Ameen Qudir

Published:
2020-03-18 20:42:35 BdST

করোনার বিরুদ্ধে লড়াই : প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো যেভাবে অনুপ্রাণিত করলেন নাগরিকদের



_________________________

শ্ওগাত আলী সাগর
সম্পাদক
নতুনদেশ , কানাডা
____________________

১. জাতীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বক্তৃতা দেয়ার কথা দুপুর ১টায়। সরকারিভাবেই এই তথ্যটা জানানো হয়েছিলো। সেল্ফ আইসোলেশনে থাকা জাস্টিন ট্রুডো রিডো হল কটেজের পোডিয়ামের সামনে আসেন প্রায় ৪০ মিনিট পর। এমন গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর সময়ে বক্তৃতা শুরু করতে ৪০ মিনিট দেরি হলো কেন?

সপ্তাহের শেষ দিন শুক্রবার পর্যন্ত সবকিছুই অনেকটা ঠিকঠাক ছিলো। কানাডার টপ ফিজিশিয়ান ( প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা) থেরেসা ট্যামের রোববারের বক্তৃতাটাই কি পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে অস্থির করে দিলো। করোনা ভাইরাস নিয়ে ফেডারেল পর্যায়ে নিয়মিত ব্রিফিংটা তিনিই করেন। রোববারের ব্রিফিং এ তিনি ঘোষনা দিলেন, Our window to flatten the COVID-19 curve is narrow’ . তিনি বললেন, কানাডীয়ানদের এক্ষুনি পদক্ষেপ নিতে হবে, নইলে ভাইরাসের বিস্তৃতি রোধ করা কঠিন হয়ে পরবে। তার বক্তৃতা ব্রেকিং নিউজ হয়ে যায় মিডিয়ায়। নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগ দানা বাধে। পুরো রাষ্ট্রই যেনো নড়েচড়ে বসে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেই বসে যায় মন্ত্রীপরিষদের জরুরী বৈঠক।



২.মন্ত্রীপরিষদের বৈঠকের আলোচনায় ছিলো বিমানবন্দরে স্ক্রিনিং জোরদার করা, চারটি প্রধান বিমানবন্দরে্ সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের উঠানামা সীমিত রাখা। সোমবার সকালেও সেই আলোচনাই ছিলো।মর্নিং হেডলাইনে বেশ কয়েকটি মিডিয়া ট্রুডোর ঘোষনার আগাম নিউজেও তাই বলেছিলো।

সোমবারের সকালটা অবশ্য অটোয়ার সীমাহীন ব্যস্ততায় কেটেছে। বৈঠকের পর বৈঠক। শলা পরামর্শ। সেই শলাপরামর্শ চূড়ান্ত করতে ভাষনের সময় পেরিয়ে যায়। ট্রুডো চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতামত চান, থেরেসা ট্যামের সিদ্ধান্ত জানতে চান। চল্লিশ মিনিট পর পোডিয়ামে এসে তিনি আমেরিকা,মেক্সিকো বাদে বিদেশি নাগরিকরা কানাডায় প্রবেশ নিষিদ্ধের ঘোষনা দেন। আগের দিন, এমনকি সকালেও এতোটা কঠোর পদক্ষেপ আলোচনায় ছিলো না। হলে এই সিদ্ধান্ত কেন নিতে হলো? একজন সাংবাদিক তাকে এই প্রশ্ন করেছিলো। ট্রডোর দ্বিধাহীনভাবে জানিয়েছেন, করোনা সংকটের শুরু থেকেই আমরা কানাডার বেষ্টক্লাশ চিকিৎসক, স্বাস্থৗসেবাকর্মী,বিজ্ঞানী এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তি্তে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।তাদের পরামর্শেই সোশ্যাল ডিসটেন্স এর পরামর্শ দেয়া হয়েছিলো। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা যখন বলেছেন, সোশ্যাল ডিসেটেন্সের সাথে বিদেশি প্রবেশ নিয়ন্ত্রন করা দরকার। আমরা তাই করেছি। আমাদের কাছে কানাডীয়ানদের নিরাপত্তা এবং সুস্থতা হচ্ছে জরুরী এবং অগ্রাধিকার। তা হলে কি এ নিয়ে কোনো মতভিন্নতা ছিলো। লকডাউন বা কানাডাকে বিচ্ছিন্ন করার পক্ষে ট্রুডো ছিলেন না। একাধিকবার তিনি এমনি ধারনা দিয়েছেন। তবে প্রতিবারই তিনি বলেছেন, আমাদের বিশেষজ্ঞরা, চিকিৎসকরা যেটি বলবেন- কানাডীয়ানদের স্বার্থরক্ষায় আমি সেটিই করবো। ধারনা করা হচ্ছে, চিকিৎসকদের বিশেষ করে থেরেসো ট্যামের জোড়ালো সুপারিশেই জাস্টিন ট্রুডো বিদেশিদের প্রবেশ বন্ধের ঘোষনা দিয়েছেন।



৩.তুমুল এক সংকটের কালে দেয়া প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর ভাষনটি কি কেবল নিছক কোনো সরকার প্রধানের ভাষন? প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তির বক্তব্য যদি নাগরিকদের মনে আস্থা তৈরি না করে, ভরসা না জাগায়- তা হলে তিনি কিসের নেতা! ট্রুডোর বক্তৃতাটা কেবল একজন নেতার বক্তৃতাই ছিলো না, এটি ছিলো দুর্যোগকালে পরিবারের প্রধান অভিভাবকের বাকী সদস্যদের বুকে আগলে রাখার মতো ব্যাপার। এর আগের বক্তৃতায় তিনি নিজেকে কানাডীয়ানদের পরিবারের ‘এল্ডারলি মেম্বার’ হিসেবে দাবি করেছিলেন। আজকের বক্তৃতায় তিনি যেনো নিজেকে সেই অভিভাবকের জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।

৪.করোনা ভাইরাসের সংক্রমনরোধে হিমসিম খা্ওয়া বিশ্বপরিস্থিতি আতংকিত নাগরিকদের সামনে দাড়িয়েছেন তিনি নির্ভরতার প্রতীক হয়ে। বলেছেন, সংকটের গোড়া থেকেই দেশের সেরা চিকিৎসক, বিজ্ঞানীদের পরামর্শের ভিত্তিতে প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েছি।তোমাদের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তোমাদের আশ্বস্থ করতে চাই, পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের মতামদের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় প্রতিটি পদক্ষেপই আমরা নেবো।

বিদেশিদের কানাডায় প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার ঘোষনা দিয়েছেন। একইসঙ্গে ব্যবসা বানিজ্য সংক্রান্ত বিমান, মেক্সিকো,আমেরিকার সাথে যোগযোগ স্বাভাবিক রেখেছেন। কানাডার খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সিংহভাগই আসে মেক্সিকো,আমেরিকা থেকে। সেইপণ্যের সরবরাহ যাতে বিঘ্নিত না হয় সেই ব্যবস্থা তিনি রেখেছেন।স্পষ্ট করেই এলছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখার সব ব্যবস্থাই তিন করবেন।
কানাডার নাগরিকদের কথা ভাবতে গিয়ে তিনি বিশ্বের বিভিন্নদেশে বসবাস ব িভ্রমনে থাকা নাগরিকদের কথা ভুলে যাননি। তিনি বলেন,আমি জানি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত কিংবা ভ্রমনরত কানাডীয়ানদের নিয়ে তোমরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠবে। আমি তোমাদের কথা দিতে চাই, দেশের বাইরে থাকা একজন কানাডীয়ানও আমাদের সহযোগিতার বাইরে থাকবে না। তাদের বিমান পেতে, ঘরে ফিরে আসার খরচের জন্য যদি সহায়তা দিতে হয় সেটি আমি করবো। ইতিমধ্যে সে জন্য বিশেষ সহায়তা প্রকল্পও হাতে নেয়া হয়েছে। দেশের বাইরে থাকা কানাডীয়ানদের উদ্দেশ্যে তিনি উদ্ধাত্ত আহ্বান জানান, যারা দেশের বাইরে আছো, এখনি সময় ঘরে ফিরে আসার, তোমরা ঘরে ফিরে এসো। যারা মাত্র ফিরেছো,তোমারা ঘরে থাকো। কেবল নিজেকেই সুস্থ রাখার জন্যই না, আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা যাতে দিরকারি জায়গায় সেবা এবং মনোযোগ দিতে পারে সেটা্ নিশ্চিত করতে তোমরা ঘরে থাকো।

ট্রুডো যখন এই কথাগুলো বলছিলেন, তখন মনে হচ্ছিলো বিদেশ বিভূঁইয়ে আটকেপড়া সন্তানের পিতা, সন্তানের মঙ্গলভাবনায় উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। নইলে এমন সংকটকালে দেশের প্রধানমন্ত্রী কী না তাদের দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন, তাদের আর্থিক সহায়তা পর্যন্ত দেয়ার ঘোষনা দিচ্ছেন। সত্যিকার অর্থেই ‘পরিবারের এল্ডারলি মেম্বার’ না হলে কি এটা সম্ভব!

৫. নাগরিকদের তিনি ধমক দিচ্ছেন না, নির্দেশ দিচ্ছেন না, হুমকি দিচ্ছেন না। তিনি তাদের ঘরে থাকার জন্য অনুপ্রাণিত করছেন। তিনি বলছেন,নিজেকে ঘরে রেখে তুমি শুধু তোমার সুস্থতাই নিশ্চিত করছো না, তোমার পরিবারের, তোমার চারপাশের মানুষগুলোর সুস্থতাই নিশ্চিত করছো না, স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের প্রযোজনের দিকে মনোযোগ দেয়ার সুযোগও করে দিচ্ছো। এটা একধরনের এডজাস্টমেন্ট আমাদের। তিনি পরামর্শ দিচ্ছেন, ঘরে থাকার, সোশ্যাল ডিসটেন্স এর মানে কিন্তু এই না যে কারো সাথে কথাবার্তাই হবে না। টেলিফোনটা হাতে তুলে না্ও, কথা বলো, ইমেইল করো।আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তিইতো হচ্ছে পরষ্পরের কাছে আসতে পারার ক্ষমতা, একে অপরের যত্ন নিতে পারার ক্ষমতা। দৈব দুর্বিপাকের সময় তো এটা আরো বেশি জরুরী। কাজেই তোমার বন্ধুদের ফোন করো, চেনাজানা মানুষদের ফোন করো। গ্রোসারী স্টোরে যাবার সময় তোমার প্রতিবেশির খোঁজ না্ও, দেখো তার কিচু লাগবে কী না। আর হ্যাঁ, তোমার নিজের জন্য প্রয়োজনের বেশি এখন কিনো না। আরেকটা কথা বলি, বিশেষ প্রয়োজনে যখনি বাইরে যা্ও ফ্রন্ট লাইনে কাজ করা কর্মীটির কাছে গিয়ে তাকে একটা ধন্যবাদ দাও । তুমুল এই সংকটের কালে দেশের ফ্রন্টলাইনের এই কর্মীরাই কিন্তু সমাজটাকে সচল রেখেছে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাও।
সৌজন্য নতুনদেশ , কানাডা

___________________

শ্ওগাত আলী সাগর

 

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়