ডাক্তার প্রতিদিন
Published:2020-05-16 18:34:51 BdST
একগাদা ভিআইপি রেফারেন্সের করোনা পজেটিভ রোগীর অপারেশন হল যেভাবে!
ডেস্ক 
___________________
জীবন ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসকরা রোগীর জীবনরক্ষায় 
চিকিৎসা করে চলছেন। অবিরাম নিন্দার মুখেও কোন বিরাম নেই। তেমনই এক অভিজ্ঞতার কথা জানালেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন সজ্জন লোকসেবী চিকিৎসক। জানালেন কিভাবে একগাদা 
ভিআইপি রেফারেন্সের করোনা পজেটিভ রোগীর অপারেশন করলেন। 
তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে বাঁচিয়েছেন রোগীর জীবন। একজন চিকিৎসকের এটাই পরম প্রাপ্তি। চিকিৎসক যে জীবনদাতাসম, সেটার প্রমাণ রাখতেই এই সবিবরণ প্রতিবেদন। তিনি জানান, 
১৪/০৫/২০২০,সকাল ১১টা ,ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিরেক্টর স্যার এর অফিস থেকে হঠাত ফোন ,,,
হ্যালো আপনি কী ডাক্তার রুশদানা বলছেন ?
আমি: জ্বী বলছি , আপনি কে বলছেন ?
ওপাশ থেকে,,,,,আমি এসিস্টেন্ট ডিরেক্টর (এ ডি ) ডঃ ,,,,, বলছি ,আপনাকে একটু দরকার ।
আমি: কেনো স্যার কোন সমস্যা?
এ ডি : না না , আপনাকে একটা জরুরি অপারেশন করতে হবে ।রোগী অনেক ভিভিআইপি রেফারেন্স এর, ৩৬ সপ্তাহের প্রেগনেন্সি ,কোভিড পজিটিভ,সাথে আরো অনেক জটিলতা আছে। রোগী আমাদের বার্ন এর কোভিড ডেডিকেটেড ইউনিটে ভর্তি।
আমি : কিন্তু স্যার এই সপ্তাহের কোভিড ডেডিকেটেড ডিউটি টিমে তো আমার নাম নাই ।ওখানে তো একজন কন্সালটেন্ট থাকার কথা।
এ ডি : কন্সালটেন্ট যিনি উনি একটু অসুস্থ। রোগী টা যেহেতু একটু জটিল তাই ডিরেক্টর স্যার আপনাকে অনুরোধ করেছেন অপারেশন টা করার জন্য।
আমি: ঠিক আছে, আমি রেডি হয়ে স্যার এর রুমে আসছি।আপনি একটু কন্সালটেন্ট কে বলেন রোগী সম্পর্কে ডিটেইলস আমাকে জানাতে ।
একটু পর কন্সালটেন্ট এর ফোন ,,,,,,,,,,,,
আপা রোগী টা আমাদের দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের রেফারেন্স এর রোগী এবং ওনার আত্মীয়, সাথে আরো অনেক রেফারেন্স।
রোগীর ৩৬ সপ্তাহের প্রেগনেন্সি সাথে জি ডি এম,হাইপোথাইরোএড ,আগে সিজারিয়ান সেকশন আছে এবং তার আগে মাইওমেকটমি অপারেশন এর হিস্ট্রি আছে । গতকাল রাতে রোগীর পেটে একটু বেথা ছিল। রোগীর হালকা জ্বর ও শ্বাসকষ্ট ও ছিলো।আপনি একটু অপারেশন টা করে দেন আপা।
আমি সব শুনে এক দৌরে বাসায় গিয়ে কিছু প্রয়োজনীও জিনিস নিয়ে হাসপাতালে এসে সরাসরি ডিরেক্টর স্যার এর রুমে গেলাম।
স্যার বললেন আপনার প্রয়োজনীয় পিপিই ও যা লাগবে আমাকে সরাসরি জানাবেন। এই রোগীর জন্য অনেক উচ্চ পর্যায়ের রিকোয়েস্ট আসছে। আপনি একটু অপারেশন টা করে দুই দিনের ডিউটি করে এই টিমের সাথে ইনক্লুড হয়ে পরবর্তীতে ১৪ দিনের কোআরেন্টাইনে হোটেলে চলে যায়েন ।
আমি ঠিক আছে স্যার বলে কোভিড ইউনিটে ফোন করে দুই ব্যাগ রক্ত সহ রোগীর সবকিছু রেডি করে ওটি তে রোগী তোলার জন্য ডিউটিরত আমার সহকর্মীদের অনুরোধ করলাম , আর আমার জন্য পিপিই রেডি করতে বললাম।
রোগী এবং রোগীর হাজবেন্ড দুজনেই ডাক্তার এবং উনি কোভিড রিসার্চার ও ট্রেইনার।কাগজ পত্র ঘেঁটে দেখলাম ২২ সপ্তাহের প্রেগনেন্সি র একটি আলট্রাসোনোগ্রাম রিপোর্ট আছে , রিসেন্ট কোন আলট্রাসোনোগ্রাম রিপোর্ট নেই, শুধু ফিল্ম আছে ,কারন এর আগে উনি এপোলো তে যে কন্সালটেন্ট কে দেখাতেন উনি নিজে আলট্রাসোনোগ্রাম করতেন এবং কোন রিপোর্ট দিতেন না। রোগীর হিমোগ্লোবিন ৮.৬।আমার মাথায় তখন অনেক গুলি আশংকা ঘুরছে।
যাই হোক এনেসথেটিস্টকে আশংকা র বেপারটি বলেই অপারেশন শুরু করলাম।
পেট খুলে দেখলাম ইন্টেস্টাইন ও ব্লাডার সব জরায়ু র উপরের অংশে লাগানো আটকে আছে। ব্লাডার নামিয়ে জরায়ু থেকে বাচ্চা বের করে প্লাসেন্টা বের করার সময় দেখলাম প্লাসেন্টা র নীচের অংশ জরায়ু র মাংসের মধ্যে যেখানে আগে মাইওমেকটমি অপারেশন হয়েছে সেখানকার স্কার এ আটকে আছে। প্লাসেন্টা বের করার পর সাইনাস ওপেন হলো আর হুর হুর করে ব্লিডিং শুরু হলো।
এদিকে পিপিই র উপরে প্লাস্টিকের মেকেন ,তার উপর ওটি গাউন পরা, আবার চশমার উপরে প্লাস্টিকের গগলস তার উপর ফেইস শিল্ড এতসব বর্ম পরে এরকম জটিল অপারেশন সামাল দিতে গিয়ে আমার তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।
আমি তখন ফেইস শিল্ড খুলে ফেললাম, ভাবলাম যা আসে কপালে,আল্লাহ্ ভরসা, আগে ব্লিডিং তো থামাই। এরপর ব্লিডিং বন্ধ করার জন্য যা যা করতে হবে সব প্রসিডিউর করার পর ব্লিডিং বন্ধ হলো। আমাদের টিমের সবাই তখন ঘেমেনেয়ে একাকার। কয়েক ব্যাগ রক্ত দেয়া হলো রোগী কে । রোগীর সবকিছু স্টেবল করে অপারেশন শেষ করে রোগী কে পোস্ট অপারেটিভ এ পাঠালাম।
কোভিড রোগীর অপারেশন সাধারণত যত তাড়াতাড়ি শেষ করা যায় ততই মঙ্গল। কিন্তু এই রোগীর ক্ষেত্রে আমার সেটা করা সম্ভব ছিল না।
আজ রাত পর্যন্ত রোগী ভালো ছিল। হঠাত করে রোগীর অক্সিজেন সেচুরেশন কিছুটা ফল করার পর অক্সিজেন থেরাপি দেয়া হচ্ছে ও মেডিসিন ও আই সি ইউ স্পেশালিষ্ট দের কন্সালটেশন এ আছে।
এতসব জটিল ও নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে আমার কোভিড কালীন হোটেলে কোআরেন্টাইনে বাস শুরু করলাম। গতকাল রাতে স্বপ্নে দেখলাম আমার খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে আর একটু অক্সিজেন নেওয়ার জন্য আমি হাঁসফাঁস করছি ।আমার আই সি ইউ লাগবে কিন্তু কোন আই সি ইউ তেই কোন বেড খালি নেই। জানি না কপালে কী আসে। আল্লাহ্ ভরসা।
ছবিগুলি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের
করোনা ডেডিকেটেড ইউনিটে অপারেশন থিয়েটারে অপারেশন শেষে তোলা।আমার সাথে আছে এনেসথেসিওলজিস্ট ডা: আরমান।অসংখ্য ধন্যবাদ ডা: জলি ও ডা: মারজিআ কে অপারেশন এ আমাকে এসিস্ট করার জন্য।
লেখক: 
ডা: রুশদানা রহমান তমা
সহকারী অধ্যাপক
গাইনী ও অবস্ বিভাগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ
___________
AD...

আপনার মতামত দিন:

 
                 
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                       