একটার পর একটা গান গাইতে গাইতে রাত পার করে দেয়। আমরা অবাক হয়ে শুনি। শুনবেন নাকি আপনি ওর একটা গান..?'। তার চোখ ছল ছল করে উঠলো। আড়াল করে তিনি চোখ টা মুছলেন'

খবরদার ভাই। ওসব করতে যাবেন না। ওভালো হবে, ভালো থাকবে ওরা। যেহেতু ওর চিকিৎসায় আপনি আর বিলম্ব করেন নি। তবে ধৈর্য ধরে আপনাদের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। মানসিক রোগের চিকিৎসা একদিনে হয়না। ওসব ও ডায়াবেটিস, প্রেশার এর মতো দীর্ঘদিন করতে হয়। অযথা মোল্লা, কবিরাজ, ঝাড়ফুঁক, মরিচ পুড়া, গরম খুন্তি পড়া এসব দিয়ে আমরা জটিল করে তুলি।

'স্যার, এ ভাগ্নিটাও কি তার ভাই আর বাবার মতো হয়ে যাবে? ওতো মাঝেমধ্যে বলে, কানে কিসের যেনো আলগা আওয়াজ পায়।'

না সম্ভাবনা কম। যেহেতু প্রাথমিক অবস্থায় ওর চিকিৎসা আপনারা করা শুরু করছেন।

আমরা চিকিৎসা নিতে দেরী করে, সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে লজ্জা বোধ করি। আর উল্টোপাল্টা অপচিকিৎসার দ্বারস্থ হয়ে রোগটাকে জটিল করে তুলি অনেক সময়।

দুই.

কিছু কিছু মানসিক রোগ আছে যে গুলো মা বাবার থাকলে অনেক সময় সন্তান দের মধ্যে হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কিন্তু একেবারে দেখা দেবে এমন কোন কথা নেই। আর সন্তানের মধ্যে দেখা দিলেও যে তাকে সুস্থ করে তোলা যাবেনা এমন কোন কথা নেই। বরং সন্তানের মধ্যে মানসিক রোগের লক্ষন দেখলে যত দ্রুত মানসিক চিকিৎসক দের শরণাপন্ন হবেন, ততই তার জন্যে মঙ্গল হবে। তার সুস্থ সুন্দর ভাবে বেড়ে উঠার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
_______________________________

ডা. মো. সাঈদ এনাম
কে-৫২, ডি এম সি।
সাইকিয়াট্রিস্ট
মেম্বার, ইউরোপিয়ান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়