Ameen Qudir

Published:
2018-05-30 17:04:09 BdST

সত্যি মিথ্যা কিংবা মিথ্যা সত্যি


 

ডা. মোঃ বেলায়েত হোসেন
__________________________

"জানো জান্নাত,আমি কিন্তু তোমাকে এখন আর ভালোবাসি না।"
জান্নাতের হাত আমার হাতের ভেতর ধরা।আজ জান্নাতের জন্মদিন।জান্নাত,আমার প্রেমিকা।আজ ওর তেইশতম জন্মদিন,আমাদের তৃতীয় প্রেম বার্ষিকী।আজ থেকে তিন বছর আগে ঠিক রাত বারোটা এক মিনিটে ওকে ফোন করে "এতোটা ভালোবাসি" গানটা শুনিয়ে প্রপোজ করেছিলাম।খুব বেশি সময় নেয়নি,প্রপোজ করার এক ঘন্টার মধ্যেই আমার প্রস্তাবে সায় জানিয়েছিলো জান্নাত।সেই থেকে পথচলা শুরু,আজ তিনবছরের মাইলফলক পেরুলো।

জান্নাত আমার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে।
'উফ,তুমি কি যে বলো না।তুমি কবে স্বাভাবিক হবা বলো তো?আমার জন্মদিনটাকে এভাবে নষ্ট না করলে তোমার চলছে না,না?অন্তত আজকের দিনটা মাফ করো,তোমার এই স্বভাবসুলভ বিশ্রী রসিকতাগুলো বন্ধ করো প্লিজ।'
বলে ঢাউস ব্যাগটা থেকে একটা ছোট্ট টিফিন কেরিয়ার বের করলো।
খুলতে খুলতে বললো,
'আর কোন কথা না।প্লেটটা পরিষ্কার করে দাও তো।আর এক গ্লাস পানি ঢালো।আজ তোমার সব পছন্দের আইটেম রান্না করে এনেছি।'

এই হচ্ছে জান্নাত।প্রচণ্ড মায়াময় একটা মেয়ে।অথচ কে বলবে গতকাল রাতেও আমাদের প্রচণ্ড ঝগড়া হয়েছে,যার শেষটা হয়েছিলো আমার "আমি তোকে খুন করবো দেখিস নিজ হাতে" আর ওর 'তোর খাবারে আমি বিষ মেশাবো একদিন মনে রাখিস' দিয়ে।আর এখন সে আমার জন্য খাবার বের করছে টিফিন কেরিয়ার থেকে।নিশ্চয়ই সকাল থেকে রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় কেটেছে ওর,আর সাথে আন্টিকে দিতে হয়েছে হাজারটা কৈফিয়ত।

আসলে গত তিনটা বছর এভাবেই ওর জন্মদিন আর আমাদের প্রেমের বর্ষপূর্তি আমরা পালন করে আসছি।আমরা একসাথে লাঞ্চ করি,আমি ওর জন্য একটা নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করি একটা কেক আর কয়েকটা মোমবাতি নিয়ে,আর ও নিয়ে আসে আমার জন্য নিজের হাতে রান্না করে।

আজকেও এভাবেই আমাদের দুপুরটা শুরু হয়েছে,একটা কেবিনের মতো একটা ঘেরা জায়গায় বসেছি আমরা দুজন,যেখান থেকে কেউ আমাদের না দেখবে,না আমাদের কথা শুনবে।শুধু ওয়েটারের হাতে একশ টাকার দুটো নোট গুজে দিয়েছিলাম,বাকিটা সে ই ব্যবস্থা করে দিয়েছে।সেই বদ্ধ কোণায় আমরা একসাথে কেক কেটেছি,চোখে চোখ রেখে প্রেমময় দৃষ্টি বিনিময় করেছি।কে বলবে গতকাল এতো রাগ আর ঘৃণা জমেছিলো দুজনের মনে?

ও আমাকে বরাবরের মতো মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছিলো।কিছু গান সিলেক্ট করে দিয়েছিলাম ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে বাজানোর জন্য।সেগুলোই চলছে,সাথে আমাদের সময়গুলোও কেটে যাচ্ছে পাল্লা দিয়ে।

এক ঢোক পানি খেয়ে বলতে শুরু করলাম আমি আবার,
"শুধু যে তোমাকে ভালবাসতে ভুলে গেছি তা কিন্তু না জান্নাত,এখন সেখানে জায়গা করে নিয়েছে প্রচণ্ড ঘৃণা।এখন তোমার কথা মনে পড়লেও আমার রাগ হতে থাকে।তোমার ফোন আসলে আমার মাথার ভেতর অসহ্যরকম যন্ত্রণা হতে থাকে।তোমার সাথে যখন হাসিমুখে কথা বলি,তখন ভেতরে ভেতরে তোমাকে যে কতো অসংখ্যবার বকা দিই আমি,জানো জান্নাত?"

আমার কথায় জান্নাতের ভাবান্তর হয় না।হবার কথাও না,কারণ সে ভেবেই নিয়েছে কথাগুলো নিতান্তই মজা করে বলছি আমি।শুধু একবার মুখ তুলে তাকিয়ে বললো,
'দেখো ফারহান,এই সব ফালতু রসিকতা তুমি যদি আর একবার করো,আমি কিন্তু চলে যাবো।সেটাই কি চাচ্ছো তুমি?'
আমি মৃদু হেসে আমার ওর হাতটা আমার হাতে তুলে নিই।হালকা চাপ দিয়ে আবার বলতে শুরু করি,
"আচ্ছা,আর বেশিক্ষণ বলবো না।শুধু তোমাকে একটা ধন্যবাদ জানাতে চাই।কাল যে তুমি আমার খাবারে বিষ মেশাতে চেয়েছিলে,সে জন্য।তোমার কথাটা শুনেই আমার মাথায় আইডিয়াটা এলো।এই যে কেকটা একটু আগে খেলে,তোমাকে যে অংশ থেকে কেটে খাইয়েছি আমি,ওটুকুতে বিষ মেশানো ছিলো।তুমি আসার আগে আমি নিজের হাতে খুব যত্ন করে বিষটুকু মিশিয়েছি।তুমি যখিন খাচ্ছিলে,আমি কতো আগ্রহ নিয়ে সে দৃশ্য দেখছিলাম,তুমি খেয়াল করেছো?"

জান্নাত আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইলো।অবিশ্বাস আর সন্দেহ এখন তার চোখে মুখে।বিশ্বাস করতে পারছে না,আবার অবিশ্বাসও না।
'তাহলে তুমি যে আমাকে সকাল থেকে,কেক কাটার আগে যতো ভালোবাসার কথা বলেছো সব মিথ্যে ছিলো?অসম্ভব,অসম্ভব ফারহান,আমি বিশ্বাস করি না তোমার বলা সেই কথাগুলো মিথ্যে ছিলো।তুমি এখন যা বলছো এসব কিছু মিথ্যে,তাই না?আমার জন্য নিশ্চয়ই কোন সারপ্রাইজ রেখেছো তুমি,তাই এসব বলে আমাকে ভয় দেখাচ্ছো,তাই না?'

আমার এবার রীতিমতো মায়া হতে শুরু করলো মেয়েটার জন্য।আহারে,এতো করে বলেও বোঝাতে পারছি না যে আমি সত্যি ওর খাবারে বিষ মিশিয়েছি।
মেয়েটা আস্তে আস্তে ঘামতে শুরু করেছে।চোখের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস আর বিশ্বাসভঙ্গের কষ্ট এসে জায়গা করে নিচ্ছে,আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।গলা চেপে ধরে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো আমাকে,কিন্তু আওয়াজ বের হলো না।স্বাভাবিক,আওয়াজ বের হবার কথাও না।ঝট করে এবার মাথাটা টেবিলে পড়ে গেলো জান্নাতের।বাহ,বিষ তো বেশ ভালোই দ্রুত কাজ করলো।এবার আমার কাজ শেষ,এখন জলদি আমাকে এখান থেকে বের হতে হবে।একটা কিছু কেনার অজুহাত দিয়ে বেরিয়ে যাবো আমি রেস্টুরেন্ট থেকে,কেউ সন্দেহ করবে না।হঠাৎ মাথা তুলে তাকালো আমার দিকে জান্নাত।টেবিলটা খামচে ধরে কি যেন বলতে চাইলো।চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে,মুখ দিয়ে রক্ত মেশানো লালা বের হচ্ছে।"সময় প্রায় শেষ প্রিয়তমা,আর অল্প একটুক্ষণ অপেক্ষা করো সোনা কষ্ট করে" ভাবছিলাম আমি আর ঠিক তখনই দেখলাম জান্নাতের মুখে একটা অদ্ভুত রকমের হাসি ফুটে উঠলো।তারপর আর একবার মাথাটা পড়ে গেলো টেবিলে।একেবারে নিথর হয়ে পড়ে রইলো এবার।

আমি রাস্তায়।পকেটে হাত ঢুকিয়ে শিস বাজিয়ে হিন্দি একটা গানের সুর তোলার চেষ্টা করছি।প্রায় হয়ে হয়েও হচ্ছে না।জান্নাতের কথা মনে পড়ছে বারবার।মেয়েটা কেমন বোকা!যখন মিথ্যে কথাগুলো বললাম,কি সুন্দর বিশ্বাস করে বসে রইলো।আর যখন সত্যি কথাগুলো বললাম,কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইলো না।মানুষগুলো এমন বোকা হয় কেমন করে কে জানে?অবশ্য বিশ্বাস করেছে,কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
আচ্ছা,ও কি বলতে চাচ্ছিলো আমায়?আর ওভাবে হঠাৎ হেসে উঠলো কেন?
"দূর,মরার সময় মতিভ্রম হয়েছিলো নিশ্চয়ই,হাজার হলেও এভাবে প্রেমিকের কাছে থেকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে নিশ্চয়ই এমন বিষাক্ত কিছু আশা করে নি।"
এইসব ভেবে সব কথা হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে চাইছিলাম।এতো কিছু পাত্তা দিলে চলে?

হঠাৎ কি গরম বেড়ে গেলো নাকি?আশপাশটা,পিচঢালা রাস্তাটা হঠাৎ হলুদ হয়ে যাচ্ছে কেন? সূর্যের দিকে তাকিয়ে রৌদ্রের তেজ বোঝার চেষ্টা করলাম।প্রচণ্ড পানির পিপাসা হচ্ছে।হঠাৎ করেই কি রৌদ্রতাপ বেড়ে গেলো অনেক খানি?
________________________________

ডা. মোঃ বেলায়েত হোসেন
শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ
০২ ব্যাচ।

 

 

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়