Ameen Qudir
Published:2018-01-30 16:36:18 BdST
শেষ খবর: ডা. আরহা তার জীবন থেকে ওই নরকের কীটকে ছুঁড়ে ফেলেছে
এক ডাক্তার মায়ের ছবি। মডেল হিসেবে জীবনঘনিষ্ট ছবিটি নেয়া। 
ডা.ছাবিকুন নাহার
_________________________________
আরহা। মধ্য ত্রিশের ঝকঝকে প্রাণবন্ত তরুণী। রিবন্ডিং করা অবাধ্য চুলগুলো ডাগর ডাগর চোখগুলোকে ঢেকে দেয় প্রায়শই। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ও একটার পর একটা রোগী ফলোআপ দিয়ে যায় ক্লান্তি বিহীন। রোগীদের চোখে পলক পড়েনা। মানুষ এত্ত সুন্দর হয়! সহকর্মীদের চোখেও ইর্ষার ছায়া দেখা যায় কখনো সখনো। রোগীদেখা, ইমার্জেন্সি অপারেশন করা, রাতজেগে ওয়ার্ড ম্যানেজ করা, মর্নিং সেশনে প্রফেসরের কাছে প্রতিটা রোগীর পুংখানুপুংখ আপডেট জানানো সবই সে করে একহাতে। এফসিপিএস, পৃথিবীর কঠিনতম ডিগ্রীর একটি। এর জন্য তিলেতিলে নিজেকে রেডি করা। এতকিছুর মাঝেও জেগে থাকে সংসার। ঠিকঠাকমতো না যাপন করা সংসারের জন্য হাহাকার।
এমনি টাইটাই হাঁসফাস সময়ে জানা গেলো আরহার হাজবেন্ড বিয়ে করে ফেলেছে! হ্যাঁ ঠিক শুনেছেন। পাত্রী দুই বাচ্চার মা। বয়সেও নাকি বড়। আরহা বুঝে পায়না, লোকজন এমন বেইমানও হয়? একবারও ওদের কথা মনে পড়ল না? ওর কথা না হয় বাদ, বাচ্চাটার কথাটা? অবশ্য এই বাচ্চা জন্মের পর থেকেই ওর পরিবর্তন টের পায়। একটু একটু করে কেমন বদলাতে থাকে ও। সাপের খোলস বদলানের মতো। হ্যাঁ সাপই তো। যদিও আরহা জানেনা নিজ সন্তানের অসুস্থতার অযুহাতে কোন কালসাপও এতটা কৃতঘ্ন হতে পারে কিনা? ওদের এত বছরের সম্পর্ক! ক্যাম্পাসের ছয় বছর। বিবাহিত জীবনের আরো দশটি বছর।
আরহা ডুবো কন্ঠে বলে, সু্ঁতোটি হয়তো কেটে গেছে বহু আগেই। যখন বাবুর জন্ম হলো, বাবা সুলভ উচ্ছ্বাস ওর মধ্যে দেখিনি আমি। বরং আমার প্রেগন্যান্সি জনিত শারীরিক পরিবর্তনে ওর বিরক্তি আমার অস্বাভাবিক লাগত। তারপরও আমি এটাকে সহজ ভাবেই নিতাম। ভাবতাম আমাকে মনেহয় আগের মতো করে চাচ্ছে।
কত যে ভুল ছিলো আমার ভাবনায়! আসলে ও রীতিমতো মানসিক ভাবে সিক ছিলো। শারীরিক সম্পর্কীয় ব্যাপারে। কোন বাছ বিচার ছিলোনা। যে কোন উপায়ে। যে কাউকে। কোন কাজের মেয়ে রাখতে পারতামনা। সবচেয়ে খারাপ লাগতো ও যখন বলত, আমার লাগবেই। আমি কিছু জানিনা। হয় তুই না হয় অন্য কেউ। কিন্তু লাগবেই।
আজব সাইকোলজি। এমনতর কথা কেউ বলতে পারে? 'যতক্ষণ বিছানায় থাকি মনেহয় ঠিকই করছি। ব্যাপারটা হয়ে যাওয়ার পর মনে হয়, এটা না করলেও পারতাম। কাজটা ঠিক হলো না।' ওর কথা শুনি আর ঘৃণায় কু্ঁকড়ে যাই। স্বীকারোক্তি শুনে হয়তো মনে হতে পারে ও বুঝি অনুতপ্ত। এ কথা ভুলেও মনে করার কারণ নেই। আমি জানি একই কাজ সে আবার করবে। বারবার করবে। এটা ওর রক্তে মিশে আছে। জেনেটিক্স বলে একটা কথা আছে না? সে রকম আরকি!
এমনও কত রাত গেছে আমি প্রিপেয়ার না। বাচ্চা কাঁদছে। ও নির্বিকার। ওর প্রয়োজনে ও ফিজিক্যাল এসল্ট পর্যন্ত করতে দ্বিধা করত না।
আরহার রীতিমতো ঘৃণা লাগত। ছিঃ একটা মানুষ এতটা অসভ্য হয় কি করে! অথচ ওর সাথে উথাল পাথাল প্রেম ছিলো আমার! কত ভালো বাসতাম ওকে। ছয় ছয়টা বছর! আমি মানুষ চিনতে ভুল করেছি। নিজেকে নিজে তিরস্কার করে, ছি আরহা, ছি। লাত্থি মার এই অসভ্যর মুখে। নিজের জীবন থেকে ছুড়ে ফেল। অস্তাকুরে গিয়ে মরুক শুয়োর কোথাকার। যার মানবিকতা, মননশীলতা, রুচিবোধ শুধু মাত্র বিছানায় থাকে তার মতো অসুস্থ আর দ্বিতীয়টি আর নেই। এই সিকনেস থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙল।
আরহা তুই এত্ত সুন্দর। আমারতো রীতিমতো হিংসা লাগে! কত কম্পিটেন্ট তুই। বিসিএস জব করছিস। দেশ সেরা মেডিকেল কলেজে পোষ্টিং। ভালো প্রাকটিস। তুই ওকে টলারেট করছিস কেনো শুনি?
আরহা কিছুক্ষন চুপ থাকে। বড় বড় চোখে কিছুটা মেঘের আভাস। একটু যেনো ধাতস্ত হতে সময় নেয়। তারপর আস্তে আস্তে বলে, নামিতা তুই কখনো চোরাবালিতে পড়েছিস?
না, তবে আমি চোরাবালি সম্বন্ধে পড়েছি। খুব ভয়ংকর। যে একবার পড়েছে তার রক্ষা নেই। অতলে ডুবে মরে। কী ভয়ংকর কথা! তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ডুব দেয়া। অথচ মনে প্রাণে বাঁচার আকন্ঠ তৃৃষ্ণা!
আরহা বলে, তুই চোরাবালির বর্ণনা শুনেই ভয় পাচ্ছিস আর আমি প্রতিদিন ই চোরাবালিতে ডুবে যাই। একটু একটু করে দম বন্ধ হয়। প্রাণ পাখিটা ছটফট করে। বুকের ছাতি ফেঁটে যায়। ছিন্নভিন্ন হয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে। আমি মরে যাচ্ছি...মরে যাচ্ছি...এমন একটা অনুভূতি গ্রাস করে। দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরে চোখ বেয়ে। সে ভেজা চোখে আমি দেখি আমার সন্তানের মুখ।
একটু দম নিয়ে আরহা বলে, আমি প্রবলভাবে বেঁচে ওঠি। চোরাবলি আর আমাকে ডোবাতে পারেনা। জাদিদের চোখের দিকে তাকালে আমি আমার প্রতি অন্যায়ের কথা ভুলে যাই। যে বাচ্চা জন্মের জন্য বাচ্চার বায়োলজিক্যাল বাবা উপলক্ষ্য পেয়েছে ব্যাভিচার করার, সে সন্তানই আমাকে বেঁচে থাকার মন্ত্র শেখায়। প্রবলভাবে বেঁচে থাকতে প্রেরণা দেয়। উপেক্ষা করতে শেখায়। উপেক্ষার মতো প্রতিশোধ আর হয়না।
২.
কি করে তোকে রাজি করালো আরিয়ান ভাইয়া? নামিতা চোখ কপালে তুলে জানতে চায়। খুব তো বলতি আর বিয়ের নাম নিব না, খুব হয়েছে। এখন?
আরহা মিটিমিটি হাসে। ভয়ংকর সুন্দর এই মেয়ের হাসি! সুন্দর মেয়েদের জামাই এর স্খলন আরো ভয়ংকর। তখন মেয়েটি যেনো সবার সম্পত্তি। আহারে উহুরে আফসোসের শেষ নেই। শুভাকাঙ্খিরও ইয়াত্বা নেই। কত যে মায়াকান্না। এসব দেখা হয়েছে ঢের। সব সুযোগ সন্ধানীর দল। তারপরও আরহা সব পাশ কাটিয়ে ওর বাবুটাকে নিয়ে থাকতে চেয়েছিলো। শুধু বাবুটা যদি একটু কথা বলতে পারতো?!
নামিতা খুব জানতে চাচ্ছিলি কিভাবে আরিয়ান আমাকে রাজি করালো তাইতো? এই নে দেখ, বলে একটা চিরকুট এগিয়ে দেয় আরহা।
আরহা, আমি তোমার সন্তান জাদিদের বাবা হতে চাই। এটুকুই আমার যোগ্যতা। প্লিজ কনসিডার মি। আরিয়ান।
আরিয়ান অবিবাহিত। একটা মাল্টি ন্যাশনাল কম্পানিতে আছে এক্সিকিউটিভ হিসেবে।
শেষ খবর। আরহা তার জীবন থেকে ওই নরকের কীটকে ছুঁড়ে ফেলেছে। জীবনটাকে সাজিয়েছে নতুন করে। তবুও ওর চোখ ভেসে যায় জলে। সে জল আনন্দ এবং কৃতজ্ঞতার। আল্লাহ ওর জন্য ওর জাদিদের জন্য এত্ত ভালোবাসা রেখেছিলেন! যে বাচ্চাকে জন্মদাতা অটিস্টিক বলে দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে, সেই বাচ্চাকেই বুকে করে রাখে আরিয়ান। আরহার আরিয়ান।
(বিঃদ্র- গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক। কারো সাথে মিলে গেলে কাকতালীয় মাত্র। )
_____________________________

ডা.ছাবিকুন নাহার
মেডিকেল অফিসার
ঢাকা মেডিকেল কলেজ
আপনার মতামত দিন:

 
                 
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                       