Ameen Qudir
Published:2017-08-13 21:57:42 BdST
এক জেলা শাসকের আত্মহত্যা! ভিডিওতে যা বলে গিয়েছিলেন স্বয়ং
জেলা শাসকের শোকস্তব্ধ পরিবার।
সংবাদদাতা
৩১ জুলাই জেলাশাসকের দায়িত্ব পান । ৪ অগস্ট কাজে যোগ দেন তিনি। বুধবার রাতে সার্কিট হাউসে, নিজের মোবাইলে সুইসাইড বার্তা রেকর্ড করে গিয়েছিলেন ২০১২ সালের পরীক্ষায় ১৪ তম স্থান পাওয়া এই প্রতিভাধর জেলা শাসক।
শৈশব থেকেই চাপ তাঁর নিত্যসঙ্গী। ছোটবেলায় বাবা-মা সব সময় চাপ দিয়েছেন পরীক্ষায় ভাল ফল করতে হবে। কলেজ শিক্ষা শেষ হলে বিহারের আর পাঁচটা সম্পন্ন পরিবারের মতোই পাণ্ডে পরিবারও ছেলের কাছে দাবি করেছিল, যে ভাবেই হোক আইএএস হতে হবে। প্রথম বার অকৃতকার্য হওয়ায় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আইএএস না হলে আর বাড়ি ফিরবেন না, গ্রামে মুখ দেখাবেন না। কথা রেখেছিলেন দুর্দান্ত ফল করে। কিন্তু চাপে চাপে ভীষণ অন্তর্মুখী হয়ে পড়েছিলেন মুকেশ। ভাবতেন সকলের ভালবাসা পেতে হলে তাঁকে শুধু ভাল ফল করে যেতে হবে। বিয়ের পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি। খুব ধনী পরিবারে বিয়ে হয় তাঁর।
মুকেশ নিজেই সুইসাইড নোটে বলে গিয়েছেন, স্ত্রী অ্যাগ্রেসিভ। বাবার গাড়ি-ব্যবসা সামলান। মেজাজি। স্ত্রীর ব্যক্তিত্ব ও কর্তৃত্বের সামনে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ছিলেন তিনি। ঝগড়া ছিল নিত্যসঙ্গী। তার পর শুরু হয় মুকেশের উপরে কার অধিকার বেশি, কে মুকেশকে বেশি ভালবাসে— তা নিয়ে মা ও স্ত্রীর টানাপড়েন।
ক্রমেই নিজের অস্তিত্ব অসহ্য লাগতে শুরু করে তাঁর। মুখ ফুটে কিছু বলতেন না বলে সকলেই ভাবছিল, সব ঠিক রয়েছে। কিন্তু ভিতরের ঝড়ের বহিঃপ্রকাশ যে দিন ঘটল, কারও কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ। যে ভাবে দিনের পর দিন পরিকল্পনা করে, মোবাইলে ভিডিও বার্তা রেকর্ড করে, দু’টি সুইসাইড নোট লিখে বক্সার থেকে দিল্লি গিয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন বছর তিরিশের ওই আইএএস, তাও মনোবিদ ও পুলিশকে অবাক করছে। মনোবিদদের মতে, আত্মহত্যা সিংহভাগ সময়ই ঝোঁকের মাথায়, চরম দুঃখ বা আঘাত পেলে করে মানুষ। কিন্তু এত পরিকল্পনা করলে, বার্তা রেকর্ড করলে শেষ পর্যন্ত চরম পন্থা নেওয়া হয় না। কিন্তু মুকেশবাবু ঠান্ডা মাথায় গোটা পর্বটা সেরেছেন।
ভিডিও বার্তা থেকে মনোবিদদের মনে হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে মৃত্যু নিয়ে চর্চা করেছেন মুকেশ। মৃত্যুকে গৌরবান্বিত করা, মৃত্যুকে আপন করে নেওয়ার লক্ষণ ফুটে উঠেছিল তাঁর বার্তায়, চরিত্রে। সুপরিকল্পিত ভাবে তিনি বাবাকে জানিয়েছেন দিল্লি যাচ্ছেন অফিসের মিটিংয়ে।
অফিসে জানান, কাকা অসুস্থ বলে পটনা যাচ্ছেন। পরে, বৃহস্পতিবার শ্যালিকাকে ফোনে জানান দিল্লি যাচ্ছেন আত্মহত্যা করতে। নিজের একাধিক আমলা ও পুলিশকর্তা বন্ধুকেও ফোন করে সিদ্ধান্তের কথা জানান। নিজের পরিবার ও শ্বশুরবাড়ির সকলকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজও করেন। পরের পর্বটায় দিল্লি পুলিশের ছ’টি দলের সঙ্গে রীতিমতো লুকোচুরি খেলা চলে তাঁর। কখনও জনকপুরির লীলা হোটেল, কখনও জনকপুরী মেট্রো স্টেশন, কখনওবা ওয়েস্টএন্ড মলের ১১ তলা। পুলিশ মুকেশের খোঁজে তল্লাশি চালাতে থাকে। হোটেলের ঘরে মেলে সুইসাইড নোট। পুলিশ জানিয়েছে, মলের ১১ তলার ব্যালকনি থেকে ঝাঁপ দেওয়ার পরিকল্পনা করলেও পুলিশ আসতে দেখে দ্রুত সেখান থেকে পালান মুকেশবাবু। তখনই সেখানে পড়ে যায় তাঁর মোবাইল ফোনটি। মুকেশবাবুর স্ত্রী, বাবা, শ্বশুররা গত কালই গাজিয়াবাদ যান।
এ দিন মুকেশবাবুর দেহ গুয়াহাটি আনা হয়। বেলা ১২টা নাগাদ মুকেশ পাণ্ডের দেহ গুয়াহাটির বাড়ি থেকে ভূতনাথ শ্মশানে রওনা হয়। মুকেশবাবুর শ্বশুর রাকেশ সিংহ নিজের মোবাইল দেখিয়ে জানান, ১০ অগস্ট ভোর চারটেয় মুকেশ তাঁকে এসএমএস করে জানান, স্বচ্ছতা অভিযানে যোগ দিতে দেহরাদূন যাচ্ছেন। রাকেশবাবু বলেন, “অশান্তি সব সংসারে হয়। কিন্তু মুকেশ স্ত্রীকেই শুধু নয় আমাকেও খুব ভালবাসত। গত চার বছর ধরে প্রতি দিন ফোন করেছে। এখন ওর মৃত্যুর পরে সকলে শুধু শুধু আমার মেয়েকে দোষ দিচ্ছে। মুকেশ আমার জামাই নয়, ছেলের মতোই ছিল। ও এমন কাপুরুষের মতো কাজ করবে তা মানতে পারছি না।”
৩১ জুলাই বিহারের বক্সারে জেলাশাসকের দায়িত্ব পান মুকেশ পাণ্ডে। ৪ অগস্ট কাজে যোগ দেন তিনি। বুধবার রাতে বক্সারের সার্কিট হাউসে, নিজের মোবাইলে সুইসাইড বার্তা রেকর্ড করে গিয়েছিলেন ২০১২ সালের আইএএস পরীক্ষায় ১৪ তম স্থান পাওয়া মুকেশবাবু।
ভিডিওতে যা রেকর্ড করেছিলেন মুকেশ—
আমার নাম মুকেশ পাণ্ডে। আমি বিহার ক্যাডারের ২০১২ ব্যাচের আইএএস অফিসার। বাড়ি অসমের গুয়াহাটি। বাবা সুদেশ্বর পাণ্ডে। মা গীতা পাণ্ডে। শ্বশুরের নাম রাকেশ প্রসাদ সিংহ, শাশুড়ি পুনম সিংহ। স্ত্রী আয়ুষি শাণ্ডিল্য। আমার আত্মহত্যার পরে এই ভিডিও আপনি দেখছেন। যে কথাগুলো আমি আগেই বক্সারের সার্কিট হাউসে ভিডিওটি রেকর্ড করছি। এখানেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি দিল্লি গিয়ে আত্মহত্যা করব। কারণ আমি জীবন নিয়ে খুশি নই। আমার স্ত্রী ও আমার বাবা-মার মধ্যে খুবই দ্বন্দ্ব। প্রায়ই তাঁরা নিজেদের মধ্যে আমায় নিয়ে ঝগড়া করেন। আসলে দোষ কারও নয়। তাঁরা সবাই আমায় অত্যধিক ভালবাসেন। কিন্তু কখনও কোনওকিছু মাত্রাতিরিক্ত হলে তা মানুষকে চরম পদক্ষেপ করতে বাধ্য করে। কোনও জিনিসই অতিরিক্ত হওয়া ভাল নয়। আমার স্ত্রী আমায় খুবই ভালবাসে জানি। আমার ছোট বাচ্চাও আছে। কিন্তু আমার সামনে অন্য কোনও পথ খোলা নেই। আমি এমনিও জীবন নিয়ে বিরক্ত। আমি সোজা-সাপটা, শান্তিপ্রিয় মানুষ। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই আমার জীবনে অনেক উথাল-পাথাল চলছে। আমি ও আমার স্ত্রী প্রায়ই ঝগড়া করি। দু’জনের মধ্যে চরিত্রগত কোনও মিলই নেই। আমরা চক ও চিজের মতো আলাদা। আমার স্ত্রী খুবই আগ্রাসী ও বহির্মুখী। কিন্তু আমি একদম শান্ত ও অন্তর্মুখী চরিত্রের। তাই মিল হত না। কিন্তু তাও আমরা একে অপরকে খুব ভালবাসতাম। আমার মৃত্যুর জন্য আমি কাউকে দায়ী করছি না। আমার চরিত্র, আমার মন ছোটবেলা থেকে যে ভাবে গড়ে উঠেছে তাতে কখনওই আমি দিলখোলা, বহির্মুখী হয়ে উঠতে পারতাম না। তা আমারই ব্যর্থতা। আত্মহত্যায় কেউ আমায় চাপ দেয়নি। কারও জন্য এই কাজে আমি বাধ্য হচ্ছি না। আসলে আমি নিজের জীবন নিয়ে বিরক্ত। আমার মনে হয় না, আমরা মানুষরা বিশ্বসংসারে খুব বেশি কিছু অবদান রাখতে পারছি। তাও আমরা নিজেদের খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলি। ভাবি আমরা খুব বড়-বড় কাজ করছি। কিন্তু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে যাত্রাপথ, সেখানে কত মানুষ এসেছেন, গিয়েছেন। সেখানে আমাদের অস্তিত্ব নগন্য, অর্থহীন। আমরা রোজ নতুন জাল বুনি। মনকে খুশি করতে তাতে নিজেদের জড়িয়ে ফেলি। আমি এ কথা মন থেকে অনুভব করেছি। আগে ভেবেছিলাম আধ্যাত্মিক পথ বেছে নেব। কোথাও গিয়ে তপস্যা করব, সমাজসেবা করব। কিন্তু পরে মনে হল, সেখাও ব্যর্থ চেষ্টা হবে। তার চেয়ে এই ফালতু জীবন শেষ করে দেওয়াই ভাল। মৃত্যুর পরে শান্তি আসুক বা অন্য কিছু, তার মুখোমুখি হওয়াই ভাল। কিন্তু আমার আর বাঁচার ইচ্ছে নেই। আমি জানি এ এক পলায়নপর, কাপুরুষোচিত পদক্ষেপ। কিন্তু আমার মনে যখন আর কোনও অনুভূতিই অবশিষ্ট নেই, তখন খামোকা বেঁচে থেকে লাভ নেই। এই ভিডিও পেলে, মোবাইল থেকে আমার মা-বাবা, স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়িকে খবর দেবেন। জানাবেন, তাঁদের ছেলে মুকেশ আর পৃথিবীতে নেই। সে দিল্লিতে আত্মহত্যা করেছে। আমি তেমনটাই পরিকল্পনা করেছি। মিথ্যে বলে দিল্লি গিয়ে আত্মহত্যা করব।
আপনার মতামত দিন: