SAHA ANTAR

Published:
2024-03-16 12:30:15 BdST

মর্মান্তিক আত্মহত্যাপূর্ব করুণ চিঠি "ওরা আমাকে বাঁচতে দিতেসে না, বিশ্বাস করেন..... "‘মার্ডার, টেকনিক্যালি মার্ডার’


 

ডেস্ক
_______________

আজ ইটকাঠ পাথরের ঢাকা শহরসহ সারা বাংলাদেশ বিষন্ন বিপন্ন। গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা মৃত্যুর আগে চিঠি লিখে  যেন পুরো দেশকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে গেছেন।

দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসায় অব্যাহত নারী শিক্ষার্থী পীড়ন, নারী ও পুরুষ শিশু বলাৎকার, ধর্ষণ চললেও বাংলাদেশের মানুষ বড় কোন প্রতিক্রিয়া করে নি। এবার যেন ভূমিকম্প হল।
মেয়েটির ফেসবুক স্ট্যাটাসের বিভিন্ন  লাইন বারবার যেন সকলের কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—‘আমাকে বাঁচতে দিতেসে না বিশ্বাস করেন... বিশ্বাস করেন...’।
এ যেন ধর্ষণ বলাৎকারের শিকার শত শত শিশু ও নারী শিক্ষার্থীর অন্তরের বিলাপ ও মর্মান্তিক  অসহায়ত্ব।


অবন্তিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী ছিলেন। ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, "আমি যদি কখনো সুইসাইড করে মারা যাই, তবে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী আর তার সহকারী হিসেবে তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম।আমি যদি কখনো সুইসাইড করে মারা যাই তবে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী, আর তার সহকারী হিসেবে তার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম। আম্মান যে আমাকে অফলাইন অনলাইনে থ্রেটের উপর রাখতো সে বিষয়ে প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করে ও আমার লাভ হয় নাই। দ্বীন ইসলাম আমাকে নানান ভাবে ভয় দেখায় আম্মানের হয়ে যে আমাকে বহিষ্কার করা ওনার জন্য হাতের ময়লার মতো ব্যাপার। আমি জানি এখানে কোনো জাস্টিস পাবো না। কারণ দ্বীন ইসলামের অনেক চামচা ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। এই লোককে আমি চিনতাম ও না। আম্মান আমাকে সেক্সুয়ালি এবিউজিভ কমেন্ট করায় আমি তার প্রতিবাদ করলে আমাকে দেখে নেয়ার জন্য দ্বীন ইসলামের শরণাপন্ন করায়। আর দ্বীন ইসলাম আমাকে তখন প্রক্টর অফিসে একা ডেকে নারীজাতিয় গালিগালাজ করে। সেটা অনেক আগের ঘটনা হলেও সে এখনো আমাকে নানাভাবে মানহানি করতেসে বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন কথা বলে। আর এই লোক কুমিল্লার হয়ে কুমিল্লার ছাত্র কল্যাণের তার ছেলেমেয়ের বয়সী স্টুডেন্ট দের মাঝে কী পরিমাণ প্যাঁচ ইচ্ছা করে লাগায় সেটা কুমিল্লার কারো সৎসাহস থাকলে সে স্বীকার করবে। এই লোক আমাকে আম্মানের অভিযোগ এর প্রেক্ষিতে ৭ বার প্রক্টর অফিসে ডাকায় নিয়ে " খানকি তুই এই ছেলেরে থাপড়াবি বলসস কেনো? তোরে যদি এখন আমার জুতা দিয়ে মারতে মারতে তোর ছাল তুলি তোরে এখন কে বাঁচাবে? "

ফেসবুক পোস্টে আরও বলেন, আফসোস এই লোক নাকি ঢাবির খুব প্রমিনেন্ট ছাত্রনেতা ছিলো। একবার জেল খেটেও সে এখন জগন্নাথের প্রক্টর। সো ওর পলিটিকাল আর নষ্টামির হাত অনেক লম্বা না হলেও এতো কুকীর্তির পরও এভাবে বহাল তবিয়তো থাকে না এমন পোস্টে। কোথায় এই লোকের কাজ ছিল গার্ডিয়ান হওয়া আর সো কিনা শেষমেশ আমার জীবনটারেই শেষ না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি দিলো না আমি উপাচার্য সাদোকা হালিম ম্যামের কাছে আপনি এই প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক হিসেবে আপনার কাছে বিচার চাইলাম। আর আমি ফাঁসি দিয়ে মরতেসি। আমার উপর দিয়ে কী গেলে আমার মতো নিজেকে এতো ভালোবাসে যে মানুষ সে মানুষ এমন কাজ করতে পারে। আমি জানি এটা কোনো সলিউশন না কিন্তু আমাকে বাঁচতে দিতেসে না বিশ্বাস করেন। আমি ফাইটার মানুষ। আমি বাঁচতে চাইসিলাম! আর পোস্ট মর্টেম করে আমার পরিবারকে ঝামেলায় ফেলবেন না। এমনিতেই বাবা এক বছর হয় নাই মারা গেছেন আমার মা একা। ওনাকে বিব্রত করবেন না। এটা সুইসাইড না এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার। আর আম্মান নামক আমার ক্লাসমেট ইভটিজার টা আমাকে এটাই বলছিল যে আমার জীবনের এমন অবস্থা করবে যাতে আমি মরা ছাড়া কোনো গতি না পাই। তাও আমি ফাইট করার চেষ্টা করসি। এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সহ্য ক্ষমতার।"


জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের
সহকারী অধ্যাপক
রাহাত মিনহাজ এক মর্মস্পর্শী শোক লিপি তে লিখেছেন,


১৫ মার্চ মধ্যরাতে যখন এই লেখাটি লিখছি, তখন মেয়েটি কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের মর্গে। হিমঘরে মেয়েটির শরীর হয়তো এখন বরফ শীতল। হয়তো তার শেষশয্যার জায়গা নির্বাচন ও আনুষঙ্গিক বিভিন্ন প্রস্তুতি চলছে।


এদিকে সে যখন সব সমীকরণের বাইরে, তখন ফেসবুকের ফিডে মেয়েটিকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা, আপলোড হচ্ছে ছবি, চলছে প্রতিবাদ, ধিক্কার জানানো হচ্ছে অভিযুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর প্রতি।

সর্বশেষ খবর দ্য ডেইলি স্টার বাংলার গুগল নিউজ চ্যানেলে।
এই যখন সার্বিক পরিস্থিতি, তখন ফাইরোজ অবন্তিকার প্রতিষ্ঠানের একজন সামান্য শিক্ষক হিসেবে আমার ঘুম আসছে না। চোখের পাতা এক করতে পারছি না। মেয়েটির ফেসবুক স্ট্যাটাসের কয়েকটি লাইন বারবার যেন কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—'আমাকে বাঁচতে দিতেসে না বিশ্বাস করেন... বিশ্বাস করেন...'।

আমি মনে করি, একজন মানুষ খুবই জটিল একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এমন সিদ্ধান্তের দিকে যায় এবং এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া নিশ্চিতভাবে খুবই কঠিন। আর খুব সম্ভবত এর পেছনে একক নয়, বরং বিবিধ কারণ একসঙ্গে কাজ করে।

তবে হ্যাঁ, একটা আঘাত বা অপমান হয়তো এমন সিদ্ধান্ত নিতে শেষ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তিকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়। সামান্য শিক্ষাবিদ হিসেবে এটা আমার ধারণা। মনোবিদ ও চিকিৎসকরা নিশ্চয় এ বিষয়ে গবেষণালব্ধ ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরোজ অবন্তিকার সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছে তা এখনই পরিষ্কার করে বলা কঠিন। এর জন্য নিবিড় ও প্রভাবমুক্ত তদন্ত প্রয়োজন। যাতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাত্ত হবে মেয়েটির ফেসবুক স্ট্যাটাস।


ফাইরোজ অবন্তিকার আত্মহত্যায় দুটি বিষয় সামনে এসেছে।

১. অনলাইনে নিপীড়ন

২. এক শিক্ষকের (সহকারী প্রক্টর) অসংবেদশীল আচরণ।

কয়েক বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খুবই সংবেদনশীল এবং বাংলাদেশের বাস্তবতায় কিছুটা অধিকতর ঝুঁকির একটা বয়সে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে তারা প্রবেশ করেন। এ সময় তারা প্রাকৃতিকভাবে নানা ধরনের মানবীয় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। অনেকেই হয়তো বুঝে বা না বুঝে নানা ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত নেন। যা তাদের মানসিক অবস্থা ও শিক্ষাজীবনকে ভীষণভাবে বিপর্যস্ত করে।

আমার বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী এমন কয়েকটি বিষয়ে আমার কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন। আমি আমার তরফে সামান্য চেষ্টার পর তাদের বিভাগের প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তা কেন্দ্রের সাহায্য নিতে বলেছিলাম। হয়তো তারা এতে কিছুটা উপকৃত হয়েছিলেন।

তবে অনলাইনে নিপীড়ন যে ভয়াবহ একটা বিষয়, তা দিনদিন আমাদের সামনে নতুনভাবে হাজির হচ্ছে। ফাইরোজ অবন্তিকা অনলাইন ও অফলাইনে তার সহপাঠীর দ্বারা নিপীড়িত হওয়ার অভিযোগ করে গেছেন বিদায়ী বার্তায়। বিষয়টা আগেভাগে যথাযথভাবে আমলে নিতে পারলে হয়তো মেয়েটাকে বাঁচানো যেতো।

এবার দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আসি। একটু আগেই বলেছি, বয়ঃসন্ধিকাল পেরিয়ে শিক্ষার্থীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে আসেন, তখন তারা খুবই সংবেদনশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ একটা অবস্থায় থাকেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা প্রথমবারের মতো পরিবার ছাড়া থাকেন। তাদের নানা বিষয়ে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। একা চলতে হয়। এ সময় শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হতে পারে তাদের আস্থার একটি জায়গা, ভরসার জায়গা, একটি আশ্রয়স্থল।

কিন্তু এই পরিস্থিতিতে শিক্ষক বা দায়িত্বশীল পদে থাকা কোনো শিক্ষক যদি অসংবেদনশীল ও নিপীড়নমূলক আচরণ করেন, তাহলে যেকোনো শিক্ষার্থীর জন্যই তা সহ্য করা কঠিন। হয়তো ফাইরোজ অবন্তিকার ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছে। যথাযথ তদন্তের পরই হয়তো তা জানা যাবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন সামাজিক বিজ্ঞান ভবনে অষ্টম তলায় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। সপ্তম তলায় ফাইরোজ অবন্তিকার আইন বিভাগ। বিভাগে পৌঁছাতে অনেক সময় আমরা একই লিফট ব্যবহার করি। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের লিফট ব্যবহার করেন, আমরাও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লিফটে উঠি। নিত্যদিনের এই চলাচলে ফাইরোজ অবন্তিকা নামে এই মেয়েটিকে সহজেই নজরে পড়তো। অগ্রসর, চটপটে, চঞ্চল এই প্রাণটির এভাবে নিভে যাওয়া সত্যিই বেদনা জাগাচ্ছে। আক্ষেপ বাড়াচ্ছে...।

মনের অজান্তেই বারবার স্ক্রল করছি, মেয়েটির বিদায়ী বার্তা। কী করুণ, কী কঠোর উচ্চারণ—'আমাকে বাঁচতে দিতেসে না বিশ্বাস করেন...'। পরের দিকে মেয়েটি লিখেছেন, 'এটা সুইসাইড না, এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার।'

এই 'মার্ডার'র যথাযথ তদন্ত ও শাস্তি হলে হয়তো আগামীর মার্ডারগুলো ঠেকানো যাবে। আমরা কি আগামী দিনের মার্ডারগুলো ঠেকাবো, নাকি যতো দ্রুত সম্ভব এই ঘটনাটাই ভুলে যাবো?"

গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা। আত্মহত্যা চেষ্টার পূর্বে ফেসবুকে দেওয়া দীর্ঘ এক পোস্টে তিনি এ ঘটনার জন্য আম্মান সিদ্দিকী নামে তার এক সহপাঠীকে দায়ী করেছেন। একইসঙ্গে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে আম্মান সিদ্দিকীর সহযোগী উল্লেখ করে এ ঘটনার জন্য দায়ী করেন তিনি।

শুক্রবার (১৫ মার্চ) রাত ১০টার দিকে কুমিল্লা সদরের নিজ বাসায় গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা চেষ্টা করেন ফাইরুজ অবন্তিকা। পরে তাকে উদ্ধার করে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা জানান, তিনি মারা গেছেন।

#

আপনার মতামত দিন:


কলাম এর জনপ্রিয়