SAHA ANTAR

Published:
2021-10-16 19:57:56 BdST

সাম্প্রদায়িকতা ও আজকের ভাবনা


লেখক

 

রাজিক হাসান 

নিরপেক্ষ বিশ্লেষক 

লন্ডন থেকে 

____________________

 

৪৬ এর তথাকথিত দাঙ্গার কথা সবারই মনে আছে। এখন যারা বৃদ্ধ তাদের তো নিশ্চয়ই মনে আছে আর যারা ৪৬ এর পরে জন্মেছে বা যারা অল্পবয়সী তারাও তাদের বাবা মা, দাদু ঠাকুমাদের কাছে শুনেছে। খুবই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল সেই সময়ে।

আসলে কিন্তু ওটা দাঙ্গা ছিল না। ওটা ছিল সুপরিকল্পিত হত্যাকান্ড। যারা বলে ৪৬ এ রায়ট হয়েছিল তারা এটা ভাবে না, ৪৬ এর আগে দুশো বছরের ইংরেজ শাসনে একবারও হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা হল না কেন। বরং ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ হয়, হিন্দু মুসলিম একত্রে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল।

প্রকৃতপক্ষে দেশের রাজনীতিকরা জেনে গিয়েছিল স্বাধীনতা আসন্ন। তাই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ছেড়ে দেশটাকে কিভাবে ভাগ করে খাবে সে বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দ্বিজাতিতত্ব খাড়া করে ধর্মের নামে দেশভাগ করার জন্য তাদের হিন্দু মুসলমানের “দাঙ্গার” প্রয়োজন ছিল, তারা সেটা ঘটিয়েওছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষকে মেরে প্রমাণ করা হয়েছিল হিন্দু মুসলমান একসাথে থাকতে পারবে না, তাই দেশভাগ প্রয়োজন। ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট সেটা করেছিল। দেশটা ভারত ও পাকিস্তান এই দুইভাগে ভাগ হয়ে গেল।

ব্রিটিশ পিরিয়ড এবং ইন্ডিপেনডেন্ট ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় শুধুমাত্র ধর্মীয় দাঙ্গায় হত্যা করা হয়েছে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখের উপর মানুষ। এর মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিষ্টান ধর্মীয় মানুষ থাকলেও বেশীর ভাগই হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা সংগঠিত হয়। এক পার্টিশনের সময়েই মারা গেছে প্রায় ২০ লাখ মানুষ, আর রিফিউজি হয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় দেড় কোটি মানুষ। পৃথিবীর ইতিহাসে এটাকেই সবচে বড় মাইগ্রেশন বলে ধরা হয়। এর সবই করা হয়েছিল ধর্মের নামে।

"বিভাজন করো, শাসন করো"; অনেক প্রাচীন এই নীতির উপর ভর করেই রোমান সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। শেক্সপিয়রের "এন্থনি ক্লিওপেট্রা" নাটকে চমৎকারভাবে তা ফুটে উঠেছে। জুলিয়াস সিজার নাটকেও দেখা যায়, একই নীতি প্রয়োগ করে সিজার সিনেট দুই ভাগ করে সিনেটরদের দুর্বল করে দেয়; ফলে রোমের সর্ব ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে তাকে আর বেগ পেতে হয় না। অগাস্টাস সিজার, দ্য ফার্স্ট এম্পেরর, ইজিপ্ট দখল করে নেয় একই নীতি প্রয়োগ করে। পরবর্তীতে এই বিভাজন নীতিই হয়ে যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বুনিয়াদ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের একটি ঘটনা বলছি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর জার্মানরা তাদের কলোনি রুয়ান্ডাকে উপহারস্বরূপ দিয়ে দেয় বেলজিয়ামের রাজাকে। রুয়ান্ডার জনগোষ্ঠি ছিল রুয়ান্ডিজ। সেখানে তাদের মধ্যে কোন জাতিগত বিভেদ আদৌ ছিল না। এরপর এক জার্মান বিশেষজ্ঞ নতুন একটি তত্ব জাহির করেন। তত্ব অনুসারে রুয়ান্ডার প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের নাক মাপা শুরু করে তারা ক্যালিপা নামক বিশেষ এক যন্ত্র দিয়ে। নাকের মাপ অনুসারে তারা হুটু ও তুতসি উপজাতি নামে রুয়ান্ডিজ জনগনকে দুইভাগে বিভক্ত করে। ফলে একই ভাষা, একই সংস্কৃতি ও একই ইতিহাসের ধারক, এমন কি একই পরিবার বিভাজিত হয়ে হয়ে পড়ে ভিন্ন জাতিতে। বেলজিয়ামের রাজা তুতসিদের নানা সুযোগ সুবিধা দিতে থাকে আর সেই সাথে হুটুদের উপর আত্যাচারী শাসন করে। এরপর ১৯৬২ সালে রুয়ান্ডা স্বাধীন হয়। ফলে বেলজিয়ানরা দেশ ছেড়ে চলে যায়, তখন শুরু হয প্রতিশোধের পালা। শুধু ১৯৯৪ সালেই হুটু আর তুতসির পারষ্পরিক দাঙ্গাতে এক মিলিয়নের উপর মানুষ নিহত হয়। অথচ অতি সাম্প্রতিক এক গবেষনায় জেনেটিক বিশ্লেষনে প্রমাণিত হয় হুটু আর তুতসি ভিন্ন জাতি নয়। ঐ জার্মান তত্ত্ব ছিল ভুল। নিঃসন্দেহে ইচ্ছেকৃত ভুল। শুধু এই একটি ভুল তথ্যের কারণে রুয়ান্ডাকে দখল, লুটপাট ও শাসন করা তাদের জন্য সহজ হয়ে যায়।

আমাদের দেশের আজকের সাম্প্রদায়িকতাও মোটেও ' ধর্মীয় সংকট ' নয় , এটা পুরোদস্তুর ' রাজনৈতিক সংকট। তবে ধর্মকে তা পুঁজি করে এগোয় কিন্তু প্রয়োগ হয় রাজনৈতিক মতলবে। আধুনিক রাষ্ট্র , রাষ্ট্র কাঠামো বা রাষ্ট্র চিন্তা কোন ধর্ম ধারণ করতে পারেনা। যে সমস্ত নির্বোধ ধর্মের পথে রাষ্ট্রের ইহজাগতিক সমস্যার সমাধান খোঁজেন তারা হয় মুর্খ নয় শয়তান। এর ফলে কী দেখি আমরা?

মিয়ানমারে মুসলিম সম্প্রদায় আক্রান্ত হলে এখানে বৌদ্ধরা আতঙ্কে থাকেন, আক্রান্ত হন। ভারতে মুসলিমরা আক্রান্ত হলে এখানে হিন্দুরা আতঙ্কে ভোগেন , নির্যাতনের শিকার হন। কেন হয় এমন? কারণ ভুল চিন্তায় আমরা তিনটি দেশকে শনাক্ত করি ধর্মীয় পরিচয়ে।

আমাদের দেশের জনগণের বেশ বড় একটা অংশ দিন দিন সাম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছে। নির্মম শোনালেও বাস্তবতা এটাই। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম' অক্ষত রেখে,রাষ্ট্রের চরিত্র কি আর অসাম্প্রদায়িক থাকে?

এখানে ধর্মীয় দাঙ্গা হচ্ছে না বা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটছে না। কারণ দুটো পক্ষ বিবদমান নয় এখানে । এখানে হত্যা, ধর্ষণ, লুট, সম্পদহানি এমন পর্যায়ে গেছে যা অনেকটা ethnic cleansing রূপ নিয়েছে। যা মানবাতার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অপরাধ।

সহিংসতার কারণ হিসেবে propaganda machine থেকে ধর্ম অবমাননা বা ধর্মানুভুতি আহত হবার যে ধারনা দেয়া হচ্ছে সেটা কিন্তু ডাহা মিথ্যা। সত্যতা নেই মোটেও। অজুহাত মাত্র।

এই ধর্মীয় অপশক্তিটি ন্যুনতম সামাজিক প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়নি। কারণ এদের রাজনৈতিক ও সামাজিক পৃষ্ঠপোষক আছে।

সরকারের ব্যর্থতা প্রকট ও অনস্বীকার্য। সরকার এদের দমনে দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহনে যেমন ব্যর্থ হচ্ছে তেমনি প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণেও সফল হচ্ছেনা।

গণতান্ত্রিক ও বাম রাজনৈতিক শক্তিসমুহ ভয়ানক নীরবতা পালন করছে। এদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ব্যর্থতা শোচনীয়।

রাজনৈতিক চাপ সৃ্ষ্টির জন্য জরুরি হলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিজস্ব কোন সংগঠন নেই। ' হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ ' নাম নিয়ে যেটি আছে তা তেমন সক্রিয় নয় অথবা দালাল।

এই অশুভ চক্রটির সাথে পুলিশ পেরে উঠছেনা নাকি তাদের পেরে উঠতে দেয়া হচ্ছেনা - এই দ্বিমুখি চিন্তায় মানুষ দ্বিতীয়টি বিশ্বাস করে। পুলিশের দক্ষতা নিয়ে নয় , সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তাদের।

ধর্মভিত্তিক দলগুলো দৃশ্যত কোনঠাসা হলেও যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা মসজিদ, মাদ্রাসা ও অরাজনৈতিক ইসলামি জলসা প্রভৃতির মাধ্যমে ভিন্নধর্মের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো অব্যহত রয়েছে।

আমরা যেন মনে রাখি, ক্ষতি না করে শুধুমাত্র কোন জনগোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে আতংকের মধ্যে রাখলেও তা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।

মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী সরকার নিজেদের কোন ইমেজটি প্রতিষ্ঠিত করতে চায় সেটা তারা জানে তবে ইতিমধ্যে তাদের ' সেকুলার ' ইমেজটি যে বিনষ্ট হয়ে গেছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরুপায় সমর্থন দিয়ে গেলেও মন থেকে আগের বিশ্বাসটি নেই।

দৈনন্দিন আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ' সরকার 'কে ক্ষতিগ্রস্থ করে আর সামাজিক স্থিতি বিনষ্ট হলে ক্ষতি হয় ' রাষ্ট্র ' র। রাষ্ট্রের ক্ষতি মেরামতে সরকারের আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না।

রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার রুখতে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া যত না জরুরী তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি রাষ্ট্রের ইহজাগতিক হওয়া। ধর্ম হল মর্মগতভাবে পারলৌকিক কিন্তু রাষ্ট্র বস্তুগত অর্থে সম্পূর্ণ ইহলৌকিক।

পরলোকে তাই নাগরিকের স্বর্গ বা নরক প্রাপ্তিতে রাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না। কারণ ধর্ম বিষয়টাই প্রবলভাবে ব্যক্তিগত।

ধর্মের বাস মানুষের চিন্তা চেতনায়। তাহলে সে চিন্তা চেতনার দায়ভার বাস্তব রাষ্ট্র কীভাবে নেয় ? ' কথিত ধর্ম ' বনাম ' বাস্তব রাষ্ট্র ' মিলবে কিভাবে ?রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয় ব্যক্তি মানুষের চিন্তার ভেতর উঁকি দিয়ে তার চিন্তার স্বরুপ দেখা। যেখানে খোদ কোন মানুষের পক্ষেই জানা সম্ভব হয়না নয় ঠিক তার পাশের মানুষটির ধর্মচিন্তার স্বরুপ।

একজন মানুষের ধর্মীয় পরিচিতি সামাজিকভাবে থাকতে পারে, যদিও এখানেও নানা বিভেদ রয়েছে তাই প্রকাশ্য কিন্তু তার অপ্রকাশ্য চিন্তা কীভাবে রাষ্ট্র শনাক্ত করবে ? রাষ্ট্র তো ঈশ্বরের মত দিব্যজ্ঞানের অধিকারী কোন সত্তা নয় যে তার নাগরিকের পাপ-পূণ্যের বিচারে বসবে ! ধর্মের সাথে রাষ্ট্রকে যুক্ত করা তাই তত্ত্বগতভাবে অবাস্তব এবং অসম্ভবও বটে।

ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা যারা বলে তারা মিথ্যাবাদী। পৃথিবীতে কোন কালে কখনো কোন ধর্মরাষ্ট্র ছিল না, বর্তমানেও নেই এবং আগামীতেও থাকবে না। তাররপরও এসব অলীক কথা যারা বলে বেড়ায় তারা মূলত ধর্মের দোহাই দিয়ে ইহজাগতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য তা বলে। নিজেদের অনৈতিক ও অবৈধ ক্ষমতাকে ন্যায্যতা দেবার জন্য বলে।

সবচে বড় কথা রাষ্ট্রের উদ্ভবই হয়েছে জাগতিক বিষয়-আশয় দেখভাল করার জন্য। রাষ্ট্র যদি দেখে যে তার নাগরিকরা বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী তখন তার কাজ হবে, রাষ্ট্রের নিয়ম লংঘিত না হলে তাতে বাঁধা না দেয়া। এবং কোনো সুনির্দিষ্ট ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা না দেয়া।

" ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার " - এ শ্লোগানটি এসেছে একটি চেতনা থেকে। এ শ্লোগানের সাথে মিল রেখে ইদানীং অনেকে না জেনে বিভ্রান্তিকর শ্লোগান তুলছে , বলছে- " ধর্ম যার যার, উৎসব সবার "।

এটা আপাত দৃষ্টিতে সদিচ্ছাপ্রসুত মনে হলেও তা কোনক্রমেই স্বচ্ছ চিন্তা নয়। ঈদ উৎসব কী হিন্দুর হতে পারে অথবা রথযাত্রা কী হতে পারে মুসলমানের ?

ধার্মিক মানুষের ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া যেমন প্রায় অসম্ভব তেমন ধর্মীয় প্রথা বা উৎসবের সার্বজনীন হওয়া আরো অসম্ভব। ধর্ম ,বর্ণ জাতীয়তা মানুষকে বিভক্ত করে,খন্ডিত পরিচিতি দেয়। মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে দেয়না। ধর্মের উর্দ্ধে উঠেই না মানুষকে ' মানবিক মানুষ ' হতে হয়!
সুতরাং এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা হবে, রাষ্ট্রের নাগরিকদের ' মানুষ ' হতে সহায়তা করা। রাষ্ট্র এ কাজ তখনই করতে পারবে যখন সে ধর্মনিরপেক্ষতাকেও অতিক্রম করে আরো মানবিক, আরো ইহজাগতিক হবে।

© রাজিক হাসান

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়