Ameen Qudir

Published:
2020-03-10 17:58:45 BdST

কুইনাইন ম্যালেরিয়া সারাবে,কিন্তু সমাজ বাস্তবতার তিক্ত কুইনাইন সারাবে কে !


ডাঃ সুকুমার সুর রায় বাংলাদেশের একজন জ্যেষ্ঠ লোকসেবী চিকিৎসক ও চিন্তক। স্বাস্থ্য দপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মাধিকারীর গুরু দায়িত্বের পাশাপাশি বাংলাদেশের লোকসমাজ, চিকিৎসা সেক্টর, জনমানস - কোন কিছুই তার নজর এড়িয়ে যায় না। তারই প্রমাণ মিলল এই লেখায়। গভীর পর্যবেক্ষণ ও নির্মোহ নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বিশ্লেষণ করেছেন বিদ্যমান সঙ্কট ও নাজুক পরিস্থিতি।
ডাঃ সুকুমার সুর রায় এর মূল্যবান লেখাটি প্রকাশ হল।


কুইনাইন "

ডাঃ সুকুমার সুর রায় _________________________

সম্ভবত কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলির কোন এক লেখায় ছোটবেলায় পড়েছিলাম যে _ " কুইনাইন ম্যালেরিয়া সারাবে,কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে!? "

কুইনাইন ছিল ম্যালেরিয়ার অব্যর্থ ওষুধ। এবং কুইনাইন দিয়ে দ্রুত ম্যালেরিয়া নিরাময় হত ঠিকই, কিন্তু কুইনাইন ছিল এমনই তিক্ততায় ভরা যে, ম্যালেরিয়া ভালো হয়ে গেলেও কুইনাইনের তিতার কারনে অরুচি হয়ে রোগী যারপরনাই কাহিল হয়ে পড়তো।
আমাদের বর্তমান ভারতীয় উপমহাদেশীয় ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ঘৃনা এমন এক পর্যায়ে পৌছে গেছে যে, তা কুইনাইনের তিক্ততাকেও বহুগুনে ছাড়িয়ে গেছে।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তানের জন্ম হলেও আন্তর্জাতিক নানা উপাদান যেমন স্নায়ুযুদ্ধ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক উত্থান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মানবিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সবকিছু মিলে মানুষের মনের সুপ্ত ধর্মীয় ঘৃনাবোধ অনেক খানিই স্তিমিত হয়ে ছিল।
গত শতাব্দীর শেষের দিকে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের ফলে দুনিয়া একচেটিয়া পুঁজিবাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের খপ্পরে পড়ে যায়।
মানুষের মৌলিক মানবিকতা বোধ হারিয়ে যেতে থাকে।
মানুষের আদর্শের জায়গা খালি পড়ে থাকে না। দ্রুত এই খালি জায়গা পুরন হতে থাকে ধর্মীয় আবেগ অনুভূতি, বর্নবাদ, ফ্যাসিবাদের মত কালো অনুভূতির দ্বারা।
মানুষের সামনে আর কোন উজ্জল আদর্শ অবশিষ্ট থাকে না।
পুঁজিবাদের কড়াল ছোবলে যুব সমাজ রাতারাতি ভোগবাদী সমাজের মধ্যমনি হয়ে ওঠে, সে যেভাবেই হোক।
সমাজের এই পঁচনশীলতাকে উস্কে দেয় পুঁজিবাদের নানা অপসংস্কৃতি। ধর্মীয় গোঁড়ামি, বর্নবাদীতা, রাজনৈতিক ফ্যাসিস্ট শক্তি, তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার স্বার্থে যুব সমাজকে বিপথে পরিচালিত করতে থাকে।
সাম্রাজ্যবাদ তাদের স্বার্থে 'ডিভাইড এন্ড রুল,পলিসির প্রয়োগ ঘটায়।
আন্তর্জাতিক মুসলিম সমাজে পুর্বথেকে জেঁকে থাকা ঘোরতর শিয়া সুন্নি ও অন্যান্য বহুধা বিভক্ত ইসলামি সমাজকে কাজে লাগিয়ে অনৈক্যের টুকরা টুকরা খন্ডজালে আবদ্ধ করে রাখে।
নিজেদের স্বার্থেই গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার, বুরহানুদ্দিন রাব্বানী, ওসামা বিন লাদেন দের তৈরি করতে থাকে এবং প্রয়োজন শেষে ক্ষত বিক্ষত লাশ সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ করতে থাকে।
ভাঙা সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মা-ও সে তুং এর গনচীন দ্রুত সংশোধনবাদি চরিত্রের খোলসে পুঁজিবাদী সমাজে রুপ নেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপ দ্রুত গনতন্ত্রের ভরঙে ন্যাটোর মুরুব্বিয়ানায়
পুঁজিবাদের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।
ইউরোপ আমেরিকায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে মানবতাহীন একচেটিয়া পুঁজির আবির্ভাব ঘটে।
এঙ্গেলা মার্কেল, ম্যাঁখো, বরিস জনসন, পাগল ট্রাম্পদের মত উগ্রজাতীয়তাবাদী ও বর্নবাদী রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্তরা ক্ষমতা দখল করে নেয়।
ভারতের বহু বছরের ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি কে কবর দিয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদের নির্লজ্জ উত্থান ঘটে।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া আশেপাশের দেশগুলি এই সুযোগে দ্রত অন্ধকারে হারিয়ে যেতে থাকে।
হাজার বছরের উজ্জল মানবতাবাদী চরিত্র হারাতে হারাতে এখন আমরা ঘোর অমাবস্যার অন্ধকারে ডুবে গেছি।

হিন্দুত্ববাদের ধ্বজাধারীরা ধর্মের জিগির তুলে রাস্ট্র ক্ষমতা দখল করে ফেলেছে। তারা পবিত্র মসজিদ গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের অন্তরে এমনই ধর্মীয় দরদের উদয় হয়েছে যে, তারা প্রতিবেশী দেশগুলির অমুসলিমদের সাদরে বরন করে নেওয়ার জন্য ভোট কেন্দ্রের বাইরে যেমন ভোটার লিষ্টের অভ্যর্থনা কেন্দ্র খোলা হয় ; তেমনি অভ্যর্থনার দোকান খুলে বসে আছে।

গোমুত্র, গোবর, গোমাতার সংস্কৃতিকে তারা মহান শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
সম্প্রতি যখন গোটা বিশ্বে করোনাভাইরাস প্যানডেমিক আকারে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনকে প্রায় লণ্ডভণ্ড করে ফেলেছে, যখন দরকার ছিল সকল বিজ্ঞানী, সমাজকর্মী, মানবতাবাদীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়কে মোকাবিলা করা, তখন আমরা হতভম্বের মত দেখতে পাই যে, পার্শ্ববর্তী দুই দেশের ধর্মের ধ্বজাধারীরা গোমুত্র সেবন, গোবর-গঙ্গাজল স্নান, আরো বহুবিধ পশ্চাদগামী ব্যবস্থাপত্র দিয়ে করোনাভাইরাসের নিদান দিচ্ছেন। সরকার, সমাজ, সবাই একদম নিশ্চুপ হয়ে তামাশা দেখছেন।
একইরকম ভাবে করনাভাইরাস সংক্রান্ত আমাদের এদেশীয় ভাই বেরাদরদের কর্মকান্ড ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যানে একেবারে কম উপভোগ করার মত নয়।
প্রথমেই বলা হল _ চীনারা সাপ ব্যাঙ সহ সকল হারাম খাবার খায় তাই তাদের জন্য এটা শাস্তি। ( যদিও মধ্যপ্রাচ্যের মার্স ভাইরাসের কথা সুকৌশলে চেপে যাওয়া হল।
দ্বিতীয়ত বলা হল _ চিনারা উইঘুর মুসলিমদের উপরে যে অবর্ননীয় নির্যাতন চালাচ্ছে এটা হচ্ছে আল্লাহর তরফ থেকে চীনাদের উপরে ' গজব'।
তৃতীয়ত বলা হল _ এটা কোরিয়া, জাপান, ইউরোপ আমেরিকায় আঘাত হানতে পারে যেহেতু তারা সীমা লঙ্ঘন করেছে, কিন্তু কোন মুসলিম দেশে এটা আঘাত করবে না - আল্লাহর রহমতে।
চতুর্থত বলা হল মধ্যপ্রাচ্যে এলেও শিয়া ছাড়া সুন্নিদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আমরা দেখে ফেললাম ওমরা হজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ( এটিই আসলে সঠিক বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ) ।
এখন আমরা প্রতিনিয়ত ভাইরাল হওয়া কাঠমোল্লাদের মুখে করননাভাইরাস ঠেকানোর নিত্যনতুন ফর্মুলার কথা শুনতে পাচ্ছি। করনাভাইরাসের সাথে সাক্ষাৎকার ও তাদের বিস্তারিত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও অনুপুঙ্খ জানতে পারছি।
দুঃখের বিষয় হল যে, এসব ব্যাপারে রাস্ট্রের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না।
আরো ভয়ংকর দুঃখের বিষয় হল এই যে, এই কথাগুলি শুধু কাঠমোল্লারা বিশ্বাস করে তা নয়, দেশের জ্ঞানী গুনি পিএইচডি ধারীরাও বিশ্বাস করে।
এই রকম একজন পিএইচডি ধারীর পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তিনি আমাকে আনফ্রেন্ড করেছেন, আমি নিজেও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি।
কথা হল, অনেক অনেক ক্ষতি হলেও এক সময় করনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ হয়ে যাবে। কিন্তু মানুষের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও চিন্তার জগতে যে ইতিমধ্যেই অপুরনীয় ক্ষতি হয়ে গেছে এবং আরো হয়ে যাবে তার নিরসন কোন ভাবেই কি পুরন হতে পারবে!?
ম্যালেরিয়া সারলেও কুইনাইনের কি হবে!?!?!?
লিঙ্ক : 
https://www.facebook.com/1558098515/posts/10221580799220155/

 

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়