Saha Suravi
Published:2024-10-03 13:07:57 BdST
" মঙ্গোল বনাম বেঙ্গল "
ডা. সুকুমার সুর রায়
________________________
মঙ্গোলিয়া নামের এক দেশ আছে।
চীন ও রাশিয়ার মাঝখানে স্থল বেষ্টিত এক দুর্গম ভূভাগ।
উত্তরে রাশিয়ার সাইবেরিয়া ও দূর প্রাচ্য।
দক্ষিন দিকে চীনের ভূভাগ দ্বারা বেষ্টিত।
দেশটির আয়তন বাংলাদেশের প্রায় দশ গুন। পনের লক্ষ বর্গ কিলোমিটার।
মোট জনসংখ্যা একত্রিশ লক্ষ মাত্র।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার পঞ্চাশ ভাগের এক ভাগ মাত্র।
দশ লক্ষ লোক রাজধানী উলানবাটারে বসবাস করে বাকি একুশ লক্ষ সারাদেশব্যপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে।
পূর্বে অধিকাংশ লোকই ছিল যাযাবর।
তারা বাস করতো 'গের' নামক তাঁবুতে যা কিনা পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি করা হত।
দেশটির গড় উচ্চতা ১৫০০ মিটার। দক্ষিণাঞ্চলে বিস্তির্ণ গোবি মরুভূমি। উত্তর, উত্তরপুর্ব, ও উত্তরপশ্চিম অঞ্চল পর্বতময়।
মধ্য অঞ্চলের অনেকাংশ জুড়ে রয়েছে সাইবেরিয়ার মত স্তেপ অঞ্চল। অনেকাংশ আবার জঙ্গলাকীর্ণ।
আবাদযোগ্য জমির পরিমান নগন্য। বেশির ভাগ জমি হয় পাথুরে, না হয় বালুকাময়, না হয় পর্বতময়, না হয় জঙ্গলময়, না হয় স্তেপভূমি, না হয় বরফময়।
আবহাওয়া চরম বৈরি ভাবাপন্ন।
গড়পড়তা বৃষ্টিপাত ৩০ সেমি মাত্র।
বছরের ২৬০ দিনই আকাশে মেঘ থাকে না।
শীতকাল দীর্ঘ প্রলম্বিত।
বছরের প্রায় ৮ মাসই দেশের অধিকাংশ অঞ্চল বরফাচ্ছাদিত থাকে।
সর্ব নিম্ন তাপমাত্রা মাইনাস ৪৫ডিগ্রী পর্যন্ত রেকর্ড হয়ে থাকে।
গরম কালের স্থায়িত্ব কম কিন্তু উষ্ণতা অসহনীয় হয়ে থাকে বিশেষ করে গোবি মরু অঞ্চলে।
তেমন উল্লেখ যোগ্য কোন নদী অববাহিকা নাই।
প্রধান ফসল সামান্য গম, যব ও ভূট্টা।
প্রধান জীবিকা পশুপালন ও পশু বিশেষত ঘোড়ার বেচা কেনা করা।
এই ব্যবসা বাণিজ্য চলতো চীন ও পারস্যদেশের সাথে।
প্রধান পশু ঘোড়া, ঊট ও ভেড়া।
পালিত ঘোড়া দিয়ে বন্য ঘোড়া শিকার করে পোষ মানানো হয়।
পোষা ঈগল ব্যবহার করে বন্য খেঁকশিয়াল ও খরগোশ জাতীয় ছোট বন্যপ্রাণী শিকার করা হয়ে থাকে।
এক্ষেত্রে তীরধনুক ও ঘোড়ার ব্যবহার গুরুত্ববহ।
পশু শিকারে দঁড়ির ফাঁস, তীর ধনুক এবং তরবারির চেয়ে ছোট আকারের ভোজালির ব্যবহার লক্ষণীয়।
জীবন ও জীবিকা অত্যন্ত কঠিন।
জীবন জীবিকার তাগিদে গ্রীষ্ম কালে শত শত মাইল পাড়ি দিতে হয়।
প্রধান খাদ্য উট, ভেড়া ও ঘোড়ার মাংস।
শীত কালের জন্য মাংসের শুঁটকি মজুত রাখতে হয়।
ধর্ম প্রধানত শামানিজম (প্রকৃতি পুজারি)। নীল আকাশের পুজারী। পরবর্তীতে তিব্বতীয় লামাইজম।
প্রধান খেলাধুলা : ঘোড়দৌড়, তীরছোঁড়া ও কুস্তী।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রচন্ড বিরুপ আবহাওয়া, চরমভাবাপন্ন ভৌগলিক অবস্থান, কঠিনতর জীবিকা, পাশবিক খাদ্যাভ্যাস, যাযাবর জীবন যাপন মঙ্গোলদেরকে দুর্ধর্ষ করে তুলেছে। এই দুর্ধর্ষ জাতি একদিন পৃথিবী জয়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছে।
এই মঙ্গোল দের মধ্যে থেকে ১১৬২ সালে উত্থান হয়েছিল (তেমুজিন) 'চেঙ্গিস খানের। তিনি মঙ্গোলদের সকল গোত্রকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। পরবর্তী কালে মধ্য এশিয়ার অন্যান্য দুর্ধর্ষ যাযাবর জাতিগোষ্ঠী - হুন, তাতার, তুর্কী, কাজাখ, উইঘুর, সকলকে দলে টেনে
অর্ধ পৃথিবীব্যাপী বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক হয়েছিলেন। এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছিল চার কোটি মানব সন্তানকে ।
---------------------------------------
অপর দিকে বাংলা নামে একটি দেশ আছে যার অবস্থান দক্ষিন এশিয়াতে।
আয়তন দেড় লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের কম।
লোক সংখ্যা ষোল কোটি মাত্র।
উত্তরে হিমালয় পর্বত মালা, দক্ষিনে বঙ্গোপসাগর।
মূলত এটি গাঙ্গেয় বদ্বীপ।
গঙ্গা, ব্রম্মপুত্র, মেঘনা সহ অসংখ্য নদী নালা বিধৌত এক অপূর্ব সবুজ শ্যামল সমতল ভূমি।
এটি নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল।
এখানে ষড় ঋতুর অপরূপ সমাহার।
এখানে বসন্ত আসে কোকিলের সুমধুর গানে, পলাশ শিমুল রাঙিয়ে দেয় প্রকৃতিকে।আমের বনে ঘ্রানে পাগল করে।
গ্রীষ্মের গাছে গাছে আম জাম কাঁঠালের মধুর রসে ভরপুর হয়ে ওঠে মানুষের মন ও গৃহস্থের আঙ্গিনা।
বর্ষায় এখানে মৌসুমি বায়ু বৃষ্টি ঝরায় অঝোর ধারায়।
নদী নালা খালবিল উপচে পানিতে ছয়লাব হয় মাঠঘাট।
ছোট ছোট নৌকা রঙ বেরঙ এর পাল উড়িয়ে ছুটে চলে এদিক থেকে সেদিকে। ভাটিয়ালী গানে চারিদিক মুখর করে তোলে নৌকার মাঝি।
শরতে নদীর ধারের সাদা কাশবন নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের সাথে কেমন মিতালি গড়ে তোলে। সাথে যোগ দেয় শিউলি।
হেমন্তের আদিগন্ত হলুদ শর্ষে খেত কিংবা সোনালি ধানের খেত, আকাশে উড়ে যাওয়া গাংচিল অথবা
খৈ রঙ হাঁসের পালক, 'জীবনানন্দের ' কথা মনে করিয়ে দেয়।
হেমন্তের ধূসর সীমানা ছাড়িয়ে অবশেষে শীত নামে।
উত্তরের হিমেল হাওয়ায় ভর ক'রে কুয়াশারা ভীড় করে, যখন নক্ষত্রের রাত্রি নামে ;গাছের পাতায় টিপ টাপ শব্দ তুলে শিশির ঝরে , অথবা সকালের সোনা রোদে মুক্তার দানার মত ঝিকমিক করে ওঠে একটি ধানের শীষের উপরে একটি শিশির বিন্দু!
এখানে অল্প পরিশ্রমে দেখা যায় মাঠ ভরা সোনালি ফসল।
অসংখ্য নদ নদী খাল বিলে ধরা পড়ে অজস্র স্বাদু পানির মাছ। (মৎস্য মারিব, খাইবো সুখে)।
নদীর মোহনায় ধরা পড়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বাদের রুপালি ইলিশ।
এখানকার মানুষের তাই যেতে হয় না ভিনদেশে যুদ্ধ জয়ে কিংবা জীবিকার সন্ধানে।
মানুষের মন নরম পলি মাটির মতই নরম।
ফলাফল খুবই সরল অংকের মত।
১১৯৩ সালে দুর্ধর্ষ তুর্কী সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বিনা বাধায় তৎকালীন ভারত বর্ষের দখল নিতে থাকেন।
ধীরে ধীরে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে ১২০৩ সালে ১৭ জন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে তিনি যখন বাংলার রাজদরবারের কাছে পৌছে যান, তখন ' রাজা লক্ষন সেন ' পেছনের খিড়কী দরজা দিয়ে পলায়ন করেন।
তাই বলে বাংলার বীরত্বের ইতিহাস ঐতিহ্যকে মোটেও কটাক্ষ করা যাবে না।
বাংলার বীর সেনাপতি বিজয় সিংহ আজ থেকে ২৩০০ বছর আগে প্রথম সিংহল ( বর্তমান শ্রীলঙ্কা) জয় করেছিলেন।
তারপর অনেক বীরত্বগাঁথা!
ব্রিটিশ বিরোধী স্বরাজ, পাকিস্তান আদায়ের আন্দোলন। এরপর একাত্তরের রক্তাক্ত স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছে।
আমাদের লাখো বঙ্গ সন্তান জীবিকার সন্ধানে পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে আছেন। তাদের কষ্টার্জিত রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে।
সকল দূর্নীতির অবসান ঘটিয়ে,একটি ন্যায় ও সুশাসনভিত্তিক , জনগনতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র সকলের কাম্য।
আজ আমরা চেঙ্গিস খানের 'মঙ্গোলিয়া 'থেকে অনেক এগিয়ে আছি। আরও এগিয়ে যাওয়ার বাসনা।
জয় বঙ্গ সন্তান! জয় বঙ্গ শার্দূল!
------ ডা. সুকুমার সুর রায়।।
প্রাক্তন পরিচালক
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর , ঢাকা
আপনার মতামত দিন: