Saha Suravi

Published:
2025-01-15 19:45:19 BdST

মানুষের চামড়ায় বাঁধানো বই



ডেস্ক
বিচিত্র সব বিষয়ে অনবদ্য লেখেন তুষার মুখোপাধ্যায় । তাঁর একটি আলোচিত লেখা প্রকাশ করা হল ।
তুষার মুখোপাধ্যায় :
চামড়ায় বাঁধানো বই দেখার সৌভাগ্য সবার না হলেও অনেকের হয়েছে। খুব দামী বই মানে চামড়ায় বাঁধানো, এমনটাই চল ছিল আগে। সেই সব বই হল খানদানী বই। আজও তেমন বই হাতে নিতে পারলে অনেকেই শিহরিত হবেন। তবে তারই মধ্যে কোন কোন বই হাতে নিলে শিহরণ হবে যদিও সেটা আনন্দের না হয়ে আতঙ্কেরও হতে পারে, যখন জানবেন বইটি বাঁধানো হয়েছে মানুষের চামড়ায়।
না মোটেই গুজব বা আজগুবি খবর নয়। বাস্তবে তেমন বই আছে। একাধিক বই। আর এই বই বাঁধাই পদ্ধতির একটি নামও আছে Anthropodermic bibliopegy.

Harvard Law School_এ রাখা একটি বই ১৬০০ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে ১৭০০ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রচিত। নাম Practicarum quaestionum circa leges regias , স্প্যানিশ আইনের বই। বইটিতেই লেখা আছে এটি মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধানো। কিন্তু লেখা থাকলেই হবে নাকি। প্রমাণ তো চাই।

মানুষের চামড়া না অন্য কোন পশুর চামড়া তা পরীক্ষা করে বের করে ফেলার মত টেকনোলজি মানুষের হাতে এসে গেছে। এক্ষেত্রে ডি.এন.এ পরীক্ষা সম্ভব নয়, কারন চামড়া ট্যান করার সময় ডি.এন.এ নষ্ট হয়ে যায়।আবার ব্যবহারের সময় ব্যবহারকারীর ডি.এন.এ ও চলে আসতে পারে। এছাড়াও পরীক্ষার নানা পদ্ধতি আছে। যেমন লোককুপের ধরন যাচাই করা, ম্যাস স্পেক্টোমেট্রি দ্বারা চামড়ার কোলাজেন পরীক্ষা করা, কিছু বিশেষ প্রোটিনের অস্তিত্ব খুঁজে বের করা, এই সব। হার্রভার্ড ল স্কুলের বইটি পরীক্ষা করে দেখা গেল, বাজে কথা। মানুষের চামড়া নয়। কিন্তু বইটিতেই লেখা আছে যে? অনেকে ধারনা করেন এটা স্রেফ ঠাট্টা করে লেখা হয়েছিল, আবার অনেকে মনে করেন গোড়াতে হয়ত মানুষের চামড়াই ছিল, পরে পাল্টে দেওয়া হয়েছে।

তাহলে মানুষের চামড়া বাঁধানোর কথা নেহাতই গুজব? না। আসলে সত্যি।

Anthropodermic Book Project এর অধীনে অক্টোবর ২০১৮ অবধি মানুষের চামড়ায় বাঁধানো সন্দেহে মোট ৪৯টি বই সংগ্রহ করা হয়েছে। তারমধ্যে ৩০টি বই পরীক্ষা করা হয়ে গেছে। এই ৩০টি বইয়ের মধ্যে ১৮টি বই সত্যি সত্যি মানুষের চামড়ায় বাঁধানো। বাকি ১২টি বই অন্যান্য পশুর চামড়ায বাঁধানো। (এই সংখ্যায় কিছু গোলমাল আছে, বেশি নয় একটি বা দুটির।বিভিন্ন উৎসে আলাদা আলাদা সংখ্যা লেখা আছে, তারই মধ্যে যেটা সবে লেখা হয়েছে সেটাই নিয়েছি।)

মানুষের চামড়া কেটে শরীরের অন্য জায়গায় লাগানো তো হয়ই, যাকে আমরা স্কীন গ্রাফটিং নামে বেশ ভাল করেই চিনি। কিন্তু বই বাঁধানোর জন্য? সত্যি হলেও অভাবনীয়।

মানুষের শরীর থেকে, গোটা শরীর থেকে চামড়া খুলে নেওয়ার মত বিভৎসতা কিন্তু অতি প্রাচীন। মেসোপটেমিয়ার আসিরীয়রা বিখ্যাত ছিল তাদের রণক্ষেত্রে নিষ্ঠুরতা, না, নৃশংসতার জন্য। শত্রুপক্ষের উপর চরম নৃশংসতা প্রদর্শন ছিল তাদের রণকৌশল। প্রদর্শন লিখলাম কারন তারা তাদের নৃশংসতা সত্যিই প্রদর্শন করতো। যাতে শত্রুপক্ষ সেই বিভৎসতার সামনে না দাঁড়ানোর জন্য যুদ্ধের আগেই ভয়েই আত্মসমর্পণ করতো।

এই রণকৌশল চেঙ্গিস খানও বেশ সাফল্যের সাথেই ব্যবহার করেছিলেন। এখনও নানা আতঙ্কবাদী গোষ্ঠী আক্ষরিক অর্থেই আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য চরম নৃশংসতা ব্যবহার করে আর তার প্রদর্শনও করে। আসিরীয়রা শত্রু সেনার চোখ উপড়ে নেওয়া, জীবন্ত সেনার পেট কেটে নাড়ী টেনে বের করা ছাড়াও গোটা শরীর থেকে জীবন্ত অবস্থায় চামড়া খুলে নিত। হ্যাঁ গোটা শরীর থেকেই। তারপরে সে চামড়া নগর প্রাচীরে টানিয়ে রাখত সবার দেখার জন্য, যাতে আতঙ্কটা জবরদস্ত হয়।

না আসিরীয়রা মানুষের চামড়া দিয়ে বই বাঁধায় নি। কারন তখন তাদের লেখালেখি ছিল মাটির ট্যাবলেটে। বাঁধানোর দরকার ছিল না। এই কর্মটি শুরু হয় মধ্যযুগের ইয়োরোপে। বলা হয় ফরাসী বিপ্লবের সময় যে আতঙ্কের যুগ শুরু হয়, পাইকারী হারে পক্ষের আর বিপক্ষের লোককে কোতল করা হতে থাকে, তখন থেকেই যাদের কোতল করা হত তাদের চামড়া দিয়ে বই বাঁধানো শুরু হয়।

এই ভাবে বাঁধানো বইয়ের তালিকায় ১৭৯৩ খৃষ্টাব্দের ফরাসী সংবিধানের কপিও নাকি আছে, সেটি রাখা আছে প্যারিসের Carnavalet Museum-এ আর Declaration of the Rights of Man বর্ণনায় লেখা আছে 'passing for being made in human skin imitating calf'.

Declaration of the Rights of Man বই বাঁধানো হল মানুষের চামড়া দিয়ে। এটাই বোধহয় নিকৃষ্টতম, নিষ্ঠুরতম রসিকতা।

তখন নাকি মানুষের চামড়া ট্যান করার জন্য রীতিমত ট্যানারীও গড়ে উঠেছিল প্যারিসের উপকন্ঠে Meudon এ। সত্যি কথা বলতে কি, আমি নিজে এইসব তথ্য বিশ্বাস করতে চাইছি না, তবু অনেক উৎসেই লেখা পেলাম। গোলমাল খুঁজে পেলাম না।

বলা হয় উনবিংশ শতকে নাকি চিকিৎসকদের বিশে্ষ করে শবব্যবচ্ছেদেকারী সার্জনদের মধ্যে এই বিষয়ে প্রবল উৎসাহ দেখা গেছিল। কোন কোন বই এই ভাবে বাঁধাই হয়েছে তার খোঁজ খবর রাখা শুরুও হয়ে যায়।এমনকি কার কার চামড়া ব্যবহার করা হয়েছিল তারও খোঁজ রাখা হত।

এমনি একটি বইয়ের মালিকানা আছে Bristol Record Office এর। ১৮২১ খৃষ্টাব্দে Eliza Balsum নামে একজনকে হত্যার অপরাধে John Horwood এর ফাঁসী হয়। মৃত্যুর পরে সার্জন Richard Smith তার শব ব্যবচ্ছেদ করেন Bristol Royal infirmary তে। এরপরে সার্জন Richard Smith এই ১৮ বৎসর বয়সী মৃত John Horwood এর চামড়া এই কেসেরই কাগজ পত্র বাঁধাইয়ের কাজে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন।

Royal College of Surgeons of Edinburgh-এ একটি নোটবই রাখা আছে যা বাঁধানো হয়েছিল William Burke নামের একজন হত্যাকারীর মৃত্যুদন্ড কার্যকরী করার পরে, জনসমক্ষে তার শব ব্যবচ্ছেদ করার পরে। এই শব ব্যবচ্ছেদ করেন প্রফেসর Alexander Monro. ঘটনার সময় হল ১৮২৯ খৃষ্টাব্দ।

আরেকটি বই, রাখা আছে Boston Athenaeum, বইটির নাম The Highwayman: Narrative of the Life of James Allen alias George Walton. লেখক James Allen, এই James Allen ১৮৩৭ খৃষ্টাব্দে তার মৃত্যু শয্যায় একটি স্বীকারোক্তি দেন নিজের অপরাধের, সাথে জানান তাঁর শেষ ইচ্ছে। একজনকে হাইওয়েতে তিনি ডাকাতি করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। সেই লোকটির অসম সাহসকে সে শ্রদ্ধা করে, তাই তার মৃত্যুর পরে যেন তার চামড়া দিয়ে এই স্বীকারোক্তির একটি কপি বাঁধাই করে সেই লোকটির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

Joseph Leidy নামের একজন আমেরিকান অ্যানাটমি প্রফেসর তাঁর একটি বই An Elementary Treatise on Human Anatomy, বাঁধাই করেন একজনের চামড়া দিয়ে, যে কি না ছিল “a soldier who died during the great Southern Rebellion”.

ফরাসি জ্যোতির্বিদ Camille Flammarion এর বই terres du ciel (The Worlds of the Sky (১৮৭৭ খৃষ্টাব্দ) বাঁধানো হয়েছে এক মহিলা অনুরাগিনীর দান করা চামড়া দিয়ে।

লেখক Dale Carnegie র বই Lincoln the Unknown, Temple Universityর Charles L. Blockson-র সংগ্রহে আছে। তাতে আছে "taken from the skin of a Negro at a Baltimore Hospital and tanned by the Jewell Belting Company"

এই তালিকা ইচ্ছে করলেই আরও অনেক লম্বা করা যেত। ইচ্ছে করল না।

নীচে কিছু লিঙ্ক, দিলাম। আমি সব নয় কয়েকটি পড়েছি। যার মন চাইবে তিনি পড়তে পারেন। এছাড়া উইকিতেও পাবেন।

১. Boeni, M., 2013. The Bizarre Art of Binding Books in Human Skin. [Online] Available at: http://mentalfloss.com/article/51634/bizarre-art-binding-books-human-skin
২. Dean, E., 2014. The macabre world of books bound in human skin. [Online] Available at: https://www.bbc.com/news/magazine-27903742

৩. Eden Workshops, 2019. Anthropodermic Bindings Or Books Bound In Human Skin. [Online] Available at: http://www.edenworkshops.com/Anthropodermic_Bindings.html

৪. Jones, J., 2014. Old Books Bound in Human Skin Found in Harvard Libraries (and Elsewhere in Boston). [Online] Available at: http://www.openculture.com/2014/04/old-books-bound-in-human-skin-found-in-harvard-libraries.html

৫. Ross, P., 2014. Books Bound In Human Skin Are Spooky Reminder Of ‘Macabre’ Medieval Trend. [Online] Available at: https://www.ibtimes.com/books-bound-human-skin-are-spooky-reminder-macabre-medieval-trend-1566694

৬. The Anthropodermic Book Project, 2019. The Anthropodermic Book Project. [Online] Available at: https://anthropodermicbooks.org/

৭. Velella, R., 2014. The True Practice of Binding Books in Human Skin. [Online]
Available at: https://www.atlasobscura.com/articles/anthropodermic-bibliopegy-the-true-practice-of-binding-books-in-human-skin

ছবির পরিচয়ঃ---মানুষের চামড়ায় বাঁধানো বই (প্যারিস, ১৮৫৬), Holbein-এর লেখা—অ্যালফাবেট অফ ডেথ

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়