Ameen Qudir
Published:2020-03-03 16:15:28 BdST
তিনি কোন সন্তান জন্মদান করেননি, কিন্তু তিনি বিশ্বব্যাপী কোটি মানুষের মা
হিমেল রোজারিও 
_____________________
মানব প্রেম ও প্রকৃত সেবা কাজের অনন্য জলন্ত প্রদীপ হচ্ছেন সাধ্বী মাদার তেরেসা। তিনি বাংলাদেশে আসেন মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে অসুস্থ সৈনিকদের সেবা করার জন্য। তিনি বস্তির অনাথ ও পিতা-মাতা পরিত্যক্ত সন্তানদের বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। তিনি অসহায় মানুষের বিপদের সহায় হয়েছেন। যিশুর ন্যায় মানুষকে স্বার্থহীনভাবে ভালোবেসেছেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। অনাথ শিশুদের জন্য খাবার চাইতে গিয়ে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছেন। তবুও মানুষকে তাঁর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেননি কখনো। মাদার তেরেসা যিশুকে উপলদ্ধি করেছেন আহত মানুষের ক্ষত স্থানে, তাই তিনি ঘৃণা না করে ক্ষত স্থানে দিয়েছেন চুম্বন। নিজ হাতে সেবা করেছেন দুঃখী মানুষকে। তিনি কোন সন্তান জন্মদান করেননি, কিন্তু আজ তিনি বিশ্বব্যাপী কোটি মানুষের মা। 
সাধ্বি মাদার তেরেসার জন্ম হয় আলবেনিয় স্কপিয়েতে ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট। দীক্ষা দীক্ষাস্নানের সময় রাখা হয় অ্যাগনেস গঞ্জা বোজাঝিউ। আলবেনীয় ভাষায় গঞ্জা শব্দের অর্থ গোলাপ কুঁড়ি। তার পিতা নিকোলা এবং মাতা দ্রানা বয়াজুর কনিষ্ঠ সন্তান তেরেসা। পিতা রাজনীতি করতেন। ১৯১৯ সালে পিতার মৃত্যুর পর মা দ্রানা রোমান কাথলিক ধর্মের আদর্শে বড় হন তেরেসা। (জোয়ান গ্রাফ ক্লুকাস রচিত জীবনী) তিনি একজন আলবেনীয়-বংশোদ্ভুত ভারতীয় ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী ও ধর্মপ্রচারক। ১২ বছর বয়সেই তিনি ধর্মীয় সন্ন্যাস জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।
১৮ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে একজন ধর্মপ্রচারক হিসেবে যোগ দেন সিস্টার্স অফ লোরেটো সংস্থায়। ১৯২৯ সালে ভারতে এসে কাজ শুরু করেন। ১৯৩১ সালের ২৪ মে তিনি সন্ন্যাসিনী হিসেবে প্রথম ব্রত গ্রহণ করেন এই সময় তার নাম তেরেসা নাম গ্রহণ করেন। ১৯৩৭ সালের ১৪ মে পূর্ব কলকাতায় একটি লোরেটো কনভেন্ট স্কুলে পড়ানোর সময় তিনি শেষ ব্রত গ্রহণ করেন।
স্কুলে পড়াতে তাঁর ভাল লাগলেও কলকাতার অভাবি মানুষ দেখে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের শহরে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুঃখ আর মৃত্যু। ১৯৪৬ সালে হিন্দু- মুসলমান দাঙ্গাতেও বহু মানুষ মারা যান। এই সব ঘটনা মাদার তেরেজার মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।
১৯৪৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বরে বার্ষিক নির্জনধ্যানের জন্য দার্জিলিং যাওয়ার সময় তার মধ্যে এক গভীর উপলব্ধি আসে। এই অভিজ্ঞতাকে পরবর্তীতে “আহ্বানের মধ্যে আহ্বান” হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। হাতে মাত্র ৫ টাকা নিয়ে ১৯৪৮ সালে মিশনারী অব চ্যারিটি সম্প্রদায় শুরু করেন। এর পর তিনি ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে বস্তি এলাকায় কাজ শুরু করেন। প্রথমে ভারতের মতিঝিলে একটি ছোট স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে ক্ষুধার্ত ও নিঃস্বদের ডাকে সাড়া দিতে শুরু করেন। তাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে থাকেন।
১৯৫০ সালের ৭ই অক্টোবর মিশনারী অব চ্যারিটি সিস্টার সম্প্রদায়টি ভ্যাটিকান থেকে পোপের অনুমোদন লাভ করে। কলকাতায় মাত্র ১৩ জন সদস্যের ছোট্ট সিস্টার সম্প্রদায়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল। চ্যারিটির অধীনে অনাথ আশ্রম ও এইড্স আক্রান্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। অন্ধ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত, বয়স্ক, মাদকাসক্ত, দরিদ্র, বসতিহীন এবং বন্যা, দুর্ভিক্ষ বা মহামারিতে আক্রান্ত মানুষের সেবার কাজ করে যাচ্ছেন সিস্টারগণ।
১৯৫২ সালে মাদার তেরেসা কলকাতা নগর কর্তৃপক্ষের জমিতে মুমূর্ষদের জন্য প্রথম আশ্রয় ও সেবা কেন্দ্র গড়ে তোলেন। ভারতীয় কর্মকর্তাদের সহায়তায় একটি পরিত্যক্ত হিন্দু মন্দিরকে কালিঘাট হোম ফর দ্য ডাইং-এ রূপান্তরিত করেন। এটি ছিল দরিদ্রদের জন্য নির্মিত দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র। পরবর্তীতে এই কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে নাম রাখেন নির্মল হৃদয়। এই কেন্দ্রে যারা আশ্রয়ের জন্য আসেন তাদেরকে চিকিৎসা সুবিধা দেয়া হয় এবং সম্মানের সাথে মৃত্যু বরণ করার সুযোগ দেয়া হয়। এ বিষয়ে মাদার তেরেসা বলেন, “অ নবধঁঃরভঁষ ফবধঃয রং ভড়ৎ ঢ়বড়ঢ়ষব যিড় ষরাবফ ষরশব ধহরসধষং ঃড় ফরব ষরশব ধহমবষং — ষড়াবফ ধহফ ধিহঃবফ.” এর কিছুদিনের মধ্যেই মাদার তেরেসা হ্যানসেন রোগে (সাধারণ কুষ্ঠরোগ নামে পরিচিত) আক্রান্তদের জন্য একটি সেবা কেন্দ্র খোলেন যার নাম দেয়া হয় ‘শান্তি নগর’। এছাড়া মিশনারিস অফ চ্যারিটির উদ্যোগে কলকাতার বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেশ কিছু কুষ্ঠরোগ চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
প্রথমে অল্প শিশুদের লালন-পালন করতেন সিস্টারগণ। এক সময় শিশুর সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় মাদার তেরেসা তাদের জন্য একটি আলাদা হোম তৈরির প্রয়োজন অনুভব করেন। এই অনুভূতি থেকেই ১৯৫৫ সালে নির্মল শিশু ভবন স্থাপন করেন। এই ভবন ছিল অনাথ ও বসতিহীন শিশুদের জন্য এক ধরনের স্বর্গ।
৬০ এর দশকে মধ্য ভারতে চ্যারিটির অর্থায়নে প্রচুর দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র, অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৫ সালে ভেনিজুয়েলায় মাত্র ৫ জন সিস্টারকে নিয়ে সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৮ সালে রোম, তানজানিয়া, অষ্ট্রিয়ায় অনাথ ও পথ শিশুদের জন্য সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ৭০ এর দশকে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকায় ১২টির অধিক আশ্রম ও সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৮২ সালে বৈরুত অবরোধের চূড়ান্ত প্রতিকূল সময়ে মাদার তেরেসা যুদ্ধের একেবারে ফ্রন্ট লাইনে হাসপাতালে আটকে পড়া ৩৭ শিশুকে উদ্ধার করেন। ইস্রায়েলী সেনাবাহিনী ও ফিলিস্তিনী গেরিলাদের মধ্যে সাময়িক যুদ্ধ বিরতি ঘটিয়ে পরিবেশ কিছুটা অনুকূলে এনেছিলেন। এই সুযোগেই রেড ক্রসের সহায়তায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চলে যান। বিধ্বস্ত হাসপাতালগুলো থেকে কম বয়সের রোগীদের সরিয়ে আনেন।
১৯৯১ সালে তেরেসা প্রথমবারের মত মাতৃভূমি তথা আলবেনিয়াতে ফিরে আসেন। এদেশের তিরানা শহরে একটি ‘মিশনারিস অফ চ্যারিটি ব্রাদার্স হোম’ স্থাপন করেন। ১৯৯৬ সালে পৃথিবীর ১০০ টিরও বেশি দেশে মোট ৫১৭টি ধর্মপ্রচার অভিযান পরিচালনা করছিলেন।
বাংলাদেশে অবদান
এই মহিয়সী নারীর অবদান বাংলাদেশেও কম নয়। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশে আসার পরে প্রথমে ঢাকার ফার্মগেটে একটি আশ্রম খোলেন। সেখানে অনাথ, পঙ্গু, অসহায়, বৃদ্ধরা থাকেন। এছারা প্রতি শনিবার সকালে বস্তির শিশুদের বিনা মূল্যে খাবারের ব্যবস্থা করে থাকেন সিস্টারগণ। একই দিনে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়।
পুরান ঢাকার ইসালামপুরে রয়েছে আরেকটি আশ্রম। সেখানে অনেক বাবা-মা পরিত্যক্ত শিশুরা থাকে। সিলেট, মৌলভীবাজারের কুলউড়া, ঠাকুরগাঁও, রাজশাহীসহ বিভিন্ন স্থানে দরিদ্রদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন মিশনারী অব চ্যারিটি সিস্টারগণ।
১৯৮৩ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল এর সাথে দেখা করার উদ্দেশে রোম সফরের সময় মাদার তেরেসার প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়। ১৯৮৯ সালে আবার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর তার দেহে কৃত্রিম পেসমেকার স্থাপন করা হয়। ১৯৯১ সালে মেক্সিকোতে থাকার সময় নিউমোনিয়া হওয়ায় হৃদরোগের আরও অবনতি ঘটে।
১৭ ডিসেম্বর ২০১৫ সালে ভ্যাটিকান নিশ্চিত করে যে পোপ ফ্রান্সিস মাদার তেরেসার একটি দ্বিতীয় অলৌকিক অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, যেটিতে একাধিক মস্তিষ্কের টিউমারসহ একজন ব্রাজিলিয়ান মানুষের নিরাময় জড়িত। পোপ ফ্রান্সিস ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স স্কোয়ার্ড একটি অনুষ্ঠানে তাঁকে সাধ্বি উপাধি প্রদান করেন। ১৫ জন সরকারি প্রতিনিধি এবং ইতালি থেকে ১ হাজার ৫০০ জন গৃহহীন মানুষসহ, শত সহস্র মানুষ অনুষ্ঠানে জড়ো হন।
১৯৯৬ সালের এপ্রিলে পড়ে গিয়ে কলার বোন ভেঙে যায়। আগস্টে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। এর পাশাপাশি তাঁর বাম হৃৎপি-ের নিলয় রক্ত পরিবহনে অক্ষম হয়ে পড়ে। ১৯৯৭ সালের ১৩ মার্চ মিশনারিস অফ চ্যারিটির প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ৮৭ বছর বয়সে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের কলকাতায় মারা যান। আলবেনিয়ায় জন্ম গ্রহণ করলেও মাদার তেরেসা ভারতের নাগরিকত্ব পান ১৯৪৭ সালে। বর্তমানে কমপক্ষে ১৩৩টি দেশে মাদার তেরেসার সেবা কাজ পরিচালনা করছেন সাড়ে চার হাজার অনুসারী সিস্টার।
মহান সেবা কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ মানবতার মা মাদার তেরেসা ১৯৭৮ সালে পেয়েছেন ‘বালজান’ পুরস্কাার, ১৯৭৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। এই পুরস্কারের অর্থ তিনি দরিদ্রদের সেবা কাজে ব্যয় করেছেন। ভারত সরকার ১৯৮০ সালে ‘ভারতরত্ন’ পুরস্কারে ভূষিত করেন। ১৯৮৫ সালে পেয়েছেন ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ পুরস্কার।
আপনার মতামত দিন:

 
                 
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                       