Ameen Qudir
Published:2018-05-25 17:38:54 BdST
রোগী কথনএকলাম্পশিয়া: মুহূর্তে গর্ভবতীর জীবন ছিনতাই
এই জীবনময় ছবিতে কখনও ঘটে যেতে পারে মারাত্মক জীবনঘাতী অঘটন । ফাইল ছবি। 
ডা. ছাবিকুন নাহার
______________________________
আমি তখন মিটফোর্ড হাসপাতালে ট্রেনিং করি। রোজার মাস। ইফতারের ঠিক আগে আগে হঠাৎ শোরগোল। চোখ মুখ উল্টানো এক প্রেগন্যান্ট রোগীর আগমন। আমাদের আর ইফতারির দিকে তাকানোর ফুসরত হলো না। বেচারা আমরা।
হিস্ট্রি নিয়ে জানলাম, রোগীকে ভূতে ধরেছে! সন্ধ্যা বেলায় গাব গাছের নীচ ঘোমটা ফেলে বসেছিলো। নিশ্চয় খারাপ জ্বিন অথবা ভূতের নজরে পড়ে। তারপর চোখ মুখ উল্টিয়ে হাত পা শক্ত হয়ে যায়। অজ্ঞান হয়ে পড়ে। জিহবা কেটে একাকার। রোগীর শাশুড়ি ফিসফিস করে বলে, কী কমু ডাক্তার আপা, লজ্জার কথা, একদম কাফর চোপর ও নষ্ট কইরা ফেলাইসে। পেসাবের এমুন গন্ধ!
রোগীর শাশুড়িকে বুঝিয়ে বলা হলো, এটা জ্বিন ভূতের কাজ না। এক্লাম্পশিয়া নামক এক ভয়ংকর রোগের কাজ। শুনে তারা খুবই অবাক হলো! দুই একজন চোখ বড় বড় করে বল্ল, এমন তো কখনো শুনিনি! যখন শুনল এই রোগ মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ তখন তো রীতিমতো ভয়ই পেলো! রোগীর মা তো হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলো, তার মেয়ের মৃত্যুর আশংকায়। সেবার অবশ্য রোগী বেঁচে গিয়েছিলো, যদিও বাচ্চাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
মেডিকেল সাইন্সে এমন কিছু ব্যাপার আসলে থাকে যা গল্প উপন্যাস সিনেমা তো বাদ, কল্পকাহিনীকেও হার মানায়। ব্যাপারগুলো এতই আকস্মিক ও অনভিপ্রেত যে হজম করতে কষ্ট হয় আমাদের ডাক্তারদেরই। আর আমরা যারা রোগী তাদের অবস্থা তো কী বলব। রোগ সম্বন্ধে জানা থাকলে কিছু না কিছু প্রতিরোধ করা যায়। জানা এবং জানানোর ব্রত নিয়ে আমার এ দুর্গম যাত্রা। যদিও এটা সমুদ্রে এক ঘটি জল দেয়ার মতো ব্যাপার। তারপরও
যদি কিছুটা কাজে লাগে আরকি।
আসুন জানি একলাম্পশিয়া কি? 
একলাম্পশিয়া এক ধরণের খিঁচুনী। যা প্রেগন্যান্ট মহিলাদের হয়। সাধারনত বিশ সপ্তাহের পর হয়। ডেলিভারির সময় এবং ডেলিভারির পরও হতে পারে।
লক্ষন কি?
প্রেশার অনেক বেড়ে যাওয়া। হাত পা ফুলে ঢোল হওয়া, মাথা ব্যথা, চোখে অন্ধকার দেখা, বুকে ব্যথা, সর্বশেষ চোখ মুখ উল্টিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। পড়ে যাওয়ার ফলে অনেক ইনজুরি হয়। তারমধ্যে জিহবা কেটে রক্তারক্তি কান্ড ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে গর্ভফুল সেপারেট হয়ে বাচ্চা মারা যায়। হার্ট, লাং, লিভার, কিডনি অকেজো হয়ে যায়। এমনকি ব্রেন স্ট্রোক হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
কেনো হয়? 
কোন কারণ জানা যায়নি। তবে কিছু কিছু রিক্স ফ্যাক্টর আছে। যেমন- কম বয়সে বিয়ে, কম বয়সে বাচ্চা ধারণ, দারিদ্র্যতা, অপুষ্টি, ক্যালসিয়ামের অভাব এবং আরো অজানা কারন।
ডায়াগনোসিস কিভাবে করে? 
উচ্চ রক্তচাপ সাথে প্রস্রাবে অনেক বেশি প্রোটিন (এলবুমিন) যাওয়া। আর লক্ষন তো আগেই বলেছি।
চিকিৎসা কি? 
একলাম্পশিয়া হলে ডেলিভারি করিয়ে ফেলতে হয়, তা বাচ্চা যে অবস্থায় থাকুক না কেনো। এটাই রুল। এছাড়া পথ থাকে না। এখানে সেই পুরনো প্রবাদ, গাছ বেঁচে থাকলে ফল ধরবেই! রোগটাও এমন বেয়ারা, যত চিকিৎসা দাও না কেনো, ডেলিভারি না করালে সে রোগীকে ছেঁড়ে যাবে না। প্রয়োজনে জান নিয়ে নিবে মা বাচ্চা দুজনেরই তবুও দাঁত কামড়ে পড়ে থাকবে যতক্ষণ না ডেলিভারি করানো হয়।
প্রতিরোধ? 
কিছু উপায় আছে। তবে সব ক্ষেত্রে প্রতিরোধ করা যায় না। ম্যাগনেশিয়াম সালফেট নামক এক ধরনের ঔষধ যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছে এ ক্ষেত্রে। তাছাড়া রিক্স ফ্যাক্টর এড়িয়ে চললে কিছুটা সুফল পাওয়া যায়।
একলাম্পশিয়া এবং তার ছোটভাই প্রিএকলাম্পশিয়া মিলে শতকরা বিশ ভাগ মায়ের জান কবজ করে! হ্যাঁ ঠিক শুনেছেন। শতকরা বিশ ভাগ মাতৃমৃত্যুর কারণ এই দুই সহোদর।
যত সহজে বল্লাম, ব্যাপারটা আসলে তত সহজ না। আঠারো ঊনিশের একটা মেয়ে বিয়ে কী না বোঝার আগেই প্রেগন্যান্ট হলো এবং ধুম করে মরে গেলো। তার নাড়িছেঁড়া ধন তার সাথেই কবরে গেলো, এই ভয়াবহতা কী করে আমি বর্ণনা করি! সে স্পর্ধা আমার কোথায়?
________________________
 
মেডিকেল অফিসার
ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
আপনার মতামত দিন:

 
                 
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                       