Saha Suravi

Published:
2024-12-10 09:01:36 BdST

ভোজনার্থে


নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়  



____________________________

সেদিন শ্রীমন্নারায়াণ বলেছেন -- ঘুষ আর বখশিস এক জিনিস নয় । ও দুটোকে একসঙ্গে মিশিয়ে ফেলা অবৈধ । পৃথিবীর সব দেশেই বখশিসের রেওয়াজ আছে , অতএব --
অতএব বখশিস বা টিপস্ সম্পূর্ণ আইনসংগত । ঘুষের সঙ্গে টিপসের তফাত কী ? টাকার অঙ্কে ? বলা শক্ত -- কারণ এই সুনন্দ কে কয়েকদিনের জন্য একদা পারী শহরে অবস্থান করতে হয়েছিল । প্রথম দিনেই জ্ঞানচক্ষু খুলে গেল তার । ট্যাক্সিওয়ালাকে পনেরো পার্সেন্ট -- পুরবোয়ার ( পানার্থে ) << pour boire >> কাফের 'গারসোঁ' কে বারো পার্সেন্ট , সিনেমার 'উভরো' কে ( অর্থাৎ দ্বাররক্ষী ) -- বারো পার্সেন্ট -- আর দরকার নেই , মাথা ঘোরাবার জন্যে এই যথেষ্ট । এগুলো সব -ই দেয় নয় শুধু , রীতিমতো আইনসঙ্গত । সেবার বিনিময়ে কৃতজ্ঞতার অর্ঘ্য । কিন্তু কৃতজ্ঞতার এই ঋণ শোধ করতে গিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে পারী ছেড়ে পালাতে হয়েছিল তাকে । ট্রেনে উঠে শেষ পুরবোয়ার টি দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়েছিল -- পারী কে ওরভোয়ার << Au revoir >> বলতেও সাহসে কুলোয়নি তার ।
সুতরাং , ঘুষের সঙ্গে টাকার সম্পর্ক নেই । কাজ না করে কিছু আদায় করা , অথবা কাজ করে দেবার আগেই কিছু বাগানো --- তাকেই বলে ঘুষ । কাজ হয়ে গেলে খুশী মনে কেউ কিছু দিলে -- পাঁচ আনা থেকে পাঁচ হাজার -- অঙ্ক টা যাই হোক , তাকে ঘুষ আখ্যা দেওয়া যায় না । তার নাম বখশিস - টিপস -- পুরবোয়ার । আর যাঁরা পানীয়রসিক নন ( ফরাসী দেশে লক্ষে গুটিক ) , তাঁদের জন্য ফরাসী করেই বলা যায় -- পুরমাঁজে << pour manger >> , অর্থাৎ ভোজনার্থে ।
ইত্যাকার চিন্তার ভেতরে এক সহপাঠী বন্ধুর কথা মনে পড়ল । আপাতত সে ওপরতলার সরকারী কর্মচারী । অর্থাৎ তার কেরানী আছে , বেয়ারা আছে , আর্দালি আছে এবং অফিস আছে । তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে " সাহেব" কে কার্ড পাঠাতে হয় ।
প্রথমে ঢুকেছিল সার্কেল অফিসার হয়ে । অর্থাৎ মাঠ -ঘাট - বন - বাদাড় ঠেঙিয়ে বেড়াতো । বৈশাখ মাসের রোদেও পনেরো মাইল সাইকেল দাবড়ে গ্রামে ঢুকেও একটা ডাব সাহস করে খেতে পেত না - পাছে ' ইল্লিগাল গ্র্যাটিফিকেশনে'র আওতায় পড়ে ।
' পরস্মৈপদী খেয়েই বেঁচে আছি ভাই , নইলে যা দিনকাল । ডেপুটিগিরি করে সাড়ে ছ টাকার মাছ কিনে খাবো ? তুমি ক্ষেপেছ সুনন্দ ? "
বাড়িতে ভেট দিয়ে যায় বুঝি ? মাছ , মুরগী , পাঁঠা ?
'আরে না না । ওসব পাপ কাজের মধ্যে আমরা নেই । বড় জোর কথা কইতে এলে ভুল করে একটা নতুন সিগারেটের টিন ভুল করে ফেলে দিয়ে যায় । ব্যস - ওই পর্যন্ত । আসল ব্যাপার টা হোলো-- ডিনার । তবে পদমর্যাদা বুঝে । কারো বা ক্যালকাটা ক্লাব বা গ্র্যান্ডে , কারো বা আমজাদিয়ায় বা দেলখোশে ।'
খেতে খারাপ লাগবে না ?
' খেতে খারাপ লাগবে ? যেসব রাজভোগ নিজের পয়সায় কেনা তো দূরের কথা , কখনো চোখেও দেখতে পাবো না , তা খেতে খারাপ লাগবে ! কী যা- তা- কথা বলছো ' ?
মানে এও তো ঘুষ ।

' থামো হে নীতিবাগিশ , বাজে বকবক করো না । ঘুষ নয় হে - এই হল আজকের রেওয়াজ , বলতে পারো শিষ্টাচার - অতিথি পরায়ণ বাঙালীর প্রীতি নিবেদন । দেশের যাঁরা সবচেয়ে মাননীয় , যাঁরা ভি , আই , পি , - তাঁদের এক দল যে আমাদের সামনে স্বর্ণ - দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দিয়েছেন । ধরো , গোবর - গণেশপুরে একটা পাঠাগার উদ্বোধন করতে হবে --- একজন মহামান্য কেউ সেখানে পদার্পণ করলেন । তারপর ? পুকুরে জাল পড়ল , পাঁঠা - মুরগীদের মধ্যে হাহাকার উঠল , সাত রকম মিষ্টান্নের জোগাড় হল । অতিথি পরিতুষ্ট হল , আমরা যারা পৃষ্ঠরক্ষী হয়ে গেলুম , আমরাও বাদ পড়লুম না । এর মধ্যে যদি কোনো ওস্তাদ শিকারী নিজগুণে কিঞ্চিৎ লক্ষ্যভেদ করে থাকে -- সে আমাদের দ্রষ্টব্য নয় ' ।
হুঁ ।। ' হুঁ কি হে ? তাঁদের প্রেরণা তেই তো এই বেপরোয়া ভোজনানন্দ আমরাও চালু করে দিয়েছি । আমাদের দুর্ভেদ্য পিঠের চামড়া সম্পর্কে যত গুজব শুনতে পাও - সে শক্তি আমরা কোত্থেকে পাই ? সেই বাংলা প্রবাদ টি স্মরণ করো । পেটে খেলে --'
আঃ , থামো ।। ' থামবো কেন ? তুমি তো জানো না বন্ধু , একটি পল্লীভ্রমণ , একটি ডিনারের জন্য কি ভাবে মুখিয়ে থাকি আমরা । নেমন্তন্ন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কী স্বর্গীয় আনন্দে আমাদের শিরাস্নায়ু তে বিদ্যুৎতরঙ্গ বইতে থাকে । ছেলেবেলায় শুনেছিলুমঃ - বাঁচার জন্য খাইয়ো , খাওয়ার জন্য বাঁচিও না । কিন্তু খাওয়ার জন্য বাঁচার যে অপরূপ পুলক , সে আমি কেমন করে তোমায় বোঝাব হে ' ?
'আমার বুঝে দরকার নেই । কিন্তু তোমার এই খাওয়ার আনন্দের মতো একটা ক্রুড ব্যাপারকে কিছুতেই মানতে পারছিনা ভাই । ঘুষ বরং এর চেয়ে ভালো , যে লোকটা টাকা নেয় , সে শুধু নিজের জন্যই নেয়না , অন্ততঃ তার স্ত্রী ছেলেমেয়ে তার একটা অংশ পায় । এ যে শুধু জঘন্য স্বার্থপরতা । শুধু নিজের পেটের জন্যে --- '
'ভুল করলে । সংসারে কে কার হে ? চিরদিন শুনে আসছি -' একা এসেছি , -- একা যাবো ' । অতএব আনন্দটাও একারই । একেই বলে বোধ হয় - " সোহং " । আচ্ছা চলি তাহলে , আমারো ডিনার আছে একটা । '
সত্যিই তো , সংসারে কে কার । আর ক্রুড বলেই বা কাকে ধিক্কার দেব । সূক্ষ্ম -- সুন্দর -- সুকুমার -- এগুলো এখন অতীত যুগের কনভেনশন । সেইজন্যেই তো এক রবীন্দ্র- জন্মোৎসবে
আমার বন্ধুর মতো এক পদস্থ সরকারি কর্মচারীকে -- পদাধিকার বলে যিনি সভাপতি -- বলতে শুনেছিলুমঃ--- ট্যাগোর মানে ঠাকুর লাভলি পোয়েট্রি লিখতেন । তাঁর কটি লাইন আই স্টিল রিমেমবার --'আজিকে তোমার মধুর মূরতি -- হেরিনু -- হেরিনু -- মানে ওয়ান্ডারফুল ! '
এই পর্যন্ত বলেই তিনি বেরিয়ে গেলেন , বোধহয় তাঁর ডিনারের নিমন্ত্রন ছিল ।
পুরবোয়ার এ পুরমাঁজে -- << pour boire et pour manger >> -- খাটি কথা । আমরা ওটা মর্মে মর্মেই বুঝে ফেলেছি ।।


____________________


সুনন্দর জার্নাল । ৭/ ৯ / ৬৩ ।

 

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়