Ameen Qudir
Published:2018-03-04 15:37:09 BdST
রাবি' র সেকাল একাল : গন-অভ্যুত্থানের জোহা স্যার বনাম সিভিয়ার ডিপ্রেশনের রোগী
ডা. অরুন্ধতী মজুমদার
_________________________
প্রায় অর্ধশত বছর আগে আমাদের দেশেরই এক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বাঘের বাচ্চা অধ্যাপক ছিলেন।
তা-ও বাংলা বিভাগে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টরও ছিলেন তিনি। যদিও বয়স খুব একটা বেশী ছিল না। মাত্র ৩৫। 
ঊনসত্তর সনের গন-অভ্যুত্থানের সময় পাকিস্তানী মিলিটারীরা ছাত্র হলে ঢুকতে চায়। তাদের কাছে হালনাগাদ তথ্য আছে যে, এখানকার কিছু ছাত্র গন-আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত।
কিন্তু ওই বাঘের বাচ্চা আড় হয়ে দাঁড়ালেন গেইটে। হুংকার দিয়েছিলেন যে, তিনি জীবিত থাকতে তাঁর ছাত্রদের গায়ে হাত দেয়া যাবে না।
মিলিটারীরা তো পাকিস্তানের! তারা ব্যাপারটার আক্ষরিক ও তাৎক্ষণিক সমাধান করল। স্যারকে গেইটেই হত্যা করল। তারপর হলে ঢুকল।

স্যারের নাম প্রফেসর শামসুজ্জোহা। জোহা স্যার নামেই পরিচিত সমধিক।
ঘটনাস্থল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৯ সাল।
-----------------------------------
★২০১৮ সন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজশাহী মেডিকেল কলেজে মেয়েকে ভর্তি করান চিকিৎসার জন্য। করিডোরে হাঁটার সময় এক ফিমেল ইন্টার্ন ডক্টরের গায়ে ধাক্কা লেগে যায়। হাসপাতাল করিডোরে এসব নতুন নয়। হয় মাঝে মাঝে। মেয়েরা ধাক্কা লাগলে বিরক্তি প্রকাশ করলে সাধারণত এইরকম ক্ষেত্রে যে বা যারা ধাক্কা লাগিয়েছে, তারা হাঁটার মধ্যেই “স্যরি” বলে ফেলে। ব্যস, শেষ।
এই প্রফেসর আইন বিভাগের। ডাক্তার মেয়েটির বিরক্তিসূচক শব্দে তিনি “স্যরি” বললেন না, বললেন “F_ck you.”
স্তম্ভিত মেয়েটি তাকে আবার জিজ্ঞেস করেছে- “ কি বললেন আপনি?”
অধ্যাপক আবারো বললেন “ফা_ ইউ”!
বলে তিনি মেয়ে যে ওয়ার্ডে ভর্তি, সেখানে চলে যান।
এরপর মেয়েটি সহপাঠী ইন্টার্ন ছেলে ডাক্তারদের ঘটনাটা জানায়। তারা খুব স্বাভাবিকভাবেই সহপাঠী মেয়েকে “ফা_” করতে চাওয়ার সাধ মিটিয়ে দিতে ওই অধ্যাপককে ঘেরাও করে।
‘আপনি এই ডাক্তারকে কি বলেছেন’ এই জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি বলেন “ফা_ ইউ বলেছি। তো কি হইসে তাতে? আমি আইনের প্রফেসর। যা পারেন করেন গিয়া।”
তখন পোলাপান সত্যিসত্যিই যা পারে তা-ই করেছে। উনাকে গনপিটুনি দিয়েছে।
পরে পুলিশ ডেকেছে। 
পুলিশ ‘ভার্বাল অ্যাসল্ট’-কে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে তাকে হালকা ওয়ার্ণ করেছে মাত্র।
মাইর দেয়াটা তাহলে জায়েজ ছিল না?
এইক্ষেত্রে তো আইন নিজের হাতে তুলে নেয়াটা ১০০% ঠিক হয়েছে আমার মনে হয়।
মাত্র কয়েক বছর আগে নিজের ইন্টার্নশীপ করাকালীন সময়ের কথা ভাবলাম। আমাকে যদি কেউ এমন অপমানজনক কথা বলত, আমি সহপাঠী ছেলেদের ডাকার আগে নিজেই হাত-পা চালিয়ে বসতাম। 
আদর্শগত, রাজনৈতিক আরো নানাবিধ গ্রুপিং আমাদের ব্যাচে থাকলেও এই বিষয়ে পুরো ব্যাচ একযোগে মারমুখী হয়ে উঠত বলে আমার ধারণা ও বিশ্বাস।
শুধু আমি কেন, যে কোনো ক্লাসমেটের অপমানেই এই ঘটনাটা ঘটত।
ঘটা স্বাভাবিক। 
এবং রাষ্ট্রীয় আইন যেহেতু মেয়েদেরকে (সে ডাক্তার হোক আর গার্মেন্টস কর্মীই হোক) মৌখিকভাবে এই রেপ-করার-ইচ্ছা-ব্যক্ত-করাকে গুরুতর কোনো অপরাধ বলে মনেই করে না, 
সেহেতু পোটেনশিয়াল রেপিস্টকে এই পিটুনির এপিসোডটা ঘটা উচিৎ বটে।
সেটা সহপাঠী ইন্টার্ন ডাক্তাররা পেটাক আর ডিগ্রী কলেজের সহপাঠী ছাত্ররাই পেটাক।
এইক্ষেত্রে এরা খুব ঠিক কাজ করেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এরপর যথারীতি বিষয়টিকে ‘ভার্সিটি বনাম মেডিকেল’ ঝগড়ায় রূপ দেয়। তাদের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ছেলেরা ওই ইন্টার্ন মেয়েটিকে ফেসবুকে ট্রেস করে। ইনবক্সে ও ওয়ালে তাকে রেপ-করতে-চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা লিখে লিখে ভাসিয়ে দেয়।
মেয়েটি ডি-অ্যাক্টিভেট করতে বাধ্য হয় নিজের আইডি।
ভাবখানা এমন যে, আমাদের টিচারদের বিনা অপরাধে খুন করলেও আমরা নিজেরাই করে থাকি।
তোরা কে রে আমাদের টিচারের গায়ে হাত দেয়ার?
(উনি যা-ই করে থাকুন না কেন!)
প্রশংসনীয় বিষয় হলো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদেরই কয়েকজন ছাত্রী প্রকাশ্যেই স্যারের এই আচরণের কিছুটা হলেও নিন্দা জানান। তারা স্ট্যাটাস, কমেন্টে বলেন যে, এই স্যার ক্লাসেও মেয়েদের এই কথাটি ও আরো কিছু স্ল্যাং ল্যাঙ্গুয়েজ বলেন। তারা প্রথমদিকে অস্বস্তিতে এই স্যারের ক্লাসই করতে পারতো না।
পরে তারা জানতে পারে, এই স্যার নাকি সিভিয়ার ডিপ্রেশনের রোগী। ডিপ্রেশন কাটাতে তিনি ছাত্রীদের খারাপ কথা বলেন!
আই মীন, সিরিয়াসলি?
সিভিয়ার ডিপ্রেশন একটা ক্লিনিক্যাল সিচুয়েশন, যেখানে রোগী ভার্সিটির আইন বিভাগে শিক্ষকতা করতে পারার কথা নয়।
আর এর আড়ালে মেয়েদের নোংরা কথা বলা একধরনের যৌন অবদমনের আক্রমণাত্মক বহিঃপ্রকাশ।
‘৬৯ আর ২০১৮!
মাত্র ৪৯ বছরে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মূল্যবোধের এ-ত, এতোটাই পার্থক্য হয়ে গেল?
বিশ্বাস করতেও ভয় হয়।
_______________________

ডা. অরুন্ধতী মজুমদার।
প্রভাষক, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ, কিশোরগঞ্জ।
আপনার মতামত দিন:

 
                 
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                       