Ameen Qudir

Published:
2019-03-20 08:45:46 BdST

খ্রিস্টান মিরিয়ামকে বিয়ে করতে আকবরের ধর্মান্তর : হুইলার থেকে জানাচ্ছেন চিকিৎসক


মিরিয়াম । টিভি ধারাবাহিকে এমন চেহারায় দেখা মেলে। ছবি টিভি সিরিয়াল থেকে নেয়া।

 


অধ্যাপক ডা. অনির্বাণ বিশ্বাস
___________________________

আকবর বাদশার বিয়ের বাতিক ছিল। তার বউয়ের সংখ্যা কোন বইয়ে ৩৬ কোন বইয়ে ৩০০ দেখতে পাই। বউ ছাড়াও হারেমে ইয়ে করার জন্য দুনিয়া চষে হাজার পাঁচেক মেয়ে মজুত ছিল তার। মিরিয়াম ছিলেন আকবরের খ্রিস্টান বউ। এই একবারই আকবর ধর্মান্তরের গাড্ডায় পড়েছিলেন।
( লেখাটি জেমস হুইলার এর “Tales from Indian history” হতে ভাবানুবাদ )
…................................................
মুখবন্ধঃ
আকবর শৈশবে মুসলিম ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে একটি ধর্মই পালন করে গেছেন - সেটি ক্ষমতা। আকবরের বহু জাতি-ধর্মের নারী বিবাহ করার পেছনে রিরংসা প্রথম কারণ হলেও দ্বিতীয় কারণটি রাজনীতি। এভাবে নানা গোত্র-জাতি-ধর্মের শক্তিদেরকে তিনি নিজের পক্ষে টানার চেষ্টা করেছেন বা নিজের বিপক্ষে যাওয়া ঠেকিয়েছেন। এই পদ্ধতি সব সময় কাজে দিয়েছে এমনটা নয়; তবু আকবর এমনটা করে গেছেন। মিশরের ফেরাউনের (দ্বিতীয় রামেসিস) প্রধান মন্ত্রণাদাতার নাম ছিল হামান; আর আকবরের প্রধান মন্ত্রনাদাতার নাম হচ্ছে আবুল ফজল। হামানের কার্যকলাপের সাথে তার মিল ব্যাপক। আকবরকে ঈশ্বর বানানোর পরিকল্পনাও তারই।


মিরিয়াম। ইতিহাস পুস্তকে যেমনটি চিত্রিত।

মুল অংশঃ
আইন ই আকবরীর রচয়িতা মোগলাই মন্ত্রী আবুল ফজল বাদশা আকবরকে ইসলামের উপর বীতশ্রদ্ধ করে তোলেন। তিনিও স্থানীয় ধর্মীয় আলেমউলামাদের ক্ষমতায় রুষ্ট হন, আর আবুল ফজলের সাথে যুক্তি করতে থাকেন ইসলাম ধর্মের পোপ জাতীয় কিছু হওয়া যায় কিনা।(তখনও দ্বীন-ই-ইলাহী'র ধারনা তার আসেনি)

এই সময় তিনি খ্রিস্টধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন, মিরিয়াম বা মেরী নামে এক খ্রিস্টান মেয়ে বিয়ে করেন তিনি। মিরিয়ামের জন্য প্রাসাদ গড়া হয়, ফতেপুরে, ঐ প্রাসাদ আজও আছে। গোয়ার পর্তুগীজ যাজকদের তিনি আমন্ত্রন করে আনেন, ফতেপুর প্রাসাদের ভেতরে একটি ক্যাথলিক গীর্জা গঠনের অনুমতিও দেয়া হয়। রাস্তাঘাটে ক্রুশ ঝুলিয়ে ঘোরার স্বাধীনতা পায় তারা, ইচ্ছেমত ধর্মপ্রচারেও নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হয়।

ঠিক কোন কারনে আকবর মিরিয়ামের বিবাহ ঘটে তা ঠিক করে জানা যায়না। মিরিয়াম সম্ভবত গোয়ায় শিক্ষিত পর্তুগীজ রমণী, তার মনে হয়তো আশা ছিল মহান মোগল বাদশাকে ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করবেন। গোয়ার ধর্মযাজকের দল মিরিয়ামকে ব্যবহার করে আকবরকে কনভার্ট করতে চেয়েছিল সেটাও হতে পারে, মিরিয়াম হয়তো দাবার বড়ে ছাড়া কিছুই ছিলনা।

ছোট্ট দ্বীপ গোয়া ভারতের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত, ঐসময় মোগল ভারতের নাগালের বাইরে।পোর্তুগীজ শাসনাধীন।

গোয়ার পর্তুগীজরা ছিল চরম নাক উঁচু। ধর্মযাজক ছাড়া সব পুরুষ লোকে তলোয়ার নিয়ে ঘুরত, আর দাবী করতো তারা বিরাট বংশের মানুষ। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় তারা মাথার টুপি উঁচিয়ে ধরত, কেউ এর উত্তরে টুপি না তুললে তাদের একদম ইজ্জত যেত আর তলোয়ার উঁচিয়ে মারতে যেত তাকে। প্রত্যেকে দাস নিয়ে ঘুরতো, এমনকি নগণ্য সৈনিকের পেছনেও ছাতি মাথায় ঘুরঘুর করতো দাস।

গোয়ার বড়বড় জাহাজ, কামান, প্রাচীর, দূর্গ এইসবের কথা আকবরের কানে গিয়েছিল। কিছু ইয়োরোপীয়দের তিনি নিযুক্ত করেছিলেন বন্দুক তৈরির কাজে। এদের শারিরীক গঠন, কর্মচাঞ্চল্য, সততা আর সাহসের বেজায় ভক্ত ছিলেন বাদশা। এদের মদ খাওয়ার বহর দেখে তার বিস্ময়ের অবধি ছিলনা, ভারতীয়দের মত মদ খেয়ে টাল হওয়ার বদলে মদ খেয়ে আরও এনার্জি পাওয়ার ব্যাপারটি তিনি ধরতে পারেননি। সাদা মানুষের উপর চরম ইমপ্রেসড আকবর ঠিক করলেন এদের কোন মেয়েকে বিয়ে করতে হবে !কোথা থেকে মিরিয়াম বলে একটি মেয়েকে তিনি ধরে আনলেন, কে ,এই মিরিয়াম ঠিক বলা যায়না, হয়তো তার অধীনে কাজ করা কোন ইয়োরোপীয়দের মেয়েই হবে।

আকবরের ঘরভর্তি তখন মুসলমান আর রাজপুত বউ, খ্রিস্টান সাদা মেয়ের ওইখানে ঢোকার যন্ত্রনা কম নয়। তবু মিরিয়াম জানত কোনভাবে যদি হিদেন আকবরকে খ্রিস্টান করে দেশটাকে পোপের অধীনে আনা যায় তাহলে তাকে চার্চ সেইন্ট ফেইন্ট ঘোষনা করে দেবে। তাছাড়া আকবর বাদশা দেখেও মিরিয়াম তার প্রেমে পড়েছিল। বিয়ে ঠিক হবার পরে গোয়ার ভাইসরয়কে আকবর পাদ্রী পাঠানোর অনুরোধ করে চিঠি পাঠান। এই চিঠির পেছনে মিরিয়ামের হাত আছে বলে শোনা যায়। চিঠি পেয়ে গোয়ার পাদ্রীসমাজে মিষ্টি,মদ বিলানো শুরু হয়, দ্বীপের প্রত্যেক পাদ্রী হাঁটুগেড়ে পাইকারী প্রার্থনা শুরু করে দেয় যেন ঈশ্বরের কৃপায় আকবরকে ধর্মান্তরিত করতে তাকে পাঠানো হয়।

তিনটে পাদ্রী অবশেষে যাত্রা করে হিন্দুস্তানের উদ্দেশ্যে, যাবার পর আকবর তাদের কোলে তুলে নেন। গোয়ার ভাইসরয়ের দেয়া উপহার মহান বাইবেল আকবরের হাতে তুলে দেয়ার সময় তাদের হাত কাঁপতে থাকে, মুসলমান বাদশা রেগে তাদের মুন্ডু কেটে না সেই বাইবেলের সাথে সেলাই করে দেয় সেই ভয়ে তারা অস্থির ছিল। তারা অবাক হয়ে দেখল বাদশা শ্রদ্ধাভরে বই মাথায় ঠেকালেন। এরপরে পাদ্রীদের ঝোলা থেকে বেরুলো মহান যীশু আর মাতা মেরীর ছবি, যা মুসলমানেরা প্রতিমা জ্ঞানে ঘৃণা করতো। আকবর কিন্তু ছবিগুলোয় চুমো খেলেন। মিরিয়াম আগে থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে রেখেছিলেন নিশ্চই আকবরকে, নইলে এরকম শ্রদ্ধা দেখানোর নিয়ম তার জানার কথা না।

পাদ্রীদের অনেকদিন ধারনা ছিল আকবরকে খ্রিস্টান বানানোর কাজ কমপ্লিট। একবার সারারাত বাদশা তাদের সাথে খ্রিস্টধর্ম নিয়ে ব্যাপক বকবক করেছিলেন, যীশুর জীবন ও মথি লিখিত সুসমাচার নিয়ে বিরাট ক্যাচাল চলে ঐ রাত। প্রাসাদের সেরা কক্ষে তাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়। প্রাসাদের অভ্যন্তরে যে গীর্জা গড়ার অনুমতি দেন তিনি শুধু তাই নয়, তিনি নিজেও মাঝে মাঝে গীর্জার ভেতরে যীশুর মূর্তির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করতেন। প্রিয় জ্ঞানী মন্ত্রী আবুল ফজলকে তিনি হুকুম দেন বাইবেল ফার্সীতে অনুবাদ করার।

দুচারদিনের জন্য আকবর হয়তো খ্রিস্টান হয়েছিলেন , কিন্তু তাকে ব্যাপ্টাইজ করা হয়নি। নারীঘটিত সমস্যা ছিল। তার মা বাদশা হুমায়ূনের বউ চরম ধর্মভীরু মুসলমান ছিলেন, এছাড়া মিরিয়াম ছাড়া তার অন্যান্য বউগুলিও বেঁকে বসে। তখনকার দিনে খ্রিস্টধর্ম পালন করা ছিল ফ্যাশনেবল ব্যাপার, আকবরের অগুণতি ছেলের একটিকে খ্রিস্টান শিক্ষায় পাঠানো হয়। এমনকি মন্ত্রী ফজল সাহেব খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন। অবশ্য ফজল সাহেবের মন্দির মসজিদ দেখলেই ঢুকে পড়ার প্রাচীন স্বভাব ছিল, যেকোন ধর্মের ঈশ্বরের কাছে তিনি প্রার্থনা করতেন। মনে হয় শিওর ছিলেননা কোনটা কাজের ভগবান, তাই সবাইকেই খুশী রাখতেন।

তবে দিন গড়ানোর সাথে সাথে আকবরের খ্রিস্টধর্ম হতে মন উঠে যায়, মিরিয়ামের মোহও ততদিনে শেষ। তিনি আর ফজল মিলে নতুন ভাবতে বসেন, প্রচলিত ধর্মের নবীরাসূল না হয়ে নতুন ধর্ম বানিয়ে তার অবতার হলে কেমন হয়! মুসলমানরা মুহম্মদ বা খ্রিস্টানরা যীশুকে যে সম্মান দেয় সেই সম্মান পাওয়ার আশা করতে থাকেন তিনি। হিন্দু রাজপুত বউ সমূহ আর ফজল তাকে বোঝায় তিনি সূর্যের অবতার বিষ্ণু। হিন্দুস্তানের সম্রাট তখন দৈনিক কাকভোরে উঠে প্রকাশ্যে জানালা খুলে সূর্যের পূজো করা শুরু করেন, আর নিচে জনতা চেঁচাতে থাকে যে তিনি সূর্যের রশ্মির মতই বলবান। ঠিক রোমান সীজারের মত তিনি আকাশের দেবতা হতে চেয়েছিলেন।

১৬০৫ সালে তেষট্টি বছর বয়সে আকবর মারা যান। আগ্রা থেকে মাইল চারেক দূরে সেকান্দ্রার বাগানে তাকে কবর দেয়া হয়। কবরের চারপাশে ক্রুশ বসানো হয়, কিন্তু তা কি মিরিয়ামের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নাকি তার খ্রিস্টান বিশ্বাসের সম্মানে সেই রহস্য কখনো ভেদ করা সম্ভব হয়নি।

পুনশ্চঃ
আওরঙ্গজেব আকবর আর জাহাঙ্গীর, দুইজনকেই কাফের জ্ঞানে ঘৃণা করতেন। আকবরের মৃত্যুর একানব্বই (বা তিরানব্বই, মনে নেই ঠিক) বছর পর তার কবর রেড করে মুসলমানেরা,আওরঙ্গজেবের আদেশে। আকবরের হাড় কবর থেকে তুলে হিন্দুদের মতো পুড়িয়ে ফেলা হয়। ক্রুশ যদি থেকেও থাকে, সেই রেডের হাত থেকে সেগুলো রক্ষা পাওয়ার কথা না।( এই ঘটনা আমি পড়েছি)

____________________________

অধ্যাপক ডা. অনির্বাণ বিশ্বাস । কবি , শুভ চিন্তক।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়