Ameen Qudir

Published:
2018-10-29 17:59:00 BdST

"এই রুগী বেঁচে কি করবে? এই রুগী আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে "


 

 

ডা. জোবায়ের আহমেদ
_____________________________

মায়াজালের দহনঃ

এই রুগী মরে যাক,এটা আমি চাই।এই রুগী বেঁচে কি করবে?? এই রুগী আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে।
কথা গুলো চাচা বল্লেন শান্তভাবে।
আমি ও নাবিলা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি চাচার মুখের দিকে।
আমি বল্লাম,চাচা আপনি চাচী কে ভালবাসেন না? একটু ও মায়া করেন না?
চাচীর দুই বছর আগে ডান স্তনে ডাক্টাল সেল কারসিনোমা ডায়াগনোসিস হয়,তারপর মাস্টেক্টমি অপারেশন ও এক সাইকেল কেমোথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা বন্ধ করে দিলেন।
তারপর ক্যান্সার এর জন্য আর চিকিৎসা নিতে হয়নি।
মাঝে ব্যাকপেইন এর জন্য আমার কাছে একবার চিকিৎসা নিয়েছিলেন।
আমি চাচাকে আবার প্রশ্ন করলাম, চাচা আপনি কি সত্যি চান যে, চাচী মরে যাক।
চাচা আবারো বল্লেন, জ্বি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,আপনাদের ছেলেমেয়ে কয়জন?
বল্লেন ৪ জন।বিয়ে কয়েছেন কত বছর হল?
বল্লেন ৩১ বছর।
১৬ বছর এর কিশোরী মেয়েটি ৩১ বছর আগে দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে সংসার নামক সাগরে ভেলায় ভেসেছিলেন।এই সংসার এর প্রতিটি বালুকণায় মিশে আছে সেই নারীর আবেগপূর্ণ ভালবাসা ও মায়া।
যার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে পাওয়া না-পাওয়ার হিসেব না কষেই শুধু দিয়ে গেলেন মায়াভরা ভালবাসা, সেই মানুষ টি আজ তার মৃত্যু চাচ্ছে।।

আমি ভাবছি, চাচীর কথা।
তিনি যদি আজ নিজ কানে এই কথাটা শুনতেন, তাহলে কতটা তীব্র যন্ত্রনায় ক্ষতবিক্ষত হত তাঁহার হৃদয়।।কি সংসারে ভেলা ভাসিয়েছিলেন?
এটা কি মানুষের না পোকামাকড় এর সংসার।

আশিতীপর বৃদ্ধ হাজী কামাল উদ্দিন উনার স্ত্রী রাবেয়া বেগম কে নিয়ে গত চার বছর ধরে চিকিৎসা নিয়েছেন আমার মেডিকেয়ার সেন্টার থেকে।। উনার সাথে আমার সম্পর্ক ডাক্তার রুগীর সম্পর্ক থেকে মা ও ছেলের সম্পর্কে রুপ নিয়েছিল। কিছুদিন আগে রাবেয়া বেগম ইন্তেকাল করেন।আমাদের বকেয়া টাকা দিতে এসে হাজী সাহেব আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলেন কিছুক্ষণ।। বল্লেন, বাবা আপনার মা আমাকে একা ফেলে চলে গেছে।।হাজী সাহেবের গড়িয়ে পড়া প্রতিটি অশ্রুকণাতে আমি দেখেছি স্ত্রীর প্রতি তীব্র মায়া ও গভীর ভালবাসা।। রাবেয়া বেগম অনেক রোগে ভুগতেন। প্রায়শই উনাকে ভর্তি করে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
হাজী সাহেব কে দেখেছি সারা রাত উনার স্ত্রীর হাত ধরে বসে থাকতেন।একদিন গভীর রাতে ফলোয়াপ দিতে গিয়ে দেখি এই বৃদ্ধ উনার ঘুমন্ত প্রিয়তমা স্ত্রীর কপালে চুমু দিচ্ছেন,দৃশ্যটি দেখে আমার চোখ ভিজে উঠেছিল।
হাজী সাহেব এর চার ছেলে এক মেয়ে ছিল।
প্রতিবার ই একমাত্র মেয়ে মায়ের সেবার জন্য সাথে আসতেন।
ছেলের বউ দের দেখলাম না একদিন ও রাত জেগে শাশুড়ির সেবা করতে।
একটা সময় এই মায়ার সংসারে হাজী কামাল ও রাবেয়া বেগম অবহেলা, অনাদর পেতে শুরু করলেন।
ছেলেরা নিজেদের ফ্যামিলি নিয়ে ব্যস্ত।বউ রা এসে সংসারের চাবিটা দখলে নিল,নিজের সংসারে রাবেয়া বেগম পর হয়ে গেলেন।
বাবা মা এর খবর নেওয়ার মত ফুরসত কই ছেলেদের।?
মেয়ে স্বামীর সংসার থেকে এসে এসে বাবা মা এর সেবা করত।
হাজী সাহেব একদিন অশ্রুভেজা চোখে আমাকে জানিয়েছিলেন উনাদের অসহায়ত্বের কথা।
একবার হাজী সাহেবের বড় ছেলের বউ উনার একমাত্র ছেলেকে নিতে আসলেন আমার চেম্বারে।
বাচ্চাটির ফেব্রাইল কনভালশান হয়েছিল,ছোট্ট বাবুটির খিচুনি দেখে মা পাগলপারা অবস্থা।।
বাচ্চাটি যখন সুস্থ হয়ে বাড়ি যাবে,আমি চেম্বারে ডাকালাম হাজী সাহেবের সেই ছেলের বউ কে।
বল্লাম আপনি কত আদর ও যত্নে আপনার ছেলেটিকে বড় করছেন দেখে ভাল লাগল।
তিনি বল্লেন, আমার ছেলে আমার প্রাণ। আমার আব্বুটা বলেই গালে চুমু খেলেন বাচ্চাটির।
তখন আমি বল্লাম,আপনার স্বামীও আপনার শাশুড়ির প্রাণ ছিল।তিনিও এমন মায়া ও যত্ন দিয়েই উনার সন্তান দের লালন পালন করেছেন।
আপনি যদি চান আপনার ছেলের বউ একদিন আপনার সেবা করুক,কিছু মায়া আপনাকে বিলিয়ে দিক,তাহলে আপনি এখন থেকে কিছু মায়া আপনার শাশুড়ি কে বিলিয়ে দিন।।

একজন চিকিৎসক শুধু রুগীর চিকিৎসাই দিয়ে যান না,
তিনি দেখার মত চোখ থাকলে জীবন কে দেখতে পারেন। আমি মাঝে মাঝে সেই জীবন দেখি।
প্রিয়জন এর প্রতি ভালবাসা দেখি।
প্রচন্ড দায়িত্ববোধ দেখি,মায়া দেখি।।
আবার ভালবাসার মানুষ এর প্রতি অবহেলা ও তুচ্ছজ্ঞান দেখি।।
সুরাইয়া আপা ডাকি আমরা উনাকে। পরতেঙ্গা বিবির ছেলের বউ,যিনি আমার আরেক মা এর মত ছিলেন। একজন আদর্শ ছেলের বউ।নাবিলা প্রথম দিকে বুঝতেই পারেনি যে সুরাইয়া আপা পরতেঙ্গা বিবির ছেলের বউ।সে মনে করত সুরাইয়া আপা পরতেঙ্গা বিবির মেয়ে।।
যার কাছে শাশুড়ি মা এর সমান।বলা যায় মা এর থেকেও বেশি কেউ।নিজের ছোট্ট বাচ্চাদের একা বাড়িতে রেখে দিনের পর দিন ক্লিনিকে সেবা ও মায়া বিলিয়েছেন শাশুড়ি কে।

একদিন দুপুরবেলা ফলোয়াপ দিতে গিয়ে দেখি বউ শাশুড়ির চুলে চিরুনি করছে।অতি নগন্য দৃশ্য কিন্ত মায়াময়। শাশুড়ি কে নাকে নল দিয়ে খাওয়ানোর জন্য NG TUBE করার ব্যাথাটা মনে হয় তীব্রভাবে ছেলের বউ এর লাগল।
বউ ও শাশুড়ি একে অন্যর চোখের দিকে তাকিয়েই হৃদয় এর গভীরের অব্যক্ত বেদনা বুঝে যেতেন।
কি স্বর্গীয় সেই সম্পর্ক।।
আহ পৃথিবীর সব বউ যদি সুরাইয়া আপার মত হত,তাহলে একজন শাশুড়ি কেও আর বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হত না।।।
পরতেঙ্গা বিবিকে একবার দুই ব্যাগ রক্ত দিতে হল।
রক্ত দিতে যিনি ছুটে এসেছেন তিনি উনার আরেক ছেলের বউ কোহিন ভাবি । পেশায় শিক্ষিকা কোহিন ভাবি নিজের রক্ত দিলেন শাশুড়ির জন্য।
অভূতপূর্ব সেই দৃশ্য যা আজো দাগ কেটে আছে আমার অন্তরে।।

ব্যবহার করা কপালের টিপটার আঠা নষ্ট হলেও মেয়েরা সেটা যত্ন করে রেখে দেয়।এক জোড়া কানের দুলের একটা হারিয়ে গেলেও অন্যটা ফেলে না।পুরাতন শাড়িটা,ভাঙা চুড়িটা,নষ্ট হয়ে যাওয়া মোবাইল টা কাজে লাগবেনা জেনেও তুলে রাখে,সব কিছুর কারণ হল মায়া।
মেয়েরা মায়ার টানে ফেলনা জিনিসও ফেলে না।

এই জন্যই মেয়েরা মায়াবতী। আর মায়াবতীর কোন পুরুষবাচক শব্দ নেই।।

সেই মায়াবী মায়াবতী নারী যখন অন্য নারীর দুঃখের কারণ, সুখ কেড়ে নেওয়ার কারণ তখন চরম হতাশায় বিষাদে ভরে যায় মন।

_____________________________

ডা. জোবায়ের আহমেদ। সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়