Ameen Qudir
Published:2018-06-12 19:10:25 BdST
বাংলাদেশ দন্ডবিধি অনুযায়ী চিকিৎসকদের দায় মুক্তি : আসুন বিস্তারিত জেনে রাখি
ডা. আজাদ হাসান
___________________________
বাংলাদেশ দন্ডবিধি অনুযায়ী চিকিৎসকদের দায় মুক্তি দেয়া থাকলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এ আইনটি মানা হচ্ছে না ফলশ্রুতিতে চিকিৎসকদের মাঝে এ বিষয় নিয়ে রয়েছে চরম ক্ষোভ এবং হতাশা। সাম্প্রতিক সময়ে পর পর কয়েকটি স্থানে "ক্রিটিক্যালি সিক" বা "সংকটাপন্ন রোগীর" চিকিৎসা প্রদান করার পরও রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে হাসপাতাল ভাংচুর করা, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে শারীরিক ভাবে নাজেহাল বা অপদস্ত করা হয়েছে। তা ছাড়া কোথাও কোথাও আইন শৃংখলা বাহিনী কর্তৃক অতি উৎসাহী হয়ে আইন না মেনে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে নিয়ম বহির্ভূতভাবে এরেষ্ট করা হয়েছে। ফলে, চিকিৎসকদের মাঝে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা এবং চাপ ক্ষোভ বিরাজমান।
এবার তা হলে এ রকম পরিস্থিতিতে আইনের ধারায় কি বলা হয়েছে সেটা আলোচনা করা যাক।
অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রসংগে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩০০ থেকে ৩০৩ ধারায় মার্ডার সম্পর্কিত ধারায় উল্লেখ করা হয়েছেঃ "কাউকে হত্যার উদ্যেশ্যে সরাসরি আঘাত করে হত্যা করাই হল "মার্ডার"।
ধারা ৩০৪ঃ 
Culpable Humicide. যাকে সরাসরি মার্ডার বলা যাচ্ছে না কিন্তু মৃত্যু ঘটানোর উদ্যেশ্যে কোন কাজ করা হয় এবং মৃত্যু ঘটে। এখানে অসৎ উদ্যেশ্যের অভিযোগ বিদ্যমান থাকবে। 
উপধারা ৩০৪ (ক): Negligence. সংশোধনী করে এটি জুড়ে দেয়া হয়েছে। তবে এই ধারায় মামলা করতে হলে অবশ্যই বিএমডিসি অনুমোদিত দক্ষ মেডিকেল বোর্ডের রেপোর্ট লাগবে। অন্যথায় এই ধারা প্রযোজ্য হবেনা।
উপধারা ৩০৪ (খ): উক্ত ধারাটি ড্রাইভিং এর কারনে মৃত্যু সম্পর্কিত।
ধারা ৮৮ঃ 
ভাল উদ্যেশ্যে বা রোগ উপশমের উদ্যেশ্যে সম্মতিসহ কোন রোগীর অপারেশন করার সময় বা পরবর্তীতে যদি মৃত্যু ঘটে তবে সেটি অপরাধ হিসাবে গন্য করা যাইবে না।
ধারা ৮৯ঃ অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক বা মানসিক প্রতিবন্ধী কোন ব্যক্তি সম্মতি দিতে অসমর্থ হইলে এবং তাকে সুস্থ্য করার উদ্যেশ্যে (ভাল উদ্যেশ্যে) কোন অপারেশন করা হলে এবং সেটা করতে গিয়ে মৃত্যু ঘটলে তা কোন অপরাধ হিসাবে গন্য করা যাইবে না।
অর্থাৎ, ডাক্তাররা রোগীদের সুস্থ্য করার উদ্দেশ্যে সম্মতি নিয়ে অপারেশন করে থাকেন। এতে কোন ক্ষতি বা মৃত্যু হলে তা দন্ডবিধির ধারা ৮৮ ও ৮৯ দিয়ে তাদেরকে "দায় মুক্তি" প্রদান করা হয়েছে।
কিন্তু ধারা ৩০৪ কে বিকৃতভাবে অপব্যবহার করে ডাক্তারদের হয়রানী করার প্রকট প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অথচ এই ধারা প্রয়োগের আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ মতামত লাগবে, এবং তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলেই কেবল এই ধারাটি প্রযোজ্য হবে। আর ধারা ৩০০ - ৩০৩ ব্যবহারের তো কোন প্রশ্নই আসে না।
প্রসংগত উল্লেখ্য, ধারা ৩০৪ বি তে সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুর বিষয় আছে। প্রতিদিন সড়ক দূর্ঘটনায় কত প্রাণ যাচ্ছে এই । অথচ রহস্যজনক কারণে, ১ টি মামলা বা গ্রেফতারের ঘটনাও আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কারন কি?
তা হলে দেখা যাচ্ছে, আইনে বলা হয়েছে, ‘যদি কোন অসুস্থ রোগীকে ভাল করার উদ্যেশ্যে অপারেশন করা হয়, যার জন্য সেই রোগী বা রোগীর লোক লিখিত বা মৌখিক সম্মতি প্রদান করেছে এবং সেই অপারেশন করতে গিয়ে যদি কোন ক্ষতি বা মৃত্যু হয়, তবে তাকে অপরাধ বা মার্ডার হিসাবে গণ্য করা যাইবে না।’ (বাংলাদেশ দন্ডবিধি: পেনাল কোড ১৮৬০, সেকশন ৮৮, ৮৯ ধারা)
অর্থাৎ যদি কোনো রোগীর চিকিৎসার জন্য রোগীর কিংবা রোগীর অভিভাবকের সম্মতিক্রমে অপারেশন করা হয়, সেক্ষেত্রে অপারেশন পরবর্তি জটিলতার কারণে যদি উক্ত রোগীর অনাকাংখিত মৃত্যু ঘটে, তা হলে পুলিশ কর্তৃক উক্ত চিকিৎসককে গ্রেফতার করা কিংবা রোগীর লোককে দিয়ে হত্যা মামলা করানো কিংবা সেই মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো, এগুলো নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ পেনাল কোড ১৮৬০, সেকশন ৮৮, ৮৯ ধারার সুস্পষ্ট লংঘন।
উক্ত আইন মোতাবেক এক্ষেত্রে কোনভাবেই হত্যা মামলা হতে পারে না। এই আইনে চিকিৎসকদেরকে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সততার সাথে নিঃসংকোচ চিত্তে কর্তব্য পালন করার নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে এবং হত্যা মামলার মতো ক্রিমিনাল মামলা হতে ‘দায় মুক্তি’ দেয়া হয়েছে।
অর্থাৎ রোগীর মৃত্যুর কারণে কোন তদন্ত ছাড়াই চিকিৎসা প্রদানকারী ডাক্তারকে গ্রেফতার করার কোনো বিধান বাংলাদেশের আইনে নেই। তবে যদি উপযুক্ত তদন্ত বোর্ড কর্তৃক তদন্তের পরে প্রমাণিত হয় যে, উক্ত রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের ভুলের কারণে রোগীর মৃত্যু হয়েছে, তাহলে সেটা ‘প্রফেশনাল নেগলিজেন্স’। সেটা বিচারের জন্যও দেশে প্রচলিত আইন বিদ্যমান আছে এবং সে আইন অনুযায়ী বিচারের বিধান আছে।
কিন্তু তা না করে রোগীর মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসাবে নথিভুক্ত করা অন্যায়। ইচ্ছে করেই ইনিয়ে বিনিয়ে নানা কাহিনী সংযোজন করে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা অন্যায় এবং দূর্ভাগ্যজনক।
সম্প্রতি, রংপুরে যারা অন্যায়ভাবে প্রফেসর আব্দুল হাই সাহেবকে গ্রেফতার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে অযোগ্যতার, অদক্ষতার, আইন না জানার বা উদ্দেশ্য মূলক ভাবে আইন না মানার, এমন কি মিথ্যা মামলা দায়ের করার এবং হয়রানী করার অভিযোগ দায়ের করা হউক। এ ধরণের অন্যায় ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
উপরন্তু উল্লেখিত আইন অনুযায়ী পেনাল কোড ১৮৬০, সেকশন ৮৮, ৮৯ ধারা ব্যত্যয় করে ইতিমধ্যে যে সব বেআইনী মামলা করা হয়েছে তা অনতি বিলম্বে প্রত্যহার করা উচিত।
এমতাবস্থায়য় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন, সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের এই আইন সম্পর্কে অবগত হয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কাউকে ট্র্যাপ-এ ফেলে আর্থিক সুবিধা আদায়ের অপকৌশল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
চিকিৎসক সমাজকে দন্ডবিধির এই বিকৃত ও উদ্যেশ্য প্রনোদিত অপপ্রয়োগ রোধে সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি জন মানুষের সেবায় আন্তরিক থেকে, রোগীর প্রতি অবহেলা ও অপচিকিৎসা পরিত্যাগ করে সঠিক ও সততার সাথে চিকিৎসা প্রদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকতে হবে।
______________________________________
ডা. আজাদ হাসান
সিওমেক , ২১তম ব্যাচ।
আপনার মতামত দিন:

 
                 
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                       