Ameen Qudir

Published:
2017-02-28 20:36:29 BdST

অভিশপ্ত কাঁকন


 

ডা.শিরিন সাবিহা তন্বী
______________________________


প্রতিদিনের মতই অফিস শেষ হতে না হতেই আমি মস্তিষ্কে কাজ গুলিকে সাজিয়ে নি।নইলে সময়ের সাথে পেরে উঠি না।বাসায় বাজার করতে হবে।মাসের শেষ।টানাটানির সংসার।চাল,আলু,কিছু ডাল,কাঁচা বাজার আর বাজারের দোকান থেকে এক কেজি জিলেপী!তৃনা জিলেপী বড্ড ভালবাসে!অনেক চেষ্টা করেছিলেম এমন দিনে এক খানা কাপড়,দেব, হয়ে উঠল না।তৃনার ঔষধ কিনতে কিনতে এই এক বছরে এক পয়সা জমেনি।বরং প্রতি মাসেই টুক টাক ধার কর্য থাকছে।
বুকটা আজকাল একটু ভার হয়।চোখের কোনায় পানি জমা হয়।এত আবেগী অভিমানী আগে তো আমি ছিলাম না!বরং একটু অগোছালো,নিরুত্তাপ,দায়িত্বহীন ই শুনে এসেছি নিজেকে বার বার!অন্তত তৃনা তাই বলত!

আমাদের প্রেমের বিয়ে।তৃনা ওর বাবার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান।ওর বাবার প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর তৃনার মা ঐ বাড়ীতে বউ হয়ে আসে।কলেজে একসাথে পড়ার সময় থেকে আমরা বন্ধু।আর বন্ধুত্বেই আমার মার ভীষন বিরক্তি ছিল ওর উপর।সেটা যখন জীবন সঙ্গীতে বদলালাম!বাবা মা আমার মুখ দেখতে নারাজ ছিলেন।
মায়ের সেই ক্ষোভ অভিমান আজ ও আছে।
পড়াশুনা শেষ করে কেবল চাকরীতে ঢুকতে ঢুকতেই বিয়ে।তৃনার বাড়ী থেকে বাঁধা ছিল না।তাই ও বাড়ীতে বিয়ে হয়েছে।
বিয়েতে কোন অনুষ্ঠান হয়নি।তৃনা ওর মায়ের একখানা শাড়ী পড়েছিল।একটু ও সাজেনি।আগে মনে হয়নি।আমি অতটা বুঝি ও না।ওর জন্য কিছু কিনিনি।এমনকি বাসর রাতে বউয়ের মুখ ও আমি শূন্য হাতেই দেখেছি।
বন্ধুদের থেকে শুনেছি সন্তান জন্মকালে অনেকে বউকে উপহার দেয়।আমি দিইনি।ঐভাবে ভাবিও নি।আর টাকাও থাকে না।একটা প্রাইভেট ব্যাংকে ক্লারিক্যাল জব!বেতন মোটামুটি।মায়ের সংসার খরচের টাকা।বোনের বিয়ে,ভাইয়ের পড়া!

বিয়ের ছ মাসের মাথায় শখ টা প্রথম করেছিলেম।তৃনার শরীরে অলংকার বলতে কিছুই ছিল না।বহুরাত ওর বাহুযুগলে আবদ্ধ হতে হতে ভেবেছি ওকে কিছু দেব।সোনার তৈরী কিছু।
আমার দাদী মারা যাবার কিছুদিন আগে ওকে দেখলেন।হাত দুখানা খালি দেখে বেশ বকলেন আমাকে।সেই থেকে চা,নাস্তা,বাইরে খাওয়া বাদ দিলাম।অফিস শেষে সোনার দোকানে দোকানে ঘুরতাম।দু গাছা সোনার কাঁকন???
এ যে লক্ষ টাকার বেশী লাগবে।একটু একটু করে টাকা জমাচ্ছিলাম।বহু কষ্টেও ঐ টাকা স্পর্শ করিনি।
এরি মাঝে ঘর আলো করে কন্যা এল!রীমার জন্মের তিন দিন পর তৃনাকে স্যালাইন দিতে হয়েছিল।দুটো হাতে অসংখ্য ছিদ্র করেও ভেইন পাচ্ছিল না নার্সরা।দাঁতে ঠোট চেপে কষ্টটা সইছিল সে।
আমি বড় সাধারন মানুষ।গুছিয়ে কিছু বলতে পারি না।ওর সব না থাকা না পাওয়া আমায় বড় কাঁদাত।
চার বছর ধরে টাকা জমালাম।গোপনে ওর জন্য কাঁকন বানাতে দিলাম।
গত বছর এমন দিনে সে মেয়েকে সাথে করে আমার জন্য বানাতে দেয়া কমপ্লিট স্যুটের ডেলিভারী নিতে এসেছিল।
অনিন্দ্যসুন্দর কাঁকন জোড়া হাতে পেয়ে যখন তৃনার অপার হাসি আর লজ্জারাঙা মুখখানা ভাবতে ভাবতে বের হচ্ছিলাম,ফোনটা তখুনি বেজে উঠেছিল।অনিয়ন্ত্রিত ট্রাকের ধাক্কায় রিক্সা থেকে ছিটকে পড়েছে মা মেয়ে!মেয়েটি আমার ওখানেই চিরবিদায় নিল।তৃনা ছিল হাসপাতালে!পাগলের মত ছুটে গিয়েছিলেম।।
হাসপাতালে গিয়ে অর্ধমৃত তৃনার খবর পাই।আমার পকেটে কাঁকন।বিবাহ বার্ষীকিতে প্রেয়সীর জন্য উপহার।কন্যাটি মৃত।।আর ওটি থেকে বের করল তৃনাকে - ওর দুটি হাত ই কেটে ফেলতে হয়েছে।যেন মুহূর্তে ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল আমার জীবন!আমাদের জীবন।

অভিশপ্ত কাঁকন জোড়া এখন আমার মায়ের দখলে।এই খুঁত ওয়ালা তৃনাকে তাঁড়াবে!ছেলের জন্য নতুন বউ খুঁজছে সে।তাকে দেবে।

আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী।কন্যার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।
তৃনা যেন আজ আর আর আমার থেকে আলাদা কেউ নয়।সন্তান হারা এক জোড়া নিঃসঙ্গ কপোত কপোতী আমরা।অঙ্গবিহীন তৃনা আধাঁরে নিমজ্জিত হবে আর আমি আলোয় ঘর বাঁধব??তা কি করে হয়??জীবনের হিসেব সবসময় ই কি মিলে যায়???
মা জোর করেই মিলাতে চাচ্ছেন ভুল ফলাফলের জীবনের অংক টাকে!

আমি কঠিন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।কাউকে না জানিয়ে অফিস থেকে বদলী নিয়েছি।তৃনাকে নিয়ে বহু দূরে কোথাও চলে যাব।মায়ের থেকে তার বিয়ের পাত্রীদের থেকেআর ঐ অভিশপ্ত কাঁকন থেকে দূরে!
অনেক দূরে !!!!!

________________________________

ডা.শিরিন সাবিহা তন্বী । দেশের জনপ্রিয় কলামিস্ট। প্রতিভাবান কথাশিল্পী। মেডিকেল অফিসার, শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। পেশাজীবী নেতা।

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়