Ameen Qudir

Published:
2018-04-17 15:57:52 BdST

একটি অসমাপ্ত বিদায়




ডা. শরিফুল আলম রুবেল
______________________________


(শ্রদ্ধেয় শামসুল ভাই দ্ধারা অণুপ্রানিত)

ফাইনাল প্রফের রেজাল্ট বের হবে আজ,এই প্রফটা কেমন জানি।সার্জারীর মধ্যে চক্ষু,নাক-কান-গলা আছে; মেডিসিনে তো সাইকিয়াট্রি-পেডিয়াট্রিসহ কী কী হাবিজাবি আছে। এদিক থেকে ভালো গাইনি,শুধু গাইনী ও অবস. ছাড়া আর কিছু নাই। এই গাইনীতে উৎরায় যাব,কিন্তু বাকী ২ টা নিয়ে ঝামেলায় আছি।

রেজাল্ট হল। রেজিস্ট্রেশন নম্বর বলে পাস/ফেল ঘোষণা হচ্ছে। ফল ঘোষণা করতেছেন প্রদ্যুৎ স্যার। খুব একাডেমিক এবং ছাত্র-বান্ধব টিচার। । স্যারের অনেক কথা মনে পড়তেছে, ডি জা বু,জামাই বাবু বলে নার্ভাস সিস্টেম পড়াতেন। ডায়বেটিস নিয়ে স্যার ভালো পড়াতেন। আরও কত কী। রেজাল্ট ঘোষণা প্রায় অর্ধেক শেষ। এখন ১ সাবজেক্টে ফেলদের নাম বলা হচ্ছে। আমি আবার আনমনা হয়ে গেলাম। সার্জারীর নাজমুল স্যারের কথা মনে পড়ল। বাঘে-মহিশে এক ঘাটে জল খেত স্যারের ভয়ে। স্যারের জ্ঞান ও ছিল প্রচুর,সব সাবজেক্টে মারাত্মক দখল ছিল। স্যার ও না কী এফসিপিএস ৫০ পেরোনোর পর কমপ্লিট করেছেন !

বুঝলাম না,আজ কী সব চিন্তা ভাবনা আসতেছে। রেজাল্ট ঘোষণা চলতেছে। এখন ২ সাবজেক্ট ফেলদের রেজাল্ট দেয়া হচ্ছে। আমি এ দলে থাকব না সে বিশ্বাস আছে। পরে বন্ধু কারও কাছ থেকে রেজাল্ট শিট দেখে নিতে হবে। মনটা আজ কাবুতে নাই।

মনে পড়ল,কার্ডিও স্যারের কথা,নিপাট ভদ্রলোক মানুষ। আমরা ধুমায়া প্রক্সি দিতাম আবার ধরাও খেতাম।কোন স্যার যেন সবাইকে ‘আপনি’ করে বলতেন আর প্রক্সি ধরলেও কিছু বলতেন না। এদিক থেকে বিপরীত ছিলেন চক্ষু বিভাগের স্যার। নাম ও মনে পড়ছে না,এই স্মৃতি দুর্বলতাই আমাকে খাইল। পড়ি অনেক কিন্তু মনে থাকে না।

ভাবনায় ছেদ পড়ল,রেজাল্ট ঘোষণা শেষ। ৩ বিষয়ে একজনই শুধু ফেল করেছে,রেজিস্ট্রেশন নম্বর বলায় কেউ ধরতে পারতেছে না সে কে। হবে বোধহয় রোল ১৬৫,ঐ বেচারির পরীক্ষায় ‘থট ব্লক’ হয়ে যায়। আমি ভুলে যাই আর ও বলতে যেয়ে আটকায়া যায়,অদ্ভূত।

সবাই রেজাল্ট শিটের সামনে ভীড় জমাইছে, ফটো নিচ্ছে,আমি জামিলকে ফটো মেসেজ করতে বলে,বাসার দিকে হাঁটা দিলাম। রেজিস্ট্রেশন কার্ড বের করা লাগবে। এ এক হাঙ্গামা। স্যার রোল-কোড অনুসারে রেজাল্ট বলে দিলেই পাড়তেন। খামোখা কষ্ট। বাসায় পৌছে রেজিস্ট্রেশন কার্ড বের করলাম,রেজাল্ট মেসেজে এসে গেছে। মিলালাম...........

আমার রুমের ফ্যানটা বেশ শক্ত,বাবার পছন্দের প্রদীপ কোম্পানি। নাইলনের রশি আম্মা ভেজা কাপড় শুকানোর পর প্রতিদিন আমার রুমে রাখেন। একটা ট্রায়াল দিলাম ফাঁস লাগার,আমার ওজন কমপক্ষে ১০-১৫ মিনিট ঝুলবে ফ্যানের সাথে। অবশ্য ১০ সেকেন্ড পরই অজ্ঞান হয়ে যাব,হার্ট লাফাবে বাকী ১০ মিনিট,তারপর লজ্জা থেকে মুক্তি।

বসলাম সুসাইড নোট লিখতে।এটা দেখলে পুলিশ বেশী হয়রানির সুযোগ পাবে না। কী লিখব ?
“প্রিয় বাবা,আমি চলে যাচ্ছি”—দূর আব্বা রেগে থাপ্পড় দিবেন।
“আম্মা,আমি পারলাম না”—-নিজের হাসি পেল,আম্মাকে কেউ কী এভাবে চিঠি লিখে !
“টুকি,তুই সবার খেয়াল রাখিস, একদম কাঁদবি না।”—ছোট বোন রে লিখা যায়,যদিও ঐ সবচেয়ে বেশি কাঁদবে। হয়তো ফ্যান থেকে ঝুলা পা ধরে কাঁদবে,ও হাসে যেমন জোরেজোরে কাঁদবে ও বোধহয় হাউমাউ করে। কাঁদুক,এক সময় তো ভুলেই যাবে। সবাই ভুলে যায়।

ক্লাসের সেই গোলগোল চশমার মেয়েটা এখনো কী পড়তেছে পোস্ট-গ্রাজুয়েসনের জন্য,রাহুল বোধহয় ক্লিনিক ডিউটি তে। আরও কতগুলা নাম ভাসতেছে,ফাজলামোতে সেরা ছেলেটা,কথায় কথায় রাগ করা রোলমেট,লেডিসখ্যাত ছেলেটা আজ রেজাল্ট নিতে এসেছিল কী ? কল্পনাগুলা কেমন ছিঁড়া ছিঁড়া হয়ে যাচ্ছে। হয় বোধহয়,মৃত্যুর আগে এমনই হয় হয়তো।

ব্যস,কাজ শেষ। এখন লজ্জা-অপমান ঝেড়ে চলে যাবার সময়। এহ হে,ফজরের আযান হয় দেখি। কাইয়ূম মুয়াজ্জিনের কোন হুঁশ থাকে না,যেদিন যেসময় ইচ্ছে আজান দিয়ে দেয়। কাল মসজিদ কমিটিতে বলা লাগবে,এত বেখেয়াল হলে হয় ? খেয়াল হল, কাল আমিই তো থাকব না।আজানের জবাবটা দিয়ে দিই,পুরনো অভ্যাস।আব্বা-আম্মা-ছোট বোন আর আমি ঘুমাতাম বড় ঘরে একসাথে, প্রায় ১৫/২০ বছর আগে। তখন আব্বা জিজ্ঞেস করতেন,ঘুমানোর আদাব কী,একসাথে সূরা এখলাস পড়তে হত,পরে ঘুমাবার দুআ। বোন ছিল ফাজিল,সে পড়তো না বরং আমাকে কাতুকুতু দিত;হাসলেই তো আব্বা দিবেন ধমক।আমারে ধমক খাওয়াতে পারলে ওর বেজায় আনন্দ ছিল। টুকির জন্য খারাপ লাগছে,ও বলেছিল কোম্পানির সব প্যাড আর কলম ওরে দেয়া লাগবে;ওর কোন কোন বান্ধবীকে দিবে সে লিস্ট ও করে ফেলেছে। থাক, সবার সব আশা তো পূরণ হয়না; অপূর্ণ আশাগুলা স্মৃতি হয়ে অমর থাকবে—কোন বইয়ে জানি পড়েছিলাম।মনে থাকে না এখন আর,আগের মতো।

আজান প্রায় শেষ। আমি ও প্রস্তুত। হঠাৎ খেয়াল হল এনাটমীর ব্যাচ টিচার হামিদ স্যারের কথা। হাসিখুশী,দিল দরিয়া,ভাবুক মানুষ। আমার প্রচুর ভালো লাগত, স্যারের ফোন নম্বর আছে একবার কথা বলতে ইচ্ছে হল। যদিও সময়টা একটু অড,কিন্তু আজ আর নিয়ম মানতে ভালো লাগছে না। বিদায়ের আগে একটু অনিয়ম করেই যাই। মোবাইলে ব্যালান্স আছে ২.৮০ টাকা। দিলাম কল,রিং হচ্ছে......

-হ্যালো,স্যার...
—-কী রে আর্লি বার্ড, এত সকালে...
-স্যার চিনছেন ?
—-না বাবা,নিজের বউরে এতদিনে চিনলাম না আর তোমারে কেমনে চিনুম ? তর নাম্বার সেভ আছে রে। চিনছি। রেজাল্ট কী হইছে ?
-(স্যারের মুখে কিছুই আটকায় না,আগের মতোই,অনেক কথা বলেন, টাট্টা-তামাশায় একাকার) স্যার কোনটাতে পাস করতে পারিনি।
—-তোর বাসা যেন কই ?

রেখে দিলাম,শেষ সময়ে পিছুটান রাখতে নেই। মনটা কেমন নির্ভার হয়ে গেছে। সব আশা যেন পূরণ হয়ে গেছে।রবি ঠাকুরের কবিতাটা মনে করার চেষ্টা করলাম, নাম ভুলে গেছি।
...“ কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও।” ...
আচ্ছা,আত্মহত্যা করলে কী জানাজা হয় ? ময়নাতদন্ত তো অবশ্যই হবে। আর ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না। চোখ মুজলাম,এ জীবনে আর চোখ খুলতে পারব না।
“...দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে
তোমা হতে বহুদূরে।”...
মৃত্যুর পর চোখে কী কী পরিবর্তন যেন হয়,ম্যাডাম পড়াইতেন,না কী স্যার পড়িয়েছিলেন ? স্মৃতি এলেমেলো হয়ে যাচ্ছে। চোখ ঝাপসা হচ্ছে। মৃত্যু একটি প্রক্রিয়া,সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। বুকটা ধড়াশ ধড়াশ করতেছে,যেন হৃদয়টা ফেটে বের হয়ে আসবে,হাত-পা অনবরত কাঁপছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে,আরও একবার বাঁচার চেষ্টা করব না কী ?
“.....ফিরিবার পথ নাহি;
...দূর হতে যদি দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায়।”..
শক্তি ফুরিয়ে যাচ্ছে,চিন্তাগুলা কেমন এলোমেলো,আম্মা বকতেছেন বিছানায় নোংরা পায়ে উঠায়,আব্বা ৫০০ টাকা দিছেন টুকির মারফত,ওর শেয়ারের ৫০ টাকাটা কই জানি রেখেছিলাম, মেছাবজ্বী ‘কালেমার’ ছবক নিচ্ছেন, ঈমানে মুফাসসাল ভুলে গেছি।
“.....যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায় .....“
নামাজ পড়ার জন্য কেউ কী দরজায় ধাক্কাচ্ছে, কানটায় প্রচন্ড আওয়াজ হচ্ছে, বিটিভি রাত ১২টার পর যেরকম আওয়াজ করে অনেকটা সেরকম। মৃত্যুর প্রক্রিয়া কী শুরু হয়নি ? ১০ সেকেন্ড পর তো অজ্ঞান হবার কথা।আমার তো স্পষ্ট মনে পড়তেছে বৈশাখে লাল ফুল দিতে যাচ্ছি।
“.....ওগো তুমি নিরুপম,
...হে ঐশ্বর্যবান,
.....তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান; ......“
কাকে যেন ফুল দিতে যাচ্ছিলাম,ভুলে যাচ্ছি সব,কষ্ট বাড়তেছে। একটু পানি খাওয়া দরকার,টুকি জগ রাখে তো প্রতিদিন। টেবিলের বইটা গুছিয়ে রাখা কী না দেখতে চাইলাম,ক্লান্তি এসে গেছে আর পারছি না, দরজা ধাক্কাচ্ছেন বড় মামা,নামাজের জন্য ডাকতে এসেছেন দাদাভাই,মহল্লার সাবেক চেয়ারম্যান এসেছেন,এত এত পরিচিত মানুষ,সবাই সাদা পোষাকে,চাচার কাফন তো আমিই দিয়েছিলাম,
“.....মোর লাগি করিয়ো না শোক,”......
কষ্ট হচ্ছে,প্রতীক্ষা করছি, ১০ সেকেন্ড চলে যাচ্ছে, সময় ফুরাচ্ছে........”কালের যাত্রায়।
হে বন্ধু, বিদায়।”........

_________________________________

ডা. শরিফুল আলম রুবেল। সুলেখক। আলোকচিত্রী।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়