ডা সুমন চৌধুরী
Published:2021-03-17 19:47:05 BdST
সিএমসির সাবেক অধ্যক্ষ সুলতান স্যার, আমরা তাঁকে ভুলবো না
ডা সুমন চৌধুরী
------------------------------
এবারে চলে গেলেন আমাদের সবার শ্রদ্ধেয়, সরাসরি শিক্ষক সুলতান উল আলম, আমাদের সুলতান স্যার। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অন্যতম শব্দ সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা।
স্যারের সাথে বিভিন্ন সময়ের টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি এই মুহুর্তে মনে ভেসে উঠছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে আমার ভর্তি হওয়ার পর প্রথম বড় কোনো উৎসব আয়োজন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে, অমর একুশের দিনে। সেবারই প্রথম এইদিনটিকে এভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে। মাসব্যাপী আমাদের রিহার্সাল চলত, তৎকালীন স্টুডেন্টস ক্যান্টিন "কিছুক্ষণ" এর উল্টো পাশে, টিচার্স লাউন্জে। তখন প্রথমবার স্যারের সাথে আমার পরিচয় হয়। জানতে পারি, স্যার কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান। রিহার্সাল চলার ফাঁকে স্যার আসতেন, অন্যান্য শিক্ষকমন্ডলীর সাথে আড্ডা দিতেন। তবে, আমার অবাক লাগত, একেবারেই নবীন ছাত্রছাত্রীদের সাথে স্যারের সহজেই মিশে যাওয়ার গুনটি দেখে। সেই সময়ের আমার মতো প্রথম বর্ষের একজন ছাত্রের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞায় এমনটা ভাবনায় আসেনি। কেননা, আমি ভাবতাম অধ্যাপক মানেই গুরুগম্ভীর, তাও আবার মেডিকেল কলেজের!
পরবর্তীতে, আরো দেখলাম স্যার আমাদের নিয়ে মাঝে মধ্যে উনার বাসভবনে চলে যেতেন, যেদিন রিহার্সাল থাকত না, বা দেরী হতো। গুলজার টাওয়ার ফেলে অলি খাঁ মসজিদের উল্টো দিকের একটা বাড়িতে স্যার থাকতেন, নীচতলা ছিল প্যাথলজি ল্যাব। ওখানেই স্যারের মুখে প্রথম জানতে পারি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে স্যার ও অন্যান্য শব্দ সৈনিকদের ভূমিকার কথা। কথার মাঝে চা সিঙারা ইত্যাদি চলত। দীর্ঘদেহী, সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী স্যার ভরাট কন্ঠে অনর্গল কথা বলে যেতে পারতেন, মুখে হাসি রেখে।
এর অনেক বছর পর স্যারকে আবার আবিস্কার করি সাউদার্ণ মেডিকেল কলেজে। তখন আমি সেখানে বায়োকেমিস্ট্রির লেকচারার হিসেবে যোগ দেই। স্যার ছিলেন কমিউনিটি মেডিসিনের প্রধান। কলেজের মাইক্রোবাস শহরের বিভিন্ন স্পট থেকে আমাদের তুলে নিত, স্যারের বাসা ততদিনে স্থানান্তরিত হয়েছে জয়নগরের উল্টোদিকে চট্টেশ্বরী রোডের একটি ভবনে। মাইক্রোবাস ওখানে গিয়ে থামত, আর স্যার একটি চামড়ার ব্যাগ হাতে সাদামাটা ভঙ্গিতে শার্ট প্যান্ট পরে নীচে নেমে আসতেন। প্রতিদিন একই নিয়ম। চলার পথে নানারকমের ঘটনার আলাপ উঠে আসত। মাইক্রোবাসের একেবারে সামনে ড্রাইভারের পাশে স্যারের সিট বরাদ্দ ছিল। তখনও দেখতাম, অনুজ সহকর্মীদের সাথে স্যারের মিশুক আচরণ। চলার পথে বিভিন্ন মডেলের কার দেখে স্যার মাইক্রোর ড্রাইভারের সাথে আলাপ জুড়ে দিতেন, গাড়ি কিনলে কোনটা নেওয়া যায়। স্যারের খুব শখ একটা গাড়ির, আমরা তখন তা বুঝতে পারতাম।
এরপর মেডিকেল কলেজের আয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ সব অনুষ্ঠানে স্যারকে দেখতাম। বৈজ্ঞানিক সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কোনটাই বাদ পড়ত না।
কোভিডের এই অতিমারির সময়েও স্যার নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পেরেছিলেন, পুরো ২০২০ সাল। বয়স বাড়লেও স্বাস্থ্য ঠিকমত রেখে টিকা নিতেও এসেছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে এসে স্যার বেশ জটলা আর প্রথমদিকের অব্যবস্থাপনা দেখতে পান। এ নিয়ে ফেসবুকেও পোস্ট দেন। কদিন পরেই দেখি, স্যার কোভিড আক্রান্ত! সম্ভবত ওখানেই স্যার সংক্রমিত হন।
এরপর একটি বেসরকারী হাসপাতালের আইসিউতে চিকিৎসা চলে। শরীরে অক্সিজেনের চাহিদা বাড়তে থাকে, বাকিটা ইতিমধ্যেই সবার জানা।
হয়ত এই ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন ঘিরে স্যারের নিজস্ব কোন পরিকল্পনা ছিল। একজন শব্দ সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুবর্ণজয়ন্তী দেখে যাওয়া এক বিরাট অনুভুতি। আফসোস, এটি আর হলো না।
অসংখ্য ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী, পরিচিতজনের মাঝেই স্যার বেঁচে থাকবেন...।
CMC 41st
আপনার মতামত দিন:

 
                 
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                       